বেলা দুটোর মতো বাজে। কড়া রোদে পুড়ছে শহরটা । কলেজ থেকে ফিরছিল মুক্তি। হাঁটতে- হাঁটতে অনেকটাই ঘেমে গিয়েছিল ও । ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। সামনেই হাতের বাঁয়ে একটা কনফেকশনারি। এক বোতল ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটার কেনার জন্য সেদিকে যেতেই নিজের অজান্তে থমকে দাঁড়াল মুক্তি; সারা শরীরে এক ঘিনঘিরে অনুভূতি ছড়িয়ে যায়। কনফেকশনারির ঠিক সামনে খাকি রঙের টিশার্ট আর ক্যাপ পরে মোটর সাইকেলের ওপর বসে আছে আয়ুব । চোখে নীল সান গ্লাস। এলাকার উঠতি মাস্তান আয়ুব । মধুবাগের দিকে থাকে। রেললাইন ক্রশ করে মাঝেমধ্যে এদিকে চলে আসে। সাদা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা একটি মেয়ে এদিকেই আসছে দেখে মুখচোখ শক্ত হয়ে ওঠে মুক্তির । মেয়েটির হাঁটার ভঙ্গি কেমন জড়োসরো। আজকাল মেয়ের উত্ত্যক্ত করার মতো ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে।
আয়ুব অবশ্য আপত্তিকর আচরণ করল না। মাথা নীচু করে মেয়েটি চলে যায়।
মুক্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
বাড়ি ফিরে বাথরুমে ঢুকল মুক্তি। তারপর গোছল সেরে খেতে বসল। ভাত মাখতে মাখতে বলল, মা, আজ মুগ ডাল রানছ। এক বাটি লোকমান চাচার জন্য নিয়া যাই।
মা খুশি হয়ে বলল, হ যা। তর লোকমান চাচায় মুগের ডাল খুব পছন্দ করে। আর শোন, আমার মাথা ব্যথার কথা তোর চাচারে বলিস।
আচ্ছা, বলব।
লোকমান চাচার বাড়ি কাছেই। মোমেন আলী স্কুলের পাশের গলিতে একটা হলুদ রঙের দোতলা মেটারনিটি ক্লিনিকের উল্টোদিকে। রংচটা দেয়াল, টিনের গেট। গেটের পাশে বড় একটি আমলকি গাছ, ভিতরে অনেক খানি জায়গা জুড়ে বাগান। বাগানে ঔষধি গাছও আছে। হারবাল চিকিৎসা করেন লোকমান চাচা । বিকেলের দিকে গলির মুখে স্বদেশ ঔষধালয়ে বসেন । গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত পথটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। পথের
দু’পাশে পাতাবাহার গাছ, মেহেদি আর করমচার ঝাড়; বাঁ পাশে একটা হরবরি গাছ। বাড়ির পিছনে ঝাঁকড়া কামরাঙা গাছও চোখে পড়ে। মুক্তি জানে এ জমির ওপর ল্যান্ড ডেভোলাপারদের লোভী চোখ পড়েছে। লোকমান চাচা বলেন, আমার জান থাকতেও তাগোর হাতে আমার বাগান তুলে দিমু না। এই বাগানের লতাপাতা দিয়া কতজনের উপকার হয়।
টিনসেডের বাড়িটি একতলা । সামনে লাল রঙের চওড়া বারান্দা। লোকমান চাচা এখানেই সকাল বেলায় বেতের চেয়ারে বসে পেপার পড়েন, চা খান; পাশে ক্রাচ। মুক্তি ওর নকিয়ায় এরকম দৃশ্যের অনেকগুলি ছবি তুলে রেখেছে ।
লোকমান চাচা মুক্তির বাবার ছোটবেলার বন্ধু। মুক্তির জন্মের পর নামটি তিনিই রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভৈরব-এর কাছে এক অপারেশনের সময় বাঁ পা হারান। হাঁটার সময় ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন লোকমান চাচা । লোকমান চাচার কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনে মুক্তি। সে ইতিহাস ওকে যেমন ব্যথিত করে, তেমনি অহঙ্কারীও করে তোলে। লোকমান চাচা বলেন, আমাগো মা-বোনদের বেইজ্জতী করছিল পাক জানোয়ারগুলি। প্রতিশোধ নিতে আমরা ঝাঁপায় পড়ছিলাম। কই, তারা আমাদের আটকায়া রাখতে পারল? না। আমরা দেশ স্বাধীন করলাম।
শুনতে- শুনতে শিহরিত হয় মুক্তি।
দরজা ভেজানো ছিল। বসার ঘরে ঢুকতেই শুকনো শিকড়বাকরের গন্ধ পেল। জানালা দিয়ে হু হু করে রোদ ঢুকছে। এক কোণে পুরনো সোফা। লাল রঙের মেঝের ওপর চট পেতে বসে হামাম দিস্তায় হরীতকী গুঁড়ো করছিলেন মমতাজ চাচী । মমতাজ চাচীর পাশে একটা খবরের কাগজের ওপর মেথি আর শুকনো জলপাই। পায়ের শব্দে একবার মুখ তুলে তাকালেন । এই বয়েসেও কী শক্ত সমর্থ চেহারা। ঔষুধ তৈরিতে লোকমান চাচাকে সাহায্য করেন চাচী । ফরসা, ভরাট গোলপানা মুখ। চোখে চশমা।
মেঝের ওপর ডালের বাটি নামিয়ে চাচীর মুখোমুখি বসল মুক্তি । জিজ্ঞেস করল, চাচা কই গো চাচী?
