বিয়ের ঠিক দু-মাস মাস পর রওনক-এর মুখটা অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়া হল ... তারপর সরকারি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হল মেয়েটিকে । সুন্দর ফরসা মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে ... সে মুখের লাবণ্য-সৌন্দর্য মেয়েটি আর কখনোই ফিরে পাবে না, ওর মুখে ব্যান্ডেজ। অথচ বিয়ের দিন কী অপরূপই না দেখাচ্ছিল উনিশ বছরের ওই ছিপছিপে মেয়েটি কে। বিয়ের রাতে ওদের বাংলামোটরের বাড়িটি আলোয় আলোয় ঝলমল করছিল। আর ছিল অজস্র কন্ঠের হইচই ...ছাদের ওপর সৈখিন ব্যান্ড দলের ধুমধারাক্কা গান ... ড্রামস-এর ধূপধাপ আওয়াজ ...আর রওনক-এর বুকের মধ্যে হাতুরি পেটানোর শব্দ ...একে নতুন জীবনের হাতছানি ...তার ওপর আজ রাতেই এক অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে একা একটি ঘরে মুখোমুখি হওয়ার অজানা আশঙ্কা ...শিহরণ ...সেই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া শওকতের মুখটাও মনে পড়ছিল ...
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রওনক যখন বরের গাড়িতে উঠল-ঠিক সেই মুহূর্তে শওকত বহুদূরে নেশায় আচ্ছন্ন ... শওকত নেশায় আচ্ছন্ন - কেননা, রওনক-এর মুখটি তার বুকে তীরের মতো বিঁধছিল। খুব বেশি দিন হয়নি রওনক-এর হাত ধরে নদীর পাড়ে পেভমেন্টের ওপর দিয়ে হেঁটে-হেঁটে বহুদূর চলে যেত শওকত। সেই শুভ্র আলোর সুগন্ধীময় দিনগুলি ছিল ভারি আশ্চর্যের । আর তীব্র আবেগের ... কী ভাবে যেন কেটে যেত সেই আশ্চর্য সময় । ঢাকা শহরের আকাশে মেঘ জমত। শওকত উদাত্ত কন্ঠে গাইত -
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।
চমৎকার গানের গলা শওকতের ... মুগ্ধ হয়ে শুনত রওনক ... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ত রওনক। শওকত চারুকলায় ... রওনক-এর এক বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচয়। ... আপাদমস্তক ছন্নছাড়া শওকত ... তখন ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি বলেই শওকতকে ভালোবেসে ফেলেছিল রওনক ... শ্যামলবর্ণের শওকতের চোখে গোলকার ফ্রেমের চশমা ... মাথার চুল পিছন দিকে চূড়ো করে বাঁধা ...গলায় তাবিজ ...সর্ম্পকের দু-বছরের মাথায় রওনক-এর বাবা যখন বিয়ের জন্য চাপ দিলেন ...তখন ছন্নছাড়া বলেই বাবার সামনে বাউন্ডুলে বাউলটাকে প্রেজেন্ট করা গেল না...শওকতই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল-ধুরও ... তবুও কেমন স্বপ্নের মতো দিনগুলি কাটছিল দু’জনের ... দুঃস্বপ্ন ঘনিয়ে আসার আগে ...
রওনক-এর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর রওনক-এর মা সেতারা আহমেদ তার স্বামীকে বললেন, মেয়ের কপাল যে এত ভালো তখন কে জানত। বিয়ের কথা যে দিন পাকা হল সেদিনই পারভেজের অস্ট্রেলিয়ায় ভিসার আবেদন মঞ্জর হল।
আহমেদুল করিম, রওনক-এর বাবা, মাথা নাড়লেন। কী এক আনন্দ ঘিরে আছে তাঁকে। বললেন, সবই উপরঅলার ইচ্ছে সেতু। জীবনে কখনও পাপ করি নি ... আল্লা এই শেষবেলা মুখ ফেরাবেন কেন?
