দুপুর বেলা কুণাল দাওয়ার ওপর বসে মুন্ডকোপনিষৎ পড়ছিল। দূর থেকে বাবাকে আসতে দেখল। কুণালের বাবা, আচার্য তারানাথ, সকালবেলায় রাজবাড়ি গিয়েছিলেন। বাবাকে অসুস্থ মনে হল কুণালের। ফরসা মুখটি ফ্যাকাশে ঠেকছে। আচার্য তারানাথ দাওয়ার ওপর বসতে বসতে বললেন, আজ আমার শরীর ভালো ঠেকছে না রে কুনাল । কাল থেকে তুই বরং রাজবাড়ি গিয়ে রাজকন্যাকে পড়াবি। আমি ক’দিন বিশ্রাম নেব।
কুণাল উৎকন্ঠিত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ঠিক আছে বাবা। তুমি ভেব না। আমি কালই যাব।
আচার্য তারানাথ বললেন, রাজবাড়ির দৌবারিক-এর নাম বভ্র“, আমি তাকে তোর কথা বলে এসেছি । সে বাধা দেবে না। রাজকন্যা রোহিণীকেও বলেছি যে আমি ক’দিন আসব না ।
ঠিক আছে বাবা, তুমি এখন বিশ্রাম নাও।
পরের দিন ভোরবেলা। উজ্জয়িনী নগরের রাজপথের এক পাশে দিয়ে হাঁটছিল কুণাল। বাইশ বছরের সুঠাম ও সুদর্শন তরুণ। হাঁটতে হাঁটতে বাবার কথাই ভাবছিল কুণাল । বাবা তারানাথ অবন্তী রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ট আচার্য। উজ্জয়িনী নগরের লোকে শ্রদ্ধা ভরে বলে ‘জ্ঞানসাগর’। কুণালের দীক্ষাগুরু ; কুণালের জীবনের উদ্দেশ্য ব্রাহ্মজ্ঞান লাভ করা। বাবা বলেন: শাস্ত্রগ্রন্থগুলি গভীর ভাবে অধ্যয়ন করলে এবং পান্ডিত্যপূর্ণ দীর্ঘ টীকাভাষ্য রচনা করলে ব্রাহ্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব। সেই বাবা অসুস্থ হলেন। এখন বাবার কিছু হলে সে অথই জলে পড়বে। কাল বিকেলে তারিণী বৈদ্য এসেছিল। লক্ষণ দেখে বললেন: মধুমেহ বলেই মনে হচ্ছে। দু’বেলা দুধসহ শিলাজতু চূর্ন ও সকাল-বিকাল খাওয়ার পর অরিষ্ট তরল সেবন করতে হবে।
পথের পাশে ‘মালাচন্দন’ নামে একটি ফুলের আপণ। আপণটি কুণাল এর বন্ধু মুরলীর। মুরলী আপণের সামনে দাঁড়িয়ে জল ছিটাচ্ছিল। কুণালকে দেখে বলল, এত সকালে এদিকে কই যাচ্ছিস রে কুণাল?
মুরলীকে সব খুলে বলল কুণাল । মুরলী বলল, ভালো। তবে সাবধানে থাকিস রে কুণাল।
কেন? সাবধানে থাকব কেন? কুণালের ভুরু কুঁচকে যায়।
মুরলী বলল, রাজকন্যা রোহিণী রাজবাড়ির মুকুন্দ মালাকরের সঙ্গে গভীর প্রণয়ে লিপ্ত।
যাঃ। তুই কি করে জানলি?
