প্যাগান প্রতীক। ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম সম্প্রসারনের পূর্বে সেখানে প্যাগান ধর্মের চর্চা হত। Pagan শব্দটি লাতিন এবং শব্দটির অর্থ ‘লোকজ’ কিংবা ‘যা স্বাভাবিক ভাবে উৎপন্ন।’ তা সত্ত্বেও খ্রিস্টান পন্ডিতেরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শব্দটি সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়েছে। কেননা-প্যাগান ধর্ম ছিল বহু ঈশ্বরবাদী, নারীপ্রধান এবং প্রকৃতিঘনিষ্ট। সে যাই হোক। প্রত্ন প্রস্তর যুগ থেকেই ইউরোপে প্যাগান ধর্মের চর্চা শুরু হয়। যে ধর্মীয় কৃত্যের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করত ... পরবর্তীকালে যে স্বাভাবিক সম্পর্কটি প্রকৃতি-বিমূখ শাস্ত্রীয় অনুশানের আগ্রাসনে দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল...প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব অনুভূত হওয়ায় পরবর্তীকালে, বিশেষ করে কুড়ি শতকে ইউরোপের প্যাগান ধর্মের পুনুরুত্থান ঘটে-যা ‘নিউ-প্যাগান রিলিজিয়ন’ বলে পরিচিত... এই ‘নিউ-প্যাগান রিলিজিয়ন’-এর মধ্যে ইউকা অন্যতম ...
জেরাল্ড গার্ডনার (১৮৮৪-১৯৬৪) ব্রিটিশ লেখক ও মরমী। উইকা ধর্মের পুরুত্থানের জন্য ইনি একক ভাবে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ইংরেজি witch শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে wicca শব্দ থেকে। এটি অনেক পুরনো একটি ইংরেজি শব্দ। উইকা শব্দের প্রকৃত মানে ‘যে জ্ঞানী ’ অথবা ‘যে নিগূঢ় জ্ঞান অর্জন করেছে’। উইকা শব্দটির অন্য অর্থ হল: প্রাচীন প্যাগান ধর্মের উপাসক নারী ও পুরুষ । গার্ডনার সেই প্রাচীন বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছিলেন-যা ছিল নিগূঢ় এবং প্রকৃতি ঘনিষ্ট। গার্ডনার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বহু বছর কাটিয়েছিলেন। মুগ্ধ হয়েছিলেন এশিয়বাসীর নারীবাদী তন্ত্রসাধনায় ও প্রকৃতি সম্পৃক্ততায় । মহামতি বুদ্ধের শিক্ষা তাঁকে শান্তি দিয়েছিল । মূলত ভারতীয় ধর্মের আধ্যাত্বিক দর্শন ও উপাসনার পদ্ধতি তাঁর ধ্যানধারণা আমূল বদলে দিয়েছিল-তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন। ইউরোপের প্রাচীন বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তন জরুরি বোধ করেন গার্ডনার । ইংল্যান্ডে ফিরে এসে উইকার পুর্নজাগরণের জন্য উদ্যেগ গ্রহন করেন। গার্ডনার উইকা ধর্মটিকে বলেছেন: খ্রিস্টান ধর্ম পূর্ব ‘প্যাগান উইচ ক্র্যাফ্ট।’ গার্ডনার এই ধর্মটিকে witchcraft কিংবা witch-cult এবং অনুসারীদের Wica বলে অবহিত করেন।
বর্তমানে তিনি উইকার জনক বলে স্বীকৃত।
উইকা ধর্মটিকে বলা হয় পৃথিবীকেন্দ্রিক ধর্ম। । বাস্তবতা হল পবিত্র ঐশ্বরিক। প্রকৃতি হল জীবন্ত শ্বাসপ্রশ্বাসময় সত্তা। খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে পার্থক্য এখানেই। খ্রিস্টানরা স্রস্টার
উপাসনা করে- উইকারা সৃষ্টির। মানুষের ভিতর এক শাশ্বত দেবীর প্রকাশ দেখে। ধর্মটি বৈশিস্ট্যে নারীবাদী। উইকারা বিশ্বাস করে- পরম সত্তা দেবীর মাধ্যমে প্রকাশিত হন।