তাই তো।
আহমেদুল করিম হার্টের রোগী । বড় মেয়ে জেরিন স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া থাকে । ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন আহমেদুল করিম । ছোট মেয়ের বিয়েতে দু’হাতে খরচ করেছেন। আহমেদুল করিম-এর তৈরি পোশাকের ব্যবসা। সুসময়ে সোনালি ফসল ঘরে তুলেছেন। গত কুড়ি বছরে যথেস্ট আয় করেছেন। বাংলামোটরে দশ কাঠা জমির ওপর ‘স্বপ্নভিলা’ নামে সিরামিক ইঁটের তিনতলা বাড়ি করেছেন । সে বাড়ি সামনে পিছনে বাগান। বিশাল ছাদেও ফুলের গাছ।
আহমেদুল করিম-এর বড় ভাই থাকেন স্কটল্যান্ড । জায়েদুল করিম ডাক্তার। আট বছর পর সপরিবারে দেশে এসেছেন রওনক এর বিয়ে উপলক্ষে। জায়েদুল করিম মানুষটি ধর্মভীরু। গত বছর হজ করেছেন। পারভেজ নামাজী শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। বললেন, তোর কপাল দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে রে আহমেদ। সারার জন্য মুসলিম পাত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান।
সেতারা আহমেদ বললেন, ভাববেন না ভাইজান। সারার জন্য ঠিকই মুসলিম পাত্র পাবেন। ওপরঅলাই সব ঠিক করে রেখেছেন। ডাক্তার জায়েদুল করিম সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন ।
পাত্রকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে কাওয়াসাকি মোটরসাইকেল উপহার দিলেন ডাক্তার জায়েদুল করিম।
বিয়ের দিন লাখ টাকার আতশবাজী পোড়ালেন আহমেদুল করিম । বর আসতেই আকাশে নানা বর্ণের আলোর খেলা ... তখনও তিনি জানতেন না বিয়ের ঠিক দু মাস পর রওনক-এর এক দেওর তার মেয়ের মুখটা অ্যাসিড ছুড়ে ঝলসে দেবে।
মেয়েকে অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে .... এ সংবাদ শোনার পর জ্ঞান হারালেন আহমেদুল করিম । ... বাইপাস আগেই একবার হয়েছিল। ... এবারে ধকল আর সইল না ...
মোয়াজ্জেম হোসেন শিপন, বয়স ২৮, বেইলি রোডের এক কফি শপের ম্যানেজার ...সম্পর্কে রওনক-এর স্বামী পারভেজের চাচাতো ভাই। বি.এ পর্যন্ত পড়েছে মোয়াজ্জেম । লম্বা, শুটকো মতন কালো চেহারা, কুঁজো হয়ে হাঁটে ... থাকে মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একটা মেসে । শৈশব থেকেই পারভেজ কে ঈর্ষা করে সে। পারভেজের ভালো সইতে পারত না। পারভেজদের ট্রাভেল এজেন্সির পারিবারিক ব্যবসা ছাড়াও ঢাকা শহরে আরও ব্যবসা আছে। বিয়ের পর পারভেজ থাই ফুডের রেঁস্তোরার মালিকানা পেয়েছে লিখন প্লাজায়। কথাটা শোনার পর মোয়াজ্জেম এর মাথা গরম হয়ে উঠেছে। পারভেজ অনেকটা স্বাধীন। এখানেই কষ্ট মোয়াজ্জেম এর। মেয়াজ্জেমের কফি শপের ম্যানেজারি ভালো লাগে না। তবে সে স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখে। কয়েকবার প্রেম করার চেষ্টা করেছে । অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবন বলে চড় খেয়েছে ... ওদিকে একের পর এক পারভেজের সৌভাগ্যের দরজা খুলে যাচ্ছিল ... অস্ট্রেলিয়ার ভিসাও পেয়ে গেল পারভেজ । ভিসার জন্য অনেক দিন ধরেই ট্রাই করছিল ... এ বছরই রওনককে নিয়ে চলে যাবে সিডনি।
এই তথ্যটি মোয়াজ্জেম কে উন্মাদ করে তুলতে যথেষ্ট ছিল।
প্রথমে ভেবেছিল পারভেজকে খুন করবে। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। আক্রোশ গিয়ে পড়ল রওনকের সুন্দর মুখটির ওপর । বিয়ের সময় রওনককে প্রথম দেখেছিল মোয়াজ্জেম ... তখনই টের পায় পারভেজের বউ দারুন সুন্দরী। বুকের ভিতরে দগদগে ঈর্ষা টের পেয়েছিল। আজ সে ঈর্ষা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ওই ফরসা মুখটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে ইচ্ছে হল। ... অ্যাসিড কোথায় খুঁজে পেল কে জানে। পারভেজরা থাকে ওয়ারি।
ওয়ারির লারমিনি স্ট্রিট। সকালের দিকে তিরিশ বাই সি লারমিনি স্ট্রিটে উপস্থিত হল। নীচতলার গ্যারেজে পারভেজের মোটরসাইকেল দেখেনি। তার মানে পারভেজ বাড়ি নেই। কলিংবেল চাপার পর কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিল। ড্রইংরূমে বসল মোয়াজ্জেম। একটু পর রওনক নিজেই একটা ট্রেতে কেক আর একগ্লাস ট্যাং নিয়ে ঢুকল ড্রইংরুমে। ...