তোর চাচার শরীর ভালো না রে মা। ঘুমায়।
ও। মুক্তি বিষন্ন বোধ করে। ওর বাবা দু’বছর আগে মারা গেছে। এখন চাচারও কি যাওয়ার সময় হল? এত ভালো মানুষ। এই বৃদ্ধ বয়েসে পাড়ার অভিভাবক। কত লোকের ফ্রি চিকিৎসা করেন।
চাচী জিজ্ঞেস করলেন, তোর মা কেমন আছে রে মুক্তি?
ভালো না।
কি হইছে?
মাথার যন্ত্রণা।
ডাক্তার দেখাইছোস?
না।
কেন?
মা ট্যাবলেট খাইতে চায় না।
মাথার যন্ত্রণা। তর চাচারে ক।
সেই জন্যই তো আইলাম।
বাটির দিকে তাকিয়ে চাচী জিজ্ঞেস করলেন, তোর মা কি পাঠাইছে রে?
মুগডাল।
যা রান্নাঘরে গিয়া রাইখা আয়। মর্জিনার জ্বর। আজকে আসে নাই।
বাটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল মুক্তি।
শোন।
কি?
বেলের মোরব্বা করছিলাম। নিয়া যা। দেখ, রান্নাঘরের টেবিলের ওপর ঢাকা দেওয়া আছে।
ডালের বাটি নিয়ে রান্নাঘরে যায় মুক্তি। ঘরটায় কেমন যেন পুরনো ষষ্টিমধুর গন্ধ ছড়ানো। ডালটুকু অন্য একটা বাটিতে ঢেলে রেখে বাটি ধুয়ে নিল। টেবিলের ওপর একটা বাটিতে বেলের মোরব্বা ছিল। তার খানিকটা নিল। এই কেক-কাস্টাডের যুগে এই জিনিস আর কেউ করে না। এসব তৈরি করতে অনেক খাটতে হয়। আজকাল কেউ খাটতে চায় না। সব রেডিমেইড চায়। মুক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
একবার উঁিক শোওয়ার ঘরে মারল মুক্তি। বিছানার ওপর কাত হয়ে লোকমান চাচা ঘুমাচ্ছেন। ফরসা মুখ ভরতি সাদা দাড়ি।
বসার ঘরে ফিরে এসে মুক্তি বলল, চাচার হঠাৎ কি হইল চাচী?
সকালে লোকজন আসছিল, তারা এই জমি চায়, অনেক টাকা দিব কইল। তাগো লগে তোর চাচার চিৎকার ঝগড়াঝাঁটি।
ওহ্ । ডেভেলাপারদের ওপর রাগ হল মুক্তির। সাধে এদের বলে ভূমিদস্যু। একজন ইচ্ছে করলে জমি দেবে না-সেজন্য জোরজবস্তি কেন!
আমি এখন যাই গো চাচী।
তোর মায়ের অষুধ নিবি না?
