আথিনা। এথেন্স নগরের রক্ষাকর্ত্রী দেবী; যে এথেন্স এককালে হয়ে উঠেছিল গ্রিক সভ্যতার কেন্দ্র, যে এথেন্সের দর্প চূর্ন করেছিল প্রতিশোধপরায়ণ পারস্য (৪৮০ খ্রিস্টপূর্ব): ধ্বংস করেছিল এথেন্স শহর, ধ্বংস করেছিল অ্যাক্রোপলিসের উপর অবস্থিত দেবী আথিনার সুপ্রাচীন উপাসনালয়টি। প্লেরিক্লিসীয় স্বর্ণযুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬১-৪২৯) নতুন করে নির্মিত হয়েছিল দেবী আথিনার মূর্তি। কেননা, পারস্যের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিল এথেন্স- আর সে জয়ের কৃতিত্ব বর্তেছিল যুদ্ধ বিজয়ের দেবী আথিনার ওপর । দেবী আথিনার প্রতীক হল পেঁচা, জলপাই গাছ, সাপ, ঢাল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ ও বর্শা। রোমান উপকথায় ইনিই মিনার্ভা নামে পরিচিত।
এথেন্সের মানচিত্র। আথিনা এথেন্স নগরের রক্ষাকর্ত্রী দেবী; পুরুষ দেবতা পোসেইদোনকে পরাজিত করে এই মর্যাদা লাভ করেছিলেন আথিনা।
দেবী আথিনার জন্মকাহিনীটি কিন্তু ভারি বিচিত্র। প্রজ্ঞার দেবী মেটিস ছিলেন জিউসের প্রথমা স্ত্রী। মেটিস গর্ভবতী হলে জিউস আতংকিত হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে- প্রজ্ঞার দেবী বলেই মেটিস হয়তো এমন ছেলের জন্ম দেবে যে ছেলে ক্ষমতায় জিউসকে ছাড়িয়ে যাবে। এই আশংকায় মেটিসকে গিলে ফেলেন জিউস! জিউসের ভিতরে মেটিস আলখাল্লা ও শিরস্ত্রাণ তৈরি করতে থাকে। এতে জিউসের প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হয়। তখন কামার দেবতা (জিউসপুত্র) হেফেস্টাস হাতুরির আঘাতে পিতার খুলি ফাটিয়ে ফেলে। জিউসের ভাঙা মাথা থেকে আলখাল্লা ও শিরস্ত্রাণ পরা পূর্ণবয়স্কা আথিনা বেরিয়ে আসে।
সমুদ্র দেবতা পোসেইদোন; সম্পর্কে জিউসের ভাই।
এবার বলি আথিনা কী ভাবে এথেন্স নগরের রক্ষাকর্ত্রী দেবী হলেন। এথেন্স নগরের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে সমুদ্র দেবতা পোসেইদোন-এর সঙ্গে আথিনার বিরোধ বাধে। ঠিক হল: যিনি নগরবাসীকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দিতে পারবেন তিনিই হবেন নগরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক; নগরবাসী মিছিল করে দু’জনকে অ্যাক্রোপলিস নিয়ে যায়। সমুদ্র দেবতা পোসেইদোন অ্যাক্রোপলিসের কিনারায় ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করলেন। ঝর্নার জল উৎসারিত হল । সমবেত জনতা হর্ষধ্বনি করে ওঠে। তবে সে ঝর্নার জল লোনা বলেই জনতার উত্তেজনা ক্রমশ থিতিয়ে আসে। আথিনা এথেন্সবাসীকে উপহার দিলেন একটি জলপাই গাছ। জলপাই গাছ থেকে ফল -তেল -কাঠ পাবে বলে জনতা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং আথিনাকে এথেন্স নগরের রক্ষাকর্ত্রী দেবী হিসেবে মেনে নেন। এরপর থেকে এথেন্স নগরীর রক্ষাকর্ত্রী দেবী হলেন আথিনা। আথিনা নগরের নাম রাখলেন এথেন্স।
অ্যাক্রোপলিস। এথেন্স নগরের কাছে একটি উচুঁ পাহাড়; নগরদূর্গ। পার্থেননটি এখানেই অবস্থিত। পার্থেনন মানে ‘কুমারী ভবন’। এই পার্থেননে এককালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেবী আথিনার মূর্তি।