মুরলী বলল, রাজবাড়ির মুকুন্দ মালাকর যে ফুল নিতে নিত্য আমার আপনে আসে। রাজবাড়ির বাগানে কি আর সব ফুল ফোটে রে। বলে চোখ টিপল মুরলী। মরলীই কুণালের বন্ধুদের মধ্যে সব সময় রসে টইটুম্বুর হয়ে থাকে। সেই মুরলী বলল, তুই দেখতে বড় সুদর্শন রে কুণাল, আমার ভয় হয়-এর মধ্যে পড়ে না আবার তুই ফেঁসে যাস । তাই বলছিলাম সাবধানে থাকতে।
কুণাল অবাক হল। রাজকন্যা রোহীণীর বাবা অবন্তী রাজ্যে প্রতাপশালী রাজা প্রভাস। প্রজাহৈতষী ও দানশীল রাজা হিসেবে আর্যাবর্তে বিখ্যাত। তার কন্যার এমন কলঙ্ক? কুণাল বলল, ঠিক আছে রে মুরলী। আমি সাবধানেই থাকব। বলে কুণাল পা বাড়াবে-মুরলী বলল, আর শোন কুণাল। সম্ভব হলে আজ একবার তিলককে দেখতে যাস।
কেন? তিলকের আবার কি হয়েছে? কুণাল অবাক।
মুরলী বলল, তিলক ওর বাবার সঙ্গে তুলা নিয়ে মাহীষ্মতী নগর গিয়েছিল । জানিস তো এ বছর অবন্তীতে ভালো তুলা ফলল। ফেরার পথে নর্মদা নদীতে দস্যু বিকর্ণর কবলে পড়ে সর্বশ্রান্ত হল। তিলকের বাবার তেমন কিছু না হলেও তিলক গুরুতর আহত হয়েছে। দস্যুরা ওকে নারাচ (লোহার বান) দিয়ে আঘাত করেছেন।
বলিস কী!
হ্যাঁ। তাই বলছিলাম- সম্ভব হলে আজ একবার তিলককে দেখতে যাস।
হ্যাঁ, যাব। বলে রাজবাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে কুণাল। তিলকের জন্য দুঃখ হল কুণালের। এক সঙ্গে বিদ্যালয়ে পড়ত। দস্যু বিকর্ণ রাজ্য জুড়ে নানা অঘটন ঘটাচ্ছে। অবন্তীরাজ প্রভাস দস্যু বিকর্ণ কে দমন করতে পারছেন না। দস্যু বিকর্ণর ভয়ে ভীত হয়ে রয়েছে অবন্তীবাসী।
রাজবাড়ির সিংহদুয়ারে যমদূতের মতো দেখতে এক দৌবারিক দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে প্রাস (ছোট বর্শা); এই কি বভ্র“? কুণাল দৌবারিক এর কাছ নিজের পরিচয় দিল। দৌবারিক বলল, হ্যাঁ। আমার নামই বভ্র“; এসো, আমার সঙ্গে এসো।
সিংহদুয়ারের ওধারে উদ্যান। তার ভিতর দিয়ে প্রস্তরময় পথ। দু’পাশে শিংশপা গাছ। রাজপ্রাসাদটি মর্মর পাথরের তৈরি । তার প্রশস্ত সিঁড়ির কাছে এক কঞ্চুকী (অন্তঃপুররক্ষী) দাঁড়িয়ে ছিল। বভ্র“ বলল, এ আচার্যপুত্র। একে উদ্যানগৃহে নিয়ে যাও।
কুণালকে রাজপ্রাসাদের পিছনে উদ্যানগৃহে নিয়ে এল। ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে। কাঠের কারুকাজ করা স্তম্ভবিশিষ্ট উদ্যানগৃটির চারিদিক খোলা। মেঝেটি মসৃন শ্বেতপাথরের । কুনাল মেঝের ওপর পদ্মাসনে বসল। চারিপাশে মনোরম উদ্যান। এই সকালের সোনালি রোদে ঝলমল করছিল। উদ্যানময় সবুজ মুঞ্জ ঘাস ছড়ানো । মাঝখানে একটি ক্ষুদ্র জলাধার। জলাধারে অগুনতি নীল সহস্রার। মকরন্দের সন্ধানে উড়ছিল মধুমাছির দল। বাতাসে দুলছিল সবুজাভ বল্লী। উদ্ভিদের আড়ালে একটি হরিণী ও দুটি ময়ূর দেখা যায়। অদূরে উদ্যানের প্রাচীর ঘেঁষে শাল্মলী বঞ্জুল শমী শিংশপা গাছ।
রাজকন্যা রোহিণী এল। কুণালকে প্রণাম করে অপূর্ব ভঙ্গিতে পদ্মাসনে বসল। একাকী পরমা সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখে কুণাল ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। রাজকন্যার দীপ্র মুখোশ্রী, রক্তিম কপোল, আয়ত চোখ, শ্বেত কনীনিকা দীর্ঘপক্ষ্ম , কাঁচুলির নীচে উচ্ছৃত স্তনের আভাস। নিজেকে কেমন ব্রাত্য মনে হল কুণালের।
রাজকন্যা রোহিণী জিগ্যেস করল, আচার্য কেমন আছে? আশ্চর্য মিষ্টি কন্ঠস্বর। কিন্নরকন্ঠী।
কুণাল বলল, আজ অনেকটা ভালো।
বৈদ্যি এসেছিলেন কি?