কিছুক্ষণ পর রওনক গরম ফোঁটা টের পেল ওর মুখের ওপর ...
ও জ্ঞান হারায় ...
মোয়াজ্জেম পালিয়ে যায় ...
কোন্ বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই ...
রওনক-এর বিয়ে হয়ে গেলে নিতাইগঞ্জের পথের তালাশ করছিল শওকত।
সে পথে নেমে মধ্যবয়েসি এক কাঙালিনীর সঙ্গে পরিচয় হল তার।
কাঙালিনী রাহিলার বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা। দু’সন্তানের জননী। প্রাক্তন স্বামী সাইফুল্লা চাঁদপুর ঘাটে ইলিশের আড়তের কারবারি ... বিয়ের দশ বছর পর বউকে তালাক দিছে বেঁটে মতন লোকটা। এতে কাঙালিনী রাহিলা ভেঙে পরেনি বরং স্বস্তি বোধ করেছে। সাইফুল্লার নাকি মাজার জোর কম। বাজা মরদ ... সে কথা বলেও বেড়াত রাহিলা। ... তালাকের এও এক কারণ। তো কাঙালিনী রাহিলার তেজ কম না। মেজাজ প্রায় সময় তিরিক্ষি হয়ে থাকে। তবে রাহিলার গানের গলাটি ভালো। জবরদস্ত মুর্শিদী গান গায় সে। কিশোরী বয়েসে বাতাকান্দির আরেফ দেওয়ানের কাছে তালিম নিয়েছিল। তালাকের পর গানের দল গড়ে এখানে-ওখানে গান গেয়ে বেড়াতে থাকে। গান করে আয়-ইনকাম মন্দ না হয় তার। ছেলে দু’টিকে হোমনার এক মাদ্রাসায় রেখে পড়াচ্ছে। বছর তিনেক আগে বড় একটি বজরা নৌকা কিনেছে। সেই নৌকায় এখন গানের দল নিয়ে কাঙালিনী রাহিলার ঘর-সংসার । এখন একটা লঞ্চ কেনার শখ হয়েছে । সেই ইচ্ছাও মুর্শিদ পূর্ণ করবেন ...
গান গাইতে এসে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জের শিমূলতলী গ্রামের কাজী বাড়িতে শওকতের সঙ্গে দেখা ...
শওকতের শক্ত সমর্থ শরীর ... মধ্যবয়েসী কাঙালিনী রাহিলার দেহে দাউদাউ আগুনের মতো তৃষ্ণা ছড়ায় ... সুকৌশলে শওকতকে নৌকায় ডেকে নেয় তৃষ্ণার্ত কাঙালিনী। শওকতের ঘোর লাগা ছন্নছাড়া জীবন। ওর বুকে একটা অদৃশ্য তীর বিঁধে আছে। সেই তীরের নাম রওনক জাহান...দংশন-জ্বালা নেভাতে নতুন মানুষ খঁজছিল শওকত ... সুতরাং ... কাঙালিনী রাহিলার মেদবহুল শ্যামলা দেহে ডুবে যেতে যেতে টের পায় নিতাই গঞ্জ প্রায় পৌঁছে গেছে ...