পারসিক আক্রমনের সময় (৪৮০ খ্রিস্টপূর্ব) পারস্য সম্রাট জেরেক্সেস পার্থেনন পুড়িয়ে ফেলেছিলেন । গ্রিকরা সালামিসের যুদ্ধে পারস্যকে পরাজিত করে। আথিনা যুদ্ধ জয়ের দেবী। কাজেই আথিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাসরূপ এথেন্সবাসী অ্যাক্রোপলিসের ওপর Parthenon নির্মাণ করে এবং পার্থেননে দেবী আথিনার একটি মূর্তি তৈরি করে। ৪৪৭ খ্রিস্টপূর্বে পার্থননের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ৪৩৮ খ্রিস্টপূর্ব। প্রাচীন গ্রিসে তিন ধরণের স্থাপত্য রীতি ছিল । (ক) লোনিক, (খ) করিন্থিয়ান এবং (গ) ডোরিক; ডোরিক রীতিতে তৈরি হয় পার্থেনন-এর অভ্যন্তরের নতুন দেবীমূর্তিটি। মূর্তিটি “আথেনা পারথেনস” নামে পরিচিত। ভাস্করের নাম ফিদিয়াস (৪৮০-৪৩০ খ্রিস্টপূর্ব) । ফিদিয়াস ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান একজন ভাস্কর।
আথিনা। প্রজ্ঞা, সামরিক বিজয় ও চারুকলার দেবী; যিনি আবিস্কার করেছিলেন বাঁশী, ট্রাম্পেট, মাটির পাত্র, লাঙ্গল, জমি মসৃন করবার মই, ষাঁড়ের জোয়াল, ঘোড়ার লাগাম, রথ এবং জাহাজ। সংখ্যার শিক্ষাদাত্রীও আথিনা । এছাড়া সুতাকাটা, তাঁতবোনা এবং রান্নাও আবিস্কার করেছিলেন দেবী।
কখনও দেখা যায় আথিনার নাম লেখা হয় Pallas কিংবা Pallas Athena । এর কারণ কি? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আথিনার মেয়েবেলার দিকে তাকাতে হয়। মেয়েবেলায় (যদিও বলা হয়েছে আথিনার জন্ম পূর্ণবয়স্করূপেই হয়েছিল; গ্রিক পুরাণে স্ববিরোধীতা নতুন কিছু না ...) প্যালাস নামে এক বনদেবী ছিল আথিনার মেয়েবেলার সই। একবার দুজনে মিলে যুদ্ধ -যুদ্ধ খেলছিল। হঠাৎই আঘাত পেয়ে প্যালাস মারা যায়। বিমর্ষ আথিনা সারা জীবন প্যালাস নামটি রেখে দেয়।
গ্রিক দেব জগৎ এর সবাই ভালোবাসত নির্মল আথিনা কে । আথিনাও অন্যদের ভালোবাসত। সে ভালোবাসা ছিল অনেকটা বোনের ভালোবাসার মতো । যৌন সম্পর্কে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না দেবী। বিয়ের অনেক প্রস্তাব ছিল। সবই ফিরিয়ে দিয়েছেন আথিনা ।
অগ্নিদেবতা হেফেস্টাস
কুমারী দেবীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল। তখন ট্রয় যুদ্ধ চলছে। আথিনা দেবকারিগর ও অগ্নিদেবতা হেফেস্টাস কে বলল, আমার বর্ম আর অস্ত্র লাগবে। এর জন্য যা লাগে দেব। অগ্নিদেবতা হেফেস্টাস বলল, আমাকে কেবল প্রেম দিলেই চলবে। কথাটার গভীর মানে বোঝেননি আথিনা। তিনি রাজী হলেন। দেবী যখন বর্ম আর অস্ত্র নিতে এল কামার্ত হেফেস্টাস দেবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। (এতে একেবারে হেফেস্টাস দোষ ছিল না। কেননা, পেসোইদোন এসে বলেছিল আথিনা আসছে। দেখে মনে হল বুনো প্রেম চায়) ...যা হোক ব্যাপাটা হয়নি। উত্তেজিত হেফেস্টাস এর কাছ থেকে আথিনা পালিয়ে গেলেন ঠিকই তবে দেবীর পায়ে বীর্যপাত হয় । উলের কাপড় দিয়ে বীর্য মুছে পৃথিবীতে ফেললেন। এভাবে মাটিতে এক শিশুর জন্ম হল। সে শিশুর নাম রাখলেন Erichthonius. এর মানে পৃথিবীজন্মা!
আথিনা বিনয়ী হলেও মাঝে-মাঝে রেগে যেতেন । একবার টেইরেসিয়াস নামে এক তরুণ লুকিয়ে দেবী স্নান দেখছিল। দেবী শ্রেফ তরুণের চোখে হাত রেখে তরুণকে অন্ধ করে দেন। এতে অবশ্য টেইরেসিয়াস দৈবশক্তি লাভ করে। থিবস নগরে বাস করত টেইরেসিয়াস । পাখিদের লক্ষণ দেখে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারত সে । যাক। দেবী আর্টেমিস হলে তো টেইরেসিয়াস কে মেরেই ফেলত!
আরেকবার। আরাচিন নামে এক লিদিয় রাজকুমারী খুব ভালো তাঁত বুনতে পারত। এত ভালো যে লোকে বলত আথিনার চেয়ে ভালো। কথাটা কানে গেল আথিনার । শ্লেষের সুরে বললেন, “আমি যখন থেকে তাঁত বুনি তখন মানুষের জন্মই হয়নি।”
এই হলেন দেবী আথিনা!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১০ বিকাল ৫:২১