হ্যাঁ।
বেশ। শুনুন, আমি কিন্তু আচার্যর কাছে যাজ্ঞবল্ক্যের শুক্লযজুর্বেদ পড়ছি।
জানি। বাবা আমায় বলেছে।
আসলে আমি যাজ্ঞবল্ক্যের শুক্লযজুর্বেদ পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ভাবছি এবার ঋগে¦দের সৌরসূক্ত কাব্য পড়ব। আপনার কি সৌরসূক্ত কাব্য জানা আছে?
হ্যাঁ।
বেশ। তাহলে ঋগে¦দের সৌরসূক্ত সম্বন্ধে যা জানেন আমাকে বলুন।
কুণাল বলতে থাকে, ঋগে¦দের ধর্ম আসলে সূর্যোপসনা। বৈদিক আর্যরা সূর্যের স্তুতি করত। এই স্তুতি গুলিতে ছিল স্বত উৎসারিত আবেগ ।
কুণাল লক্ষ করল রাজকন্যা রোহিণী কথাগুলি ঠিক শুনছিল না। বরং অন্যমনস্ক হয়ে উদ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। জলাধারের পাশে একজন বৃদ্ধ। শুকনো পাতা তুলছিল। মালাকর বলে মনে হল। মুকুন্দ মালাকর কি? পক্ককেশ তামাটে শরীর। খালি গা কেবল ধূতি পরে আছে। এই বৃদ্ধের সঙ্গেই কিনা রাজকন্যা প্রণয়ে লিপ্ত ... কুণালের মনে যে আনন্দের ভাব ছিল- তা মুহূর্তেই বিষিয়ে উঠল।
কয়েক দিন পর। আচার্য তারানাথ সামান্য সুস্থ হয়েছেন। দু-একদিনের মধ্যেই রাজকন্যাকে পড়াতে যাবেন। দাওয়ায় বসে আচার্য তারানাথ বলছিলেন, দেখলি তারিণী বৈদ্য কেমন ধন্বিন্তরী। আমায় সারিয়ে দিল। আসলে পথ্যে রয়েছেন পরম ব্রহ্ম। একে জানাই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। এর জন্য চাই পুরুষকার। শাস্ত্রগ্রন্থগুলি পাঠ করলে ব্রাহ্মজ্ঞানভাব সম্ভব।
কুণাল কি বলতে যাবে- দৌবারিক বভ্র“ এসে উপস্থিত হল। ককর্স কন্ঠে বলল, রাজা এক্ষুণি তোমাদের দুজনকেই রাজবাড়িতে যেতে আদেশ করেছেন।
পিতাপুত্র কৌতূহলী হয়ে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে চলল।
রাজপ্রাসাদের একটি কক্ষে রাজা প্রভাস বসে রয়েছেন। মুখ অগ্নিবর্ণ। আচার্য তারানাথকে লক্ষ করে রাজা প্রভাস বললেন, আচার্য তারানাথ, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। অথচ আপনি আপনার ছেলেকে আমার সর্বনাশ করার জন্য লেলিয়ে দিলেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মহারাজ। আচার্য তারানাথ বললেন।
আপনিই সবই জানেন। রাজা প্রভাস ক্রদ্ধ কন্ঠে বললেন। কাল থেকে আপনার আর আসতে হবে না। আমর কন্যার শিক্ষার জন্য আমি অন্য আচার্য দেখছি।
কারণটা জানতে পারি? আচার্য তারানাথ এর কন্ঠস্বর গম্ভীর।
আপনার ছেলে আমার কন্যাকে প্রণয়ের প্রস্তাব করেছে।
নাহ্ ।
আমি কি মিথ্যে বলব! আমার কন্যা আমাকে আমাকে বলেছে।
কুণাল যা বোঝার বুঝল।
যান আপনি । এখন দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রাজা প্রভাস গর্জে উঠলেন।
ভগ্নহৃদয়ে ছেলের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলেন আচার্য তারানাথ। তারপর প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তারিণী বৈদ্য এলেন। লাভ হল না। দু’দিন পর মারা গেলেন আচার্য তারানাথ।
