মধ্য আঠারো শতকের স্পেনের স্ফিংকস। এটি রয়েছে স্পেনের মাদ্রিদের ৮০ কিলোমিটার উত্তরে La Granja de San Ildefonso প্রাসাদে। মানবসভ্যতার অনেক জাতির মধ্যেই মিশ্র মানবপশুর কল্পনা রয়েছে।
মানুষ সভ্যতার উষালগন থেকেই এমন অনেক অতিকায় জীবের কল্পনা করেছে ঠিকই, তবে প্রথম কোন্ জাতি কল্পনা করেছে তা বলা কঠিন । প্রাচীন সভ্যতার প্রসঙ্গে প্রাচীন মিশরের কথা ওঠে। গবেষকদের ধারণা অতিকায় জীবের কল্পনা প্রথম করেছিল প্রাচীন মিশর । পরবর্তীকালে গ্রিকরা যে অতিকায় জীবের নাম দিয়েছিল স্ফিংকস। ব্রোঞ্জযুগ থেকেই গ্রিসের সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ওই মিশর থেকেই স্ফিংকস-এর ধারণা গ্রিসে পৌঁছেছিল । অবশ্য গ্রিসের স্ফিংকস সংক্রান্ত উপকথা এবং অবয়ব মিশরের স্ফিংকস-এর চেয়ে ভিন্ন।
গ্রিক স্ফিংকস । গ্রিক পুরাণে স্ফিংকস এমন এক বিচিত্র জীব- যার মাথা ও স্তন নারীর, শরীর সিংহের এবং ডানা পাখির । গ্রিক স্ফিংকস পাথরের ওপর ঝুঁকে আছে-এই দৃশ্যটিই পরিচিত । যারা থিবস নগরে প্রবেশ করতে চায় তাদের ধাঁধা জিজ্ঞেস করে। ইডিপাস-এর উপকথায় গ্রিক স্ফিংকস এর কথা রয়েছে ...
sphinx শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর মানে চেপে ধরা বা শক্ত করে বাঁধা। গ্রিক সিংহের শরীর নারীর মুখ পাখির ডানা। সিংহ চেপে ধরে শিকার করে, কাজেই এর মানে বোঝা যায়। অন্য মতও অবশ্য আছে। ঐতিহাসিক Susan Wise Bauer মনে করেন, মিশরীয় shesepankh শব্দটি থেকে স্ফিংকস শব্দের উৎপত্তি হয়েছে । shesepankh শব্দের অর্থ জীবন্ত ছবি। জীবন্ত ছবি? কারণ নিরেট পাথর খুদে স্ফিংকস-এর জীবন্ত ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ইদিপাস এবং স্ফিংকস
ইডিপাস-এর উপকথায় গ্রিক স্ফিংকস এর কথা রয়েছে।
সেই নির্বাচিত অংশটুকু পাঠ করা যাক:
... ইডিপাস থিবস নগরীর দিকে হাঁটতে থাকে। থিবস নগরীর তোড়ণ দ্বারের বাইরে একটি স্ফিংকস-এর দেখা পেল। স্ফিংকসটি দেখতে অদ্ভূত! অর্ধেক নারী অর্ধেক সিংহর মতন- আবার পাখির মতো ডানাও আছে। সে প্রায়ই থিবস এ এসে অত্যাচার করত। স্ফিংকস এর জ্বালায় থিবসবাসী অতিষ্ঠ । স্ফিংকস সবাইকে ধাঁধা জিগ্যেস করে। সঠিক উত্তর দিতে না পারলে খেয়ে ফেলে।ধাঁধাটি হল: একটি মাত্র কন্ঠস্বর সকালে চার পায়ে হাঁটে আর দুপুরে দু পায়ে আর তিন রাতে-কি?
মানুষ। ইডিপাস বলল। আরও বলল, নবজাতক চার পায়ে হামাগুঁড়ি দেয়, বড় হয়ে মানুষ দুই পায়ে হাঁটে, আর বৃদ্ধ হলে লাঠি ব্যবহার করে।
ধাঁধার উত্তর পেয়ে স্ফিংকস নিজেকে হত্যা করে।
থিবস বিপদমুক্ত হল।
ইদিপাস কাহিনীর বিস্তারিত
গ্রিক উপকথায় স্ফিংকস লোভী আর অশুভ হলেও মিশরে স্ফিংকস তেমন নয়। প্রাচীন মিশরে স্ফিংকস- এর ছিল গভীর সম্মান। মিশরের স্ফিংকস শক্তিশালী জীব। এটি উপাসনালয়, প্রাসাদ, পিরামিড এবং উপাসনালয়ের অভ্যন্তেরে লুক্কায়িত গুপ্তজ্ঞান পাহারা দিত। প্রাচীন মিশরীয় মানুষের এমনই বিশ্বাস ছিল। স্ফিংকস-এর শরীরটি সিংহের মতো, মাথাটি ফারাও-এর রাজকীয় কাপড়ে ঢাকা, এ ধরনের স্ফিংকস অবশ্য পরবর্তী যুগের।
মিশরের কারনাক এর ভেড়ামুখো স্ফিংকস । পুরুষ মেষের মাথাওয়ালা স্ফিংকস দেবতা আমুন-এর সঙ্গে সর্ম্পকিত। এই ধরণের স্ফিংকস কে বলা হত Criosphinx । কোনও কোন স্ফিংকস-এর মুখ হত বাজপাখির মতো । এই ধরণের স্ফিংকস কে বলা হত Hieracosphinx..
প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা স্ফিংকস কে কি বলত তা জানা যায়নি। ‘স্ফিংকস’ নামটি গ্রিকদের দেওয়া। প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিকেরা মিশর সম্পর্কে প্রচুর লিখেছিলেন। তারাই অতিকায় জন্তুমানব মূর্তি বোঝাতে ‘স্ফিংকস’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন ।
মিশরের মানচিত্রে গিজার গ্রেট স্ফিংকস এর অবস্থান
আমরা মিশরের প্রখ্যাত গিজার স্ফিংকস-এর নাম শুনেছি। এটি নির্মান করা হয়েছিল ৬৬ ফুট পাথরের টুকরা থেকে খোদাই করে।(... মনে থাকার কথা ঐতিহাসিক Susan Wise Bauer মনে করেন, মিশরীয় shesepankh শব্দটি থেকে স্ফিংকস শব্দের উৎপত্তি হয়েছে । shesepankh শব্দের অর্থ জীবন্ত ছবি। জীবন্ত ছবি? কারণ নিরেট পাথর খুদে স্ফিংকস-এর জীবন্ত ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।) গিজার স্ফিংকস-এর উচ্চতা ২৪০ ফুট! ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন মিশরীয় দেবতা হোরাস-এর উদ্দেশে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটির অবস্থান খাফরি পিরামিড- এর কাছে। খাফরি পিরামিড মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিড। বিশ্বাস করত নীল উপত্যকা পাহারা দিচ্ছে স্ফিংকস পাহারা দিচ্ছে। মিশরের ধর্মসংস্কৃতিতে স্ফিংকস এর ভূমিকা অনুমান করা যায়। খাফরি পিরামিড-এর অভ্যন্তরে ফারাও খাফরির সমাধি রয়েছে। খাফরি ছিলেন প্রাচীন মিশরের চতুর্থ রাজবংশের ফারাও । তার শাসনকাল ২৫৫৮ থেকে ২৫৩২ খ্রিস্টপূর্ব। গ্রিকরা ফারাও খাফরি কে বলত Chefren । যে কারণে খাফরি পিরামিড Pyramid of Chefren নামেও পরিচিত।
খাফরি পিরামিড এবং গিজার গ্রেট স্ফিংকস
এই নিবন্ধের প্রারম্ভে বলেছি। কেবল গ্রিস নয় অন্যান্য সভ্যতায় মিশ্র পশু কিংবা মানবপশুর ধারণা ছিল। তবে এদের ঠিক স্ফিংকস না বলে A composite mythological being বলাই সঙ্গত। যেমন স্বর্গীয় ঘোড়া বুরাক। মধ্যপ্রাচ্যের উপকথায় স্বর্গ মর্তের বাহন। জীবটি মোটেও হিংস্র নয় বরং পবিত্র পুরুষদের বাহন।
বুরাক। সপ্তদশ শতকের মুগল মিনিয়েচার। এই মানবমুখো ডানাওয়ালা উড়ন্ত অশ্বটি ইসলামের ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়জুড়ে রয়েছে ...
ভারতবর্ষেও মিশ্র এক বিচিত্র প্রাণির ধারণা রয়েছে। ভারতে কে জীবটিকে বলা হয়েছে ‘পুরুষমৃগ’। শব্দটি সংস্কৃত । কিন্তু, পুরুষমৃগের ধারণা ভারতীয়রা কেন করেছিল? প্রখ্যাত ভারতীয় সাধক Raja Deekshithar মনে করেন, I see the sphinx as a symbol of human evolution and devolution. The human soul is on a quest for higher realization, but is also in danger of sliding back into animal nature. The animal aspires to a higher form of existence . বলা বাহুল্য এত গভীর আধ্যাত্বিক অনুভূতি মিশর কিংবা ইউরোপে আমরা লক্ষ করি না। গ্রিসে স্ফিংকস মানে বিরোধ আর সংঘাত। মিশরে স্ফিংকস রহস্যময় শক্তি। অথচ, আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম ... স্ফিংকস সংক্রান্ত ভারতবর্ষের ব্যাখ্যা একেবারেই ভিন্ন।
ভারতীয় স্ফিংকস ‘পুরুষমৃগ’। এটি রয়েছে ভারতের ইলোরার শ্রী কৈলাসনৎ মন্দিরের দেহলিতে । অষ্টম শতকের শেষের দিকে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজা ১ম কৃষ্ণ মন্দিরটি নির্মান করেন ।
মধ্যপ্রাচ্যের আসিরিয় সভ্যতায় স্ফিংকস-এর ধারণা ছিল, যদিও সেটি প্রাচীন মিশরের স্ফিংকস এর চেয়ে ভিন্ন। আসিরিয় সভ্যতায় স্ফিংকস-এর মাথা মানুষের মত হলেও স্ফিংকস-এর অন্য অংশ ষাঁড় কিংবা সিংহের মতো। কখনও পা চারটির বদলে পাঁচটি। পারস্য আসিরিয় সভ্যতার স্ফিংকস ধারণা গ্রহন করেছিল।
পারস্যের স্ফিংকস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০)। এটি রয়েছে পারস্যের সম্রাট
দারিয়ূসের প্রাসাদে। প্রাসাদটি সুসায় অবস্থিত। মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্গীয় ঘোড়া বুরাক এই পারস্যের স্ফিংকস আদলে গড়ে উঠেছিল কিনা সেটি গবেষনার বিষয়।
আসলে স্ফিংকস কীসের প্রতীক?
এ নিবন্ধের অন্তিম লগ্নে পৌঁছে এ প্রশ্নটি উত্থাপন করা যায়। স্ফিংকস সংক্রান্ত ভারতীয় ব্যাখ্যা আমরা জেনেছি। প্রাচীন মিশরের স্ফিংকস ছিল প্রাচুর্য ক্ষমতা প্রজ্ঞা রহস্য ধাঁধা সত্য ঐক্য এবং গোপনীয়তার প্রতীক। কখনও এক জোড়া স্ফিংকস দিয়ে জীবনবৃক্ষের (ট্রি অভ লাইফ) উর্বরতা এবং গর্ভধারণ বোঝানো হত। কখনও স্ফিংকস কে সৌর প্রতীক মনে করা হত, যা দেবতা রা- এর অনুষঙ্গ। অভিন্ন শরীরে মানবপশু বলেই স্ফিংকস ছিল মন ও শরীরের প্রতীক। কখনও শরীর এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতীক। কখনও আবার বাতাস মাটি আগুন ও পানির প্রতীক। ইউরোপের প্রাচীন ধর্মের পুরোহিতরা-যাদের ড্রুইড বলা হত-তারা রজঃ এবং উর্বরতা প্রতীক হিসেবে বহু স্তনবিশিষ্ট স্ফিংকস - এর কল্পনা করেছিল।
মিশ্র মানবপশুর কংকাল! এই ছবিটির মাধ্যমে মানবসভ্যতায় স্ফিংকস-এর গভীর অভিঘাত ও আগ্রহ ফুটে উঠেছে।
ইসলাম এবং ভারতীয় বৈদিক ধর্মে আমরা স্ফিংকস-এর ভূমিকা সম্বন্ধে জেনেছি। স্ফিংকস খ্রিস্টধর্মে গভীর প্রভাব রেখেছে, তবে প্রতীকি ভাবে । এক শ্রেণির খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক মনে করেন, স্ফিংকস হল যিশুর দ্বৈতসত্তার প্রতীক । যিনি একই সঙ্গে মানব এবং স্বর্গীয় সত্তার অধিকারী। স্ফিংকস - এর মানব মস্তিস্ক, বুক, ঈগলের ডানা, ষাঁড় ও সিংহ ...এসব বাইবেলিয় প্রতীক। সিংহ অরণ্যের রাজা, ঈগল বাতাসের রাজা, ষাঁড় কৃষিখামারের রাজা, মানুষ সৃষ্টির রাজা। যে কারণে সাধু জেরোমি একবার বলেছিলেন: Christ's Incarnation (the man), His Passion (the bull), His Resurrection (the Lion), and His Ascension (the eagle).
ছবি। ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
http://www.theoi.com/Ther/Sphinx.html
http://interoz.com/egypt/sphinx.htm
Click This Link
http://hubpages.com/hub/The-Sphinx-Mythology
http://www.sphinxofindia.rajadeekshithar.com/
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ১২:২৭