থাক। চাচা এখন ঘুমাক। আমি পরে আবার আসব।
আসিস তাইলে।
মাথা নেড়ে বেরিয়ে যায় মুক্তি। রাস্তায় বেরুতেই মেঘে ঢেকে গেল আকাশ। বাতাসও ধূলো ওড়াচ্ছে। বৃষ্টি হবে নাকি? বেলী লাইব্রেরির উলটো দিকে রেখাদের বাড়ি। অনেক দিন রেখাদের বাড়ি যাওয়া হয় না। রেখার বান্ধবী ছিল মুক্তির ছোট বোন সেতু। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় ডেঙ্গু জ্বরে মরে যায় সেতু । রেখা এবার ক্লাস টেনে উঠল। সেতু বেঁচে থাকলে ক্লাস টেনে উঠত। মুক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
রেখাদের বাড়িটা দোতলা। মুক্তি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল।
রেখার মা মিনু মাসী দরজা খুললেন। মুক্তিকে দেখে বললেন, আয় রে মা লক্ষ্মী।
মুক্তি হাসল। মিনু মাসী মুক্তিকে মা লক্ষ্মী বলে ডাকেন। সম্ভবত ডাগর চোখের শ্যামলা রঙের মুখটি ভারি মিষ্টি বলেই।
মুক্তি ভিতরে ঢুকল। মধ্যবিত্তের বসার ঘর। সাদা চুনকাম করা দেয়াল। দেয়ালে বাংলা ক্যালেনডার , রাধাকৃষ্ণের একটা রঙীন যুগল ছবি। এক কোণে একটা প্যানাভিনশন টিভি সেটা। সাদা কাভারে ঢাকা হারমোনিয়াম।
তর হাতে কীসের বাটি রে মা লক্ষ্মী?
লোকমান চাচার বাড়ি গেছিলাম মাসি। আম্মা মুগডাল দিছিল। সোফায় বসতে বসতে মুক্তি বলল।
লোকমান ভাইয়ের শরীর কেমুন? সোফায় বসতে বসতে মিনু মাসী জিজ্ঞেস করলেন।
ভালো না।
ক্যান কি হইছে?
কী সব জমি নিয়া গন্ডগোল।
হায় রে, এত ভালো মানুষ। তার এই বিপদ। মিনু মাসী আক্ষেপের সুরে বললেন।
মুক্তি চুপ করে থাকে। সবাই বলে লোকমান চাচা ভালো মানুষ। কিন্তু, কেউই লোকমান চাচার সংসারের অভাবের কথা জিজ্ঞেস করে । একজন পঙ্গু মানুষ কী ভাবে সংসার চালাচ্ছেন, সেই খবর কেউই নেয় না। কবিরাজী করে সংসার টানছেন চাচা, দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এই মানুষই দেশ স্বাধীন করতে চল্লিশ বছর আগে জীবন বাজী রেখেছিলেন। কয়েক দিন আগে কলেজে নাজমূন নাহার ম্যাডাম বলছিলেন, পৃথিবীর ভালো মানুষদের প্রতি ভাগ্য যেন নির্মম আচরণ করে। ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেলের কথাই ভাব। ওই দয়ালু নারীটি সারা জীবন মানুষের সেবা করেছেন -কী লাভ হল? শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে গেলেন।
মুক্তি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। সেতু বেঁচে নেই, রেখা বেঁচে আছে। এও কি নিয়তি?
মুক্তি জিজ্ঞেস করে, রেখা কই মাসী?