কুণাল অথই জলে পড়ল। সে উজ্জয়িনী নগর পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল। বাবা যখন আর নেই - তখন আর নগরে বাস করে কী লাভ। এর চেয়ে নির্জন স্থানে গিয়ে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনই শ্রেয় । এখন থেকে কুণাল ব্রহ্মজ্ঞানলাভের জন্য সাধনা করবে। উজ্জয়িনী নগর ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসী হবে।
অবন্তী রাজ্যের দক্ষিণে ঘন অরণ্য। তার পর বেত্রবতী নদী। সেই বেত্রবতী নদী পেরিয়ে মাহীষ্মতী নগর, সেই মাহীষ্মতী নগরের দক্ষিণে অরণ্য রৈবতক পর্বত ও নর্মদা নদী।
কুণাল রৈবতক পর্বতের সানুদেশে নর্মদা নদীর তীরে গভীর অরণ্যের এক ভগ্ন দেউলে এসে আশ্রয় গ্রহন করে। তার সঙ্গে আচার্য তারানাথ এর ভোজপত্রে লেখা অসংখ্য গ্রন্থ। অতি প্রত্যূষে নর্মদা নদীর তীরে øান করে কুণাল । মুরলী জলদস্যু বিকর্ণ-র কথা বলেছিল। তিলক ও তিলকের পিতাকে আক্রান্ত করেছিল। কুণাল জলদস্যু বিকর্ণ-র ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে না। সে এখন নবীণ সন্ন্যসী।
স্নানের পর সামান্য অরণ্যলব্দ ফলমূল আহার করে গ্রন্থাদি পাঠ করতে বসে যতক্ষণ না সূর্যালোক থাকে । রাত্রিবেলা নদী তীরে বসে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়। মাঝে মাঝে রাজকন্যা রোহিণীর কথাও মনে পড়ে। মুকুন্দ মালাকরের সঙ্গে রাজকন্যার প্রণয়ের বিষয়টি সম্ভবত জানাজানি হয়ে গেছিল। কুণাল-এর দোষ চাপাল রাজবাড়ির সম্মান রক্ষার্থে।
এ ভাবে তার দিন কাটছিল।
একদিন প্রভাতে স্নান সেরে ফিরছিল কুণাল। পথে এক গৌরবর্ণের বাঘছাল পরিহিত দীর্ঘ সবল কিন্তু অতি বৃদ্ধ এক অরণ্যঋষি দেখে থমকে দাঁড়াল। কুণাল ঋষিকে প্রণাম করে। ঋষি বললেন, আমি সারণ। সৌবীর দেশীয় ঋষি।
কুণাল চমকে ওঠে। আপনি ঋষিশ্রেষ্ঠ সারণ?
হ্যাঁ।
মাটিতে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল কুণাল । ঋষি সারণ সন্তুষ্ঠ হলেন বলেই মনে হল।
কুণাল মিনতি করে বলল, ঋষি, আমার নির্জন সাধানার স্থলে একবার আপনার পদধূলি দিলে ধন্য হই।
ঋষি সারণ হাস্য করলেন। এবং কুণালের সঙ্গে যেতে সম্মত হলেন। কুণাল ঋষিকে পথ দেখিয়ে বনপথ ধরে নিয়ে এল তার ভগ্ন দেউলের কাছে। কুণাল প্রসন্ন বোধ করছিল। এতবড় ঋষির সঙ্গে দেখা হল যখন - তখন নিশ্চয়ই বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
সত্যি কিন্ত তাই হয়েছিল।
ভগ্ন দেউলের কাছে এসে ঋষি চারিদিকে তাকালেন। কুণাল ব্যঘ্রছাল পেতে দিল । ঋষি আসন গ্রহন করলেন। কাছেই গ্রন্থের স্তূপ; একখানি গ্রন্থ তুলে নিলেন। পাতা উল্টিয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ। জিগ্যেস করলেন, তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্য?
জ্ঞান সাধনা। নগরে থেকে কি আর একনিষ্টচিত্তে জ্ঞানসাধনা সম্ভব?
ঋষি সারণ মাথা নাড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, কি জানতে চাও তুমি?
