ক্লাইটেমনেসস্ট্রা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ক্লাইটেমনেসস্ট্রা। প্রাচীন গ্রিক রাজ্য মাইসিনির রাজা আগামেমনন এর স্ত্রী। গ্রিক উপকথায় ক্লাইটেমনেসস্ট্রা Femme fatale হিসেবে চিহ্নিত । এই ফরাসি শব্দ গুচ্ছের মানে, ‘ভয়ঙ্কর রমনী!’ কেননা, ক্লাইটেমনেসস্ট্রা তার স্বামী আগামেমনন কে হত্যা করে ধারাবাহিক হত্যাকান্ডের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন । অবশ্য এখন আর ক্লাইটেমনেসস্ট্রা কে অনেকেই ভয়ঙ্কর রমনী মনে করেন না। কেন? আজ আমরা এই প্রশ্নটির উত্তরই খুঁজব।
মানচিত্রে গ্রিক রাজ্য মাইসিনির অবস্থান।
পুরাকালের এক গ্রিকরাজ্য মাইসিনি; তারই রাজা ছিলেন আগামেমনন । আগামেমনন -এর স্ত্রী ক্লাইটেমনেসস্ট্রা; তাদের ছিল চারটি ছেলেমেয়ে। ছেলের নাম ওরেস্টেস এবং মেয়েদের নাম যথাক্রমে, ইপহিজেনিয়া, ইলেকক্ট্রা এবং ক্রাইসোথেমিস ।
আগামেমনন। মাইসিনির এই রাজাকে আমরা ইউরোপীয় সাহিত্যে বারবার দেখেছি। এমন কী কবি শামসুর রাহমানও আগামেমনন কে নিয়ে বিষাদগ্রস্থ দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন।
ধরা যাক, মাইসিনির রাজপ্রাসাদে আগামেমনন -ক্লাইটেমনেসস্ট্রার সংসার সুখেশান্তিতেই কাটছিল। এর পর, মানুষের সংসারে যা হয়- ঝড় উঠল। সেই ঝড়ের ইতিবৃত্তটি আমরা অল্পবিস্তর জানি। এখানে সংক্ষেপে বলি। মাইসিনি রাজ্যটি ছিল পেলোপন্নেসাস বলে ৮,২৭৮ স্কোয়ার মাইল আয়তন বিশিষ্টি দক্ষিণ গ্রিসের একটি সুবৃহৎ উপদ্বীপে। সেখানেই স্পার্টা নামে আরেকটি রাজ্য ছিল। স্পার্টার রাজা মেনেলাউস; সম্পর্কে আগামেমনন এর ভাই । মেনেলাউস এর স্ত্রী সুন্দরী হেলেন। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস সুন্দরী হেলেন কে হরণ করে।
এতে করে ট্রয় যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে ।
সেকালের জাহাজ।
স্পার্টার রাজা মেনেলাউস ক্ষুব্দ। তিনি স্ত্রীর শোকে জর্জরিত হয়ে ট্রয় নগরী সমূলে ধ্বংসের উদ্যোগ নিলেন। তারপাশে এসে দাঁড়ালেন মাইসিনির আগামেমনন। তিনি ট্রয় যুদ্ধে অংশ নিতে চাইলেন। আগামেমনন এর নেতৃত্বে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে ভেসে চলার জন্য তৈরি হল মাইসিনির রণতরী । তবে বাতাস অনুকূলে ছিল না বলে জাহাজ ছাড়া যাচ্ছে না। সবাই বন্দরে উৎকন্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। কী করা যায়। সময় মতো ট্রয় পৌঁছতে হবে। তখনই দৈববাণী শোনা গেল। দেবী আর্টেমিস-এর উদ্দেশে আগামেমনন-কন্যা ইপহিজেনিয়া কে বলি দিতে হবে। কী ভয়ঙ্কর কথা! ইপহিজেনিয়ার মা ক্লাইটেমনেসস্ট্রা নিশ্চয়ই এ দৈব নির্দেশ অগ্রাহ্য করতেন । আগামেমনন পুরুষ বলেই কি আপন কন্যাকে দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দিতে প্রস্তুত হলেন?
আগামেমনন তার স্ত্রী ক্লাইটেমনেসস্ট্রা কে বললেন ইপহিজেনিয়া কে বন্দরে পাঠাতে।
কেন?
ওকে ট্রয়ে নিয়ে গিয়ে একিলিসের সঙ্গে বিয়ে দেব।
বীর যোদ্ধা একিলিস!
হ্যাঁ।
ক্লাইটেমনেসস্ট্রা মেয়েকে বন্দরে পাঠিয়ে দিলেন।
ইপহিজেনিয়াকে বলি দেওয়া হল।
এভাবে ধারাবাহিক হত্যাকান্ডের পথ উন্মুক্ত করলেন স্বার্থান্বেষী আগামেমনন।
ক্লাইটেমনেসস্ট্রা দুঃসংবাদ শুনলেন।
শোকে কাতর হলেন তিনি।
ক্লাইটেমনেসস্ট্রা
তথাকথিত স্বামীর ওপর ঘৃনায় মন ছেয়ে গেল। ক্লাইটেমনেসস্