মিনু মাসী বললেন, বীণায় গতকাল শ্বশুরবাড়ি থেকে বেড়াইতে আসছে। তার লগে তালতলা মার্কেটে গেছে রেখা।
ও।
মিনু মাসী বললেন, রেখায় স্কুলে যায় না রে মা লক্ষ্মী।
স্কুলে যায় না? ক্যান? মুক্তি অবাক।
মিনু মাসী বললেন, কথাটা রেখারে জিজ্ঞাস করি, বলে না, বলে না। পরে আমার ছোট ভাই জয়ন্তরে আইতে কইলাম।জয়ন্ত যাত্রাবাড়ি থাকে। অনেক জোরাজুরি শেষে রেখায় জয়ন্তর কাছে কইল- মধুবাগের জিন্নার পোলা আয়ুব-এ স্কুলে যাইতে আসতে রেখারে জ্বালায়, আজেবাজে প্রস্তাব দেয়। কও তো মা-আমরা এখন কি করি। আইয়ুবে আমাগো বাড়ি সামনে টহল মারছে কয়েক দিন।
মুক্তির সারা শরীরে হিমস্রোত বয়ে যায়। কনফেকশনারির সামনে মোটর সাইকেলের ওপর কালো টিশার্ট পরে আয়ুবের বসে থাকার দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। একটি মেয়ে কনফেকশনারির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটির হাঁটার ভঙ্গি কেমন জড়োসরো। শরীরে ক্রোধ টের পায় মুক্তি। রেখা যদি আত্মহত্য করে বসে? এই অপ্রীতিকর ভাবনা পেয়ে বসে ওকে। দেশে ইভ টিজিং বা উত্ত্যক্ত করার মতো ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। উৎকণ্ঠিত অভিভাবকরা এখন শুধু তাদের স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গামী মেয়েকে নিয়েই চিন্তিত নন, নিজেদের জীবন নিয়েও শঙ্কায়। ভয়-ভীতি নিয়ে এক রকম বিভীষিকার জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ভয়াবহ এই ব্যধি ঠেকানো যাচ্ছে না। দেশের প্রচলিত আইন দিয়ে এই প্রবণতা ঠেকানো যাবে না। এমনটাই মনে করেন দেশের বিশেষজ্ঞ মহল।
কয়েকদিন আগে কলেজের সামনে ইভ টিজিং বিরোধী মানববন্ধন করেছিল মুক্তারা। খাকি রঙের টিশার্ট আর ক্যাপ পরে মোটর সাইকেলে করে কয়েকবার চক্কর মেরেছিল আয়ুব । চোখে নীল সান গ্লাস। ভাবটা এমন -আমি এই এলাকার রাজা-বাদশাহ, আমার যা খুশি আমি করব, দেখি তোমরা কী করতে পার। মানববন্ধন শেষে কলেজের মাঠে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় শিক্ষা সচিব প্রধান অতিথি ছিলেন । নাজমূন নাহার ম্যাডাম তাঁর ভাষনে বললেন, মাননীয় সচিব মহোদয়, অমি মনে করি, ইভ টিজিং শব্দটা তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ইভ টিজিং শব্দটা অনেক সফট, অনেক নমনীয়, অনেক রোম্যানটিক। কাজেই ইভ টিজিং না বলে ‘যৌন হয়রানি’ বলা উচিত, এতে উদ্ভূত অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্দি করা সহজ হবে। আর যারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে তাদের যৌনসন্ত্রাসী বলা হোক।
উপস্থিত ছাত্রীরা তুমুল করতালি দিয়ে নাজমূন নাহার ম্যাডামের বক্তব্যকে স্বাগত জানায়।
নাজমূন নাহার ম্যাডাম মুক্তিকে øেহ করেন। তিনি মুক্তিকে আগেই বলে রেখেছিলেন, তুমি কিন্তু প্রতিবাদ সভায় কিছু বলবে সালমা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ছাত্রীদের বক্তব্য শোনাও দরকার।
মুক্তি বলল, আমি কেবল একটা কথাই বলব-যারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে তারা মানুষ না, তারা অমানুষ, তারা জানোয়ার। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যে জানোয়ারদের আমাদের বাপ-চাচারা জীবন বাজী রেখে পরাজিত করেছিল। এবার আমরাও সম্মিলিত ভাবে এইসব অমানুষ জানোয়ারদের পরাজিত করবই করব।
তুমুল করতালিতে চারিদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল।
স্বয়ং সচিব মহোদয়কে উত্তেজিত হয়ে করতালি দিতে দিতে উঠে দাঁড়াতে দেখা গেল।
পরদিন বিকেলে মায়ের মাথার যন্ত্রণা বেড়ে গেল। চিন্তিত হয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল মুক্তি। সাড়ে চারটার মতো বাজে। লোকমান চাচা এখন বাড়ি থাকবে না মনে হয়। ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বদেশ ঔষধালয়ের দিকে হাঁটতে থাকে । গতকাল লোকমান চাচার শরীর খারাপ ছিল। আজ কি লোকমান চাচা বেরুতে পারবেন। খানিকটা উদ্বেগ ওকে ঘিরে রাখল।
বিকেলের ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে ছিল। গলিতে রিক্সা, ভ্যান ও সিএনজির ভিড়।। মুক্তি দ্রুত হাঁটছে। আজকাল গলিতেও জ্যাম হয়। এদিকে একটা রেলক্রসিং আছে। গেট পড়ে গেলে জ্যাম হয়। স্বদেশ ঔষধালয়ের ঠিক উলটো দিকে এই এলাকার বিখ্যাত রহমানিয়া রেস্তঁরা। বাতাসে ভাজা মাংসের গন্ধ ভাসছিল। সেই গন্ধের সঙ্গে মিশেছে ডিজেলের গন্ধ।
স্বদেশ ঔষধালয়ে ঢুকে আরকের গন্ধ পেল মুক্তি। লোকমান চাচা কে বসে থাকতে দেখে স্বস্তি পেল। চাচার পাশে ক্রাচ। পিছনে দু’তিনটি কাঠের আলমারী। আলমারীর তাক ভর্তি হার্বাল ঔষধের বাক্স, ও নানা আকারের শিশি-বোতল।
আয় রে মুক্তি। বস।
দু-তিনটি কাঠের চেয়ার পাতা। মুক্তি বসল।
লোকমান চাচা জিজ্ঞেস করলেন, কাল বাসায় গেছিলি নাকি?