জীবন ও জগতের অন্তরালে যিনি থাকেন সেই তাকে। গভীর আবেগে কুণাল বলল।
তাহলে কেবল বই পাঠ করলেই হবে?
তাহলে? কুণাল থতমত খায়।
বৎস সত্যিই কি তুমি জীবন ও জগতের অন্তরালে যিনি থাকেন সেই তাকে জানতে চাও?
হ্যাঁ।
তা হলে আগুন ধরাও।
আগুন ধরাব? কুণাল অবাক।
হ্যাঁ। আগুন ধরাও।
কাছেই শুকনো পাতার স্তুপ। ঋষি যখন বলছেন-কুণাল অরণি কাষ্ঠ ঘঁষে আগুন ধরাল।
ঋষি সারণ বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে। এখন গ্রন্থসমূহ আগুনে ছুড়ে মার।
কুণাল অভিভূত। সে আর্ত চিৎকার করে বলল, ঋষি! কী বলছেন আপনি!
আমি ঠিকই বলছি। গ্রন্থসমূহ আগুনে ছুড়ে মার।
গ্রন্থগুলি আমার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। কুণাল প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।
তুমি কি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে চাও না বৎস?
চাই ঋষি।
তাহলে গ্রন্থসমূহ আগুনে ছুড়ে মার। ঋষি অবিচল কন্ঠে বললেন।
কুণাল এবার জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে একে একে সমস্ত গ্রন্থ ছুড়ে ফেলে পুড়িয়ে ছাই করে দিল।
ঋষি সারণ বললেন, শোন, বৎস।
বলুন।
এই নর্মদা নদীর ধারে কয়েক ক্রোশ উত্তরে হতদরিদ্র অন্ধ ও রোগগ্রস্থ কুষ্ঠদের একটি নগর রয়েছে। সে নগরের নাম অচ্ছুত নগর। তুমি ওই অচ্ছুত নগরে যাবে। তারপর দীর্ঘ বারো বছর হতদরিদ্র, অন্ধ ও রোগগ্রস্থ কুষ্ঠদের সেবা করবে। তা হলেই এই জীবন ও জগতের অন্তরালে যিনি থাকেন তার প্রকৃত সরূপ উপলব্দি করতে পারবে। অচ্ছুত নগরের পুরোহিতের নাম জয়দ্রথ। তাঁকে আমার কথা বলো।
এই বলে ঋষি সারণ বনপথে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
কুণাল হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে চলে এল। তারপর ঋষি সারণ-এর নির্দেশ অনুযায়ী নির্ভীক পদক্ষেপে অচ্ছুতপুর পৌঁছার উদ্দেশে নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটতে থাকে।
যেতে যেতে অপরাহ্নকাল গড়িয়ে গেল।
যতই হাঁটছে অরণ্য ততই গভীর হয়ে উঠেছে। কুণাল ক্ষুধাতৃষ্ণা অনুভব করলেও তা অগ্রাহ্য করে। হাঁটতে থাকে। ঋষি সারণএর কথাগুলি কানে বাজছে। ... অচ্ছুত নগরে দীর্ঘ বারো বছর হতদরিদ্র, অন্ধ ও রোগগ্রস্থ কুষ্ঠদের সেবা করবে। তা হলেই এই জীবন ও জগতের অন্তরালে যিনি থাকেন তার প্রকৃত সরূপ উপলব্দি করতে পারবে। নর্মদা নদীর ধারে কয়েক ক্রোশ উত্তরে অচ্ছুত। কতদূর এলাম? নিজেকে প্রশ্ন করে কুনাল। নর্মদা নদীর ওপারেও ঘন অরণ্য। নদীর জল ঘোলা।
সন্ধ্যালগ্নে কুণাল এক ঘাটের কাছে এসে। পরিত্যক্ত ঘাট। আশেপাশে ঘরবাড়িও নেই। ঘন বনজঙ্গল। আষাঢ় মাস। চাঁদ উঠেছে। ধবল নির্মল আলো ছড়িয়ে আছে নির্জন চরাচরে। একটা গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। কি একটা গায়ে এসে পড়ল। কি? জাল মনে হল। ও চিৎকার করে ওঠে। টের পেল শূন্যে উঠে যাচ্ছে। একটু পর কীসের ওপর ধপ করে। শক্ত। ব্যথা পেল। খানিকটা ধাতস্থ হতে বড় একটা নৌকার পাটাতনের পড়ে আছে। যারা আক্রমন করেছিল, তারা জাল সরিয়ে নিয়েছে। কুনাল উঠে দাঁড়াল। মশাল জ্বলছিল। তাছাড়া চাঁদের ঘন আলো ছিল। নৌকার ওপর অনেকগুলি ছায়ামূর্তি; আততায়ীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতে নারাচ (লোহার বান) ও পট্টিশ (খড়গ); কারও কারও হাতে লৌহকন্টকযুক্ত মুদগর-পরিঘ। কারও হাতে হাতে পরশু (খড়গ)
কুনালের চোখ একজন আটকে গেল। রাজা প্রভস। রাজার পাশে রাজকন্যা রোহিণী। রাজকন্যা রোহিণী ওকে দেখে হাসছিল। রাজা প্রভাসের ঠিক সামনে দীর্ঘ ও বলিষ্ট একজন মাঝবয়েসী লোক দাঁড়িয়ে। লোকটার মাথা সম্পূর্ন কামানো। বাঁ কান কাটা। গোলাকার মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। গলায় কবজ। নাকে পিতলের কুন্ড। লোকটার হাতে নরমুন্ড। কি যেন পান করছে। কে এ? কাপালিক?