উইকা ধর্মে চাঁদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন। এর একটি কারণ ধর্মটি মরমী। চাঁদের কলার ওপর উইকা কৃত্য (রিচুয়াল) নির্ভর করে। পূর্ণচন্দ্র উইকাদের কাছে পবিত্র।
উইকারা ত্রয়ী দেবীর ধারণায় বিশ্বাসী। এই ত্রয়ী দেবী বলতে কখনও একজন দেবীকে বোঝায় কখনও মেইডেন, মাদার এবং ক্রোন-কে বোঝায়। আসলে এই ত্রয়ী দেবী নারীজীবনের এবং একই সঙ্গে চাঁদের বিভিন্ন কলার প্রতীক । উইকা ধর্মটি আসলে নারীবাদী দ্বৈতধর্ম। এদের উপাস্য পুরুষ প্রতিনিধি হল শিংওয়ালা দেবতা। তবে উইকা ধর্মের মূলে রয়েছেন একজন দেবী। তার কারণ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য নারীসুলভ। সৃষ্টি হল চৈতন্যের প্রকাশ। জন্মের মূলে প্রেম। যে কারণে দেবীর অপর নাম শর্তহীন প্রেম । জীবন ও প্রকৃতি পবিত্র। প্রেমের শক্তিই সব কিছুকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
উইকানদের নীতির মূলকথা হল: ‘if it harms none, do as ye Will.’ (যাই কর, তাতে যেন কারু ক্ষতি না হয়।) খ্রিস্টীয় যাজকেরা এদের শয়তানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ আনলেও-উইকারা তা অস্বীকার করে। যদিও তাদের মতে ধর্মীয় সত্য ও মূল্যবোধ আপেক্ষিক। খ্রিস্টানরা যেমন বিশ্বাস করে: “the way and the truth and the life”(John 14:6). উইকারা এরকম কোনও নিরঙ্কুশ নৈতিক বিধানে বিশ্বাস করে না।
উইকা পেন্টাকল বা বাৎসরিক চক্র। উইকা বিশ্বাসের মূলে রয়েছে এ চক্র। চক্রটি জন্ম ও বিকাশের সঙ্গে জীবনের আরও বহুবিধ বিষয় ইঙ্গিত করে।
উইকারা ম্যাজিক চর্চা করে। যেহেতু প্রাচীন প্যাগান ধর্মে ম্যাজিকের চর্চা করা হত। তবে উইকারা শব্দটির বানান এভাবে লেখে- Magick লিখে। এর কারণ ম্যাজিক এদের কাছে বিনোদন নয়-বিশ্বাসের জায়গা। এরা বিশ্বাস করে স্বর্গীয় সুতা দিয়ে মহাবিশ্বকে তৈরি করা হয়েছে। দেবী জাগ্রত। তিনি ম্যাজিকের মাধ্যমে প্রকাশিত হন। দ্য গডেস ইজ অ্যালাইভ। ম্যাজিক ইজ অল অ্যারাউন্ড আস। এটিই উইকা ধর্মের মূলকথা। প্রাকৃতিক রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক ও ভৌত জগতের পরিবর্তনই ম্যাজিকের উদ্দেশ্য । উইকারা বিশ্বাস করে ম্যাজিক চর্চার মাধ্যমে দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ম্যাজিকের উপকরণ হল: মন্ত্র, ক্রিস্টাল বল, ভেষজ লতাপাতা ইত্যাদি। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক- ম্যাজিকচর্চা ধর্মশাস্ত্রে নিষেধ। খ্রিস্টীয় চার্চ মনে করে উইকারা এসব গুপ্তবিদ্যা রপ্ত করেছে শয়তানের কাছ থেকে । এমন কী ভেষজ লতাপাতার জ্ঞানও গির্জের পিতাদের কাছে অগ্রহনযোগ্য। খ্রিস্টানরা কেবল প্রার্থনায় বিশ্বাস করে। যে কারণে উইকানদের ম্যাজিক আর প্রকৃতি উপাসনা সন্দেহের চোখে দেখা হয়।
উইকা যাদু। ... স্বর্গীয় সুতা দিয়ে মহাবিশ্বকে তৈরি করা হয়েছে। দেবী জাগ্রত। তিনি ম্যাজিকের মাধ্যমে প্রকাশিত হন। দ্য গডেস ইজ অ্যালাইভ। ম্যাজিক ইজ অল অ্যারাউন্ড আস। এটিই উইকা ধর্মের মূলকথা।
একটি উইকা মন্ত্রে বলা হয়েছে -
Red leaves, gift from earth,
Birth to death and death to birth,
Keep all evil far away,
Day to night and night to day.