মেহেরপুরের ছেলে শওকত । ছেলেবেলা থেকেই টুকটাক ঢোল বাজাতে পারে। কাঙালিনী রাহিলার গানের দলে যোগ দিয়ে নতুন এক জীবনের মৌতাত টের পায় সে ...
রওনক টের পায় কে বা কারা ওর মুখে সুঁই ফোটাচ্ছে। অনবরত। কিংবা বিন্দু-বিন্দু গরম তেল ঢেলে দিচ্ছে অল্প অল্প করে। তীব্র যন্ত্রণা টের পায়। বাঁ পাশের চোখটায় যন্ত্রণা বেশি ...ওই চোখটা আর কোনও দিন দেখবে না নানা রঙের আলো ... মুখে ব্যান্ডেজ ... শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ... অথচ মাথার ভিতরে যেন ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরের আকাশে মেঘ জমে আছে। শওকত উদাত্ত কন্ঠে গাইছে - পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/ পাগল আমার মন জেগে ওঠে। ... চমৎকার গানের গলা শওকতের ... রওনক মুগ্ধ হয়ে শুনত ... আপাদমস্তক ছন্নছাড়া ... তখন ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি বলেই শওকতের প্রেমে পড়ে যায় রওনক ... শওকত শ্যামলা ... চোখে গোলকার ফ্রেমের চশমা ... মাথার চুল পিছন দিকে চূড়ো করে বাঁধা ... গলায় তাবিজ ... বাবা যখন বিয়ের জন্য চাপ দিলেন ... তখন ছন্নছাড়া বলেই বাবার সামনে প্রেজেন্ট করা গেল না বাউলটাকে ... শওকতই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল-ধুরও ... তবুও কেমন স্বপ্নের মতো কাটছিল রওনকের দিনগুলি ... দুঃস্বপ্ন ঘনিয়ে আসার আগে ...
ক’দিন ধরে কাঙালিনী রাহিলার নৌকাটি মেঘনা ঘাটে ভিড়ে আছে।
ক্লান্ত অবসন্ন শওকত নৌকা থেকে নেমে যায় ...মেঘনা পাড়ের মেঘলা হাওয়া ওকে জড়িয়ে ধরে ...বাতাসে টক টক অম্লের গন্ধ পেল সে ... নাকি এও বিভ্রম? গতকাল রাতে ও রওনক স্বপ্ন দেখেছে ...এ বছর একসঙ্গে শিলাইদহে রবীন্দ্রতীর্থে যাওয়ার কথা ছিল ...হল না ... শওকতের পাশে বৃদ্ধ জসিম মোল্লা। বেঁটে মতন, গায়ের রং কালো, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা। মাথায় তালপাখার টুপি, মুখে পাকা দাড়ি। জসিম মোল্লা কাঙালিনী রাহিলার বংশীবাদক। বাড়ি কুমিল্লার বরুরা। তরুণ বয়েসে স্ত্রী মারা গেলে বিবাগী হয়ে যায় ... জসীম মোল্লা মাদারী পীরের মুরিদ। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে মাদারী পীরের মাজার । মাদারী পীরের মুরিদ হলে আর কিছু না হোক- মনে শান্তি থাকে। শওকতেরও মাদারী পীরের মুরীদ হওয়ার ইচ্ছা। শওকত কে নিয়ে যাবে মাদারী পীরের মাজারে। শওকতের হৃদয়েও সুখশান্তি নাই ...
এরা দু’জনই কাঙালিনী রাহিলার দলে আর থাকবে না ঠিক করেছে। কাঙালিনী রাহিলার মেজাজ বড় কড়া। পান থেকে চুন খসলে বাপ-মা তুলে গালিগালাজ করে। তার দলে আর থাকা সম্ভব না। কাল জসিমকে লাথি মেরেছে দর্জাল মহিলা...
হাঁটতে হাঁটতে শওকতের নির্ভার মনে হয়।
সে জানে-সব ঘোরই এক সময় কেটে যায়।
এমন কী রওনক এর ঘোরও ...