হ, চাচা। তোমার শরীর এখন কেমন?
আইজ ভালো। তোর চাচী কইল তোর আম্মার নাকি মাথার যন্ত্রণা হয়।
হ চাচা।
কি ট্যাবলেট খাইছে তোর মায়ে?
আম্মায় ট্যাবলেট খাইতে চায় না।
বুঝছি। বলে ঘুরে পিছনের তাক থেকে একটা শিশি বার করলেন। বললেন, মাথায় যখন বেদনা হবে এই শিশির মুখ খুইলা তোর মায়েরে নস্যি নিতে বলবি। মাথার যন্ত্রণা কমব।
শিশি নিয়ে মুক্তি জিজ্ঞেস করে, নস্যি নিব। এইটায় কি আছে চাচা?
লোকমান চাচা হাসলেন। বললেন, শুকনো বকুল ফুল চূর্ণ আর ফিটকিরি চূর্ণ- বৃদ্ধের কথা শেষ হল না। তিনি গর্জে উঠলেন-হারামজাদা! জানোয়ার! বলে ক্রাচ টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
মুক্তিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল। খাকি রঙের শার্ট পরে রহমানিয়া রেস্তঁরার সামনে মোটর সাইকেলের ওপর বসে আছে আয়ুব । মুক্তির বুকটা হিম হয়ে আসে। মোটর সাইকেলের ঠিক সামনে নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা পনেরো-ষোল বছরের একটা মেয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ফুলে ফুলে কাঁদছিল। আয়ুব মনে হয় মেয়েটার গালে থাপ্পড় মেরেছে। সম্ভবত আয়ুব মেয়েটাকে আপত্তিকর কিছু বলেছিল। তারই প্রতিবার করেছিল মেয়েটা; থাপ্পড় মারার দৃশ্যটা সম্ভবত লোকমান চাচা দেখে ক্রোধে জ্বলে উঠেছেন।
এই মুহূর্তে গলিটা ফাঁকা। লোকমান চাচা রাস্তার মাঝখানে পৌঁছে গেছেন। উলটো দিক থেকে একটা কাগজ ভর্তি ভ্যান আসছিল। ভ্যানের ধাক্কায় লোকমান চাচা রাস্তার ওপরই পড়ে গেলেন। হাত থেকে ক্রাচ ছিটকে যায়। আশেপাশের লোকজন প্রথমে হই হই করে ওঠে। তারপর ছুটে আসে।
মুক্তি দৌড়ে রাস্তায় নেমে আসে।
আহত লোকমান চাচার দিকে না তাকিয়ে উবু হয়ে হাতে ক্রাচ তুলে নেয়। তারপর বেপরোয়া ভঙ্গিতে আয়ুবের দিকে দৌড়ে যেতে থাকে। মুক্তির হিঃস্র মূর্তি দেখে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ওঠে আয়ুব; মোটরসাইকেল থেকে দ্রুত নেমে পালাতে যাবে-টাল সামলাতে না পেরে রাস্তার ওপর পড়ে যায়। নীল সানগ্লাসটা ছিটকে যায়।
এরপর ঘটনা খুব দ্রুত ঘটল।
অপমানিত মেয়েটির বিস্মিত দৃষ্টির সামনে ক্রাচ তুলে পড়ে থাকা আয়ুবের মাথা বরাবর তাক করে মুক্তি-আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যেভাবে বাংলার মাটিতে পড়ে থাকা পাক জানোয়ারদের মাথার ওপর মুক্তিযোদ্ধারা তাক করেছিল রাইফেলের বাট...