কুনালের ওপর লোকটার চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, এ্যাই ... এ কে রে তুই
একজন অনুচর এগিয়ে এল। বলল, নদীর পাড় দিয়ে যাচ্ছিল, ভাবলাম রাজা প্রভাসের অনুচর, তাই জাল ফেলে মাছের মতন ধরে এনেছি। দেখুন কেমন খাবি খাচ্ছে।
এ ছেলেটি কি তোমার অনুচর হয় রাজা?
না, না। একে আমি কখনও দেখিনি। রাজা প্রভাস বললেন।
ঠিক আছে। আগে বিয়ের কথাবার্তা হক, তারপর এর ব্যবস্থা করা যাবেনি।
রাজা প্রভাস কাতরকন্ঠে বললেন, দস্যু বিকর্ণ, তুমি যা যা ধনরতœ আনতে বলেছ, এনেছি। এবার রোহিণীকে মুক্ত করে দাও। রাণী এখনও অচেতন হয়ে রয়েছেন।
দস্যু বিকর্ণ! চমকে ওঠে কুনাল। এই সেই আর্যাবর্তের কুখ্যাত জলদস্যু। রোহিণী কি এর হাতে বন্দি? রোহিণী কে অপহরণ করে এনেছে দস্যু বিকর্ণ?
দস্যু বিকর্ণ বলল, রাজা, যা এনেছ, তাতে আমার হবে নাই। আমার আরও কিছু চাই যে।
রাজা বললেন, তুমি আর কি চাও বল?
দস্যু বিকর্ণ বলল, রাজা আমি তোমার কন্যা রোহিণীকে বিবাহ করতি চাই
না, না! তা কি করে সম্ভব? রাজা প্রভাস তীক্ষ্মস্বরে বলে উঠলেন।
কেন সম্ভব নয়? দস্যু বিকর্ণ-র গলাটা চড়ছিল।
রোহিণী যে বৎস রাজ্যের যুবরাজ সঞ্জয়ের বাগদত্তা।
সে ছেলের গলা কেটে লিব না হয়। আমি রোহিণীকে বিবাহ করবই করব। বলে অদ্ভূত ভঙ্গিতে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে শুরু করল দস্যু বিকর্ণ ।
রাজা চুপ করে রইলেন।
সহসা দস্যু বিকর্ণ এক অনুচরের দিকে ইঙ্গিত করে কুণালকে দেখিয়ে বলল, এই শোন। ইদিক আয়, এটাক মাইরে নদীতে ফেলে দে তো।
একজন এগিয়ে এল । হাতে নারাচ ... কুণালের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতটা উঠল ...থপ করে আওয়াজ হওয়ার পর কুনাল দু’চোখে অন্ধকার দেখল ...
পরদিন ভোরে স্নান করবার সময় ঘাটের কাছে এক তরুনের ভাসমান দেহ আবিস্কার করে বিস্মিত হয়ে যান অচ্ছুত নগর পুরোহিত জয়দ্রথ।
তথ্য নির্দেশ:
সুকুমারী ভট্টাচার্য রচিত প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য