রক্তিম পত্রালি, ধরণীর উপহার
জন্ম মৃত্যুর তরে, আর মৃত্যু জন্মের তরে
যা কিছু অশুভ দূরে থাক
দিন থেকে রাতে আর রাত থেকে দিনে।
এই মন্ত্রে যেন উইকার সবটুকু উঠে এসেছে।
এক তরুণির গলায় উইকা উলকি।
বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় উইকার অনুসারীর সংখ্যা নাটকীয় হারে বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণিদের মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে এর তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত: খ্রিস্টীয় paternalism (এর অর্থ: কোনটা ভালো তা বলে দেওয়া।) দ্বিতীয়ত: খ্রিস্টীয় সমাজে সমকামভীতি এবং তৃতীয়ত: খ্রিস্টীয় শাস্ত্রে প্রকৃতির প্রতি সহানুভূতির অভাব। এ ছাড়া তরুণেরা মনে করে- উইকাদের শয়তান মন্ত্র উচ্চারণকারী বলাটা ভুল। এর কারণ দুটি ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ন পৃথক। এরপরও উইকাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত ধর্মের বিদ্বেষ অব্যাহত রয়েছে।
উইকা দেবীকে এভাবে কল্পনা করা হয়েছে
মারগট এডলার নামে একজন উইকা আত্মপক্ষ সমর্থ করে বলেন ...আমরা অশুভ নই। আমরা কখনোই মানুষকে কষ্ট দিই না বা প্ররোচিত করি না। আমরা বিপদজনক নই। আমরা তোমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। আমাদের পরিবার আছে, চাকরি আছে, আশা এবং স্বপ্ন আছে। আমরা কাল্ট (cult) নই। আমাদের ধর্মটি পরিহাসও নয়। আমাদের সম্বন্ধে টিভি দেখে তোমরা আমাদের যা ভাবছ আমরা তা নই। আমরা বাস্তব। আমরা হাসি। আমরা সিরিয়াস। আমাদের রসবোধও আছে। আমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। আমরা তোমাকে ধর্মান্তরিত করতে চাই না। এবং দয়া করে আমাদের ধর্মান্তরিত করার চেস্টা করো না। আমাদের একই অধিকার দাও- যে অধিকার আমরা তোমাদের দিয়েছি। শান্তিতে বসবাস করার অধিকার। আমরা আসলে তোমাদের মতোই ...
রক্তিম পত্রালি, ধরণীর উপহার
জন্ম মৃত্যুর তরে, আর মৃত্যু জন্মের তরে
যা কিছু অশুভ দূরে থাক
দিন থেকে রাতে আর রাত থেকে দিনে।
গোড়ায় বলেছিলাম যে ... প্রত্নপ্রস্তর যুগ থেকেই ইউরোপে প্যাগান ধর্মের চর্চা শুরু হয়। যে ধর্মীয় কৃত্যের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করত ... পরবর্তীকালে যে স্বাভাবিক সম্পর্কটি প্রকৃতি-বিমূখ শাস্ত্রীয় অনুশানের আগ্রাসনে দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল...প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব অনুভূত হওয়ায় পরবর্তীকালে, বিশেষ করে কুড়ি শতকে ইউরোপের প্যাগান ধর্মের পুনুরুত্থান ঘটে-যা ‘নিউ-প্যাগান রিলিজিয়ন’ বলে পরিচিত... যে ধর্মটি সম্বন্ধে একজন মার্কিন আদিবাসী নারী বলেছিলেন: "If you take [a copy of] the Christian Bible and put it out in the wind and the rain, soon the paper on which the words are printed will disintegrate and the words will be gone. Our bible IS the wind and the rain."
মধ্যযুগ হলে এই কবিকে পুড়িয়ে মারা হত!
তথ্যসূত্র:
Click This Link
http://www.witchway.net/wicca/what.html
http://www.everythingunderthemoon.net/
Click This Link