পত্রিকা পড়ে সব জেনেছে মোয়াজ্জেম ...রওনক কে সহকারি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে ... একবার হাসপাতালে যেতে ইচ্ছে হল তার ... ক্ষমা চাইতে ... এখন কারও ওপর ঈর্ষা নেই তার ...পৃথিবীর প্রতিটি জীবের জন্য হৃদয়ে প্রবল ভালোবাসা টের পাচ্ছে সে ...বিশেষ করে রওনক-এর জন্য ... রওনক এর বাবার মৃত্যু অপরাধী করে তুলেছে ...মোয়াজ্জেম ইন্ডিয়া পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিল। তবে বর্ডার ক্রশ করার সাহস হয়নি। অ-মিশুক আর অর্ন্তমূখী স্বভাবের জন্য তার আত্মীয়স্বজন তাকে এড়িয়ে চলে। এখানে-ওখানে ফেরার দিন কাটাচ্ছিল। ... পলাতক জীবন আর সহ্য হচ্ছিল না তার। যশোরের নাভারনে এক হোটেলে লুকিয়ে থাকল কিছুদিন। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে ছিল। হোটেলের লোকেরা সন্দেহ করত। তার মনে হচ্ছিল লোকজন আড়াল থেকে তাকে লক্ষ করছে। আত্মহত্যা করার কথাও ভাবল একবার। ব্লেডও কিনে আনল। তবে আত্মহত্যা করার সাহস হয়নি তার ...
রওনককে অ্যাসিড ছোড়ার একুশ দিন পর ঢাকায় ফিরে এসে মতিঝিল থানায় আত্মসমর্পন করে মোয়াজ্জেম ।
কী ঘটেছিল -হাসতে হাসতে বলে ওসির কাছে ... ওসি আজিমউদ্দীনের ভরাট মুখটি গম্ভীর হয়ে ওঠে ...
আলাদত তাকে সোপর্দ করা হলে তিন দিনের পুলিশী হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেয় ...
এখন বিকেল। ...পারভেজ, এই মুহূর্তে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছে। পরনে নীল পাঞ্জাবি, কালো রঙের প্যান্ট। হাওয়ায় উড়ছে চুল। মেইন গেটের বাইরে ঝকঝকে মোটরসাইকেল পার্ক করা। পারভেজের পাশে হাঁটছিল বীথি । পারভেজের দূর সম্পর্কের কাজিন ওই সাতাশ বছরের মেয়েটি ... ফরসা, মাঝারি উচ্চতার আঁটোসাটো শরীর: আজ কমলা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছে বীথি। ফরসা মুখে হেভি মেকআপ। চোখে কালো সানগ্লাস ... বিয়ের আগে পারভেজের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল বীথির। তবে পারভেজের মায়ের কারণেই সে সম্পর্ক বিয়ের দিকে গড়ায়নি। বীথির অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। বীথির স্বামী ইকরামের রিকন্ডিশন গাড়ির ব্যবসা আছে, পুরানা পল্টনে শোরুম। বছর খানেক হল এক এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে গোপন প্রণয়ে মজে আছে। ব্যাপারটা বীথি যথারীতি টের পেয়ে যায়। তবে বীথির পায়ের তলায় মাটি শক্ত। কলাবাগানের কাছে ‘কারিনা বিউটি পারলার’ ছাড়াও লালমাটিয়ায় পৈত্রিক জমিতে ফ্ল্যাট আছে। সে ফ্ল্যাটে বীথিএকাই থাকে । মাস ছয়েক হল ইকরামকে ডিভোর্স দিয়েছে। পারভেজের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলত বীথি। এখন রওনক-এর অ্যাক্সিডেন্টের পর পারভেজকে আবার ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ এসেছে। পারভেজ ভাই কি আর অ্যাসিডদগ্ধ স্ত্রীকে ঘরে তুলবে? মোটর সাইকেলে ওঠার আগে বীথি কথাটা জিজ্ঞেস করে, ডাক্তার কইল রওনকরে রিলিজ দিয়া দিবে। রওনক রে নিয়ে কি করবা ভাবতেছ?
রওনকরে ওর বাবার বাড়ি পাঠায় দিব। বলে মোটর সাইকেল স্টাট দেয় পারভেজ।
ভোর... ফজরের নামাজের পর সেতারা আহমেদ কিছুক্ষণ ছাদে হাঁটেন। বরাবরই তার ভোরের মৃদুমন্দহাওয়ার পরশ ভালো লাগে ... অবশ্য আজকাল টের বাতাসের স্পর্শ টের পাচ্ছেন না। ইদানীং শরীর কেমন অবশ ঠেকে। যে সব প্রশ্ন গত ছাপান্ন বছর ভাবতে হয়নি, সেসব প্রশ্ন নিয়ে এখন গভীর ভাবে ভাবছেন সেতারা আহমেদ। যতই ভাবছেন ততই বুকের ভিতরে গভীর এক শূন্যতার পাখসাট টের পান। ... ছাদজুড়ে টব, টবে ফুলের গাছ। ভোরের বাতাসে সে কারণেই হয়তো মৃদু বাসী সুবাস ছড়ায়। রওনক-এর বিয়ের দিন এখানেই প্যান্ডাল খাটানো হয়েছিল ...
তখন কে জানত ... বিয়েতে অনেক আলো ছড়ালেই বিয়ে সুখের হয় না ...
রওনক-এর গাছপালায় খুব শখ ছিল। নীচতলার বাগান আর ছাদের ফুলগাছ ওই দেখাশোনা করত। ওর বিয়ের পর থেকে ফুলগাছের আর তেমন যতœ নেওয়া হয় না। সেতারা আহমেদ বাড়ির কাজের লোকদের বকে বকে পানি দেওয়াতেন। রওনক - এর বাবার মৃত্যুর পর ছাদটা যেন শুকিয়ে মরে গেছে। শোকে আচ্ছন্ন পরিবারে ফুলগাছ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা নয় ...একদা উজ্জ্বল বর্ণিল ফুলেদের সমারোহ এখন কেমন দগ্ধ মলিন হয়ে গেছে ... যেন নির্মম অ্যাসিড বৃষ্টি হয়েছে ...
রওনক-এর মুখটা যেমন উষ্ণ ক্ষারে ছারখার হয়ে গেছে ...
সেতারা আহমেদ টক টক অম্লের গন্ধ পেলেন যেন ...নাকি এও বিভ্রম? গতকাল রাতেও রওনকের বাবাকে স্বপ্ন দেখেছেন ...এ বছর হজ করার কথা ছিল ...হল না ...সেই কথাই বললেন বোধহয় ...
হঠাৎ রওনক-এর কথা মনে পড়ে গেল তার। মেয়েটার এখন ঘুম ভাঙবে। ওকে ঔষুধ খাওয়াতে হবে। এখনও ব্যথায় গোঙায় মেয়েটি ...জামাই আর আসে না ... টেলিফোন করলেও ধরে না ...পারভেজ আর রওনক এর দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না ... অথচ রওনক-এর মুখে অ্যাসিড ছুড়ল পারভেজেরই আত্মীয় ...বিয়ের কথাও নাকি ভাবছে পারভেজ...গত পরশু একজন উকিল পাঠিয়েছিল ...পারভেজ রওনক কে ডিভোর্স দেবে ... সেতারা আহমেদ একা একা পারেন না ... সেতারা আহমেদ-এর কেবলি মনে হয় বিয়ের পর কোনও কারণে আমি পঙ্গু হয়ে গেলে রওনক এর বাবা কি ফেলে দিত? ... বড় ছেলে হায়দার অস্ট্রেলিয়া থাকে। ওখানে ব্যবসা করে। রওনক-এর বিয়ের সময়ও এল না ... এই দুঃসময়ে কি আর আসবে?
রওনক এর বন্ধুরা আসে মাঝেমাঝে ...রওনক ওদের শওকতের কথা জিজ্ঞেস করে ... ছেলেটাকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ...ছাদের বাতাসে টক টক অম্লের গন্ধটা বাড়ছিল ... দ্রুত পায়ে সিঁড়িঘরের দিকে যেতে থাকেন সেতারা আহমেদ। যেতে যেতে একবার মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন । আরেকবার অ্যাসিড বৃষ্টির সম্ভাবনায় ধীরে ধীরে আলো ফুটে উঠছে সকালের পোড়াটে আকাশে ... যে অ্যাসিড বৃষ্টিতে একটা বাগান আর একটা সংসার ছারখার হয়ে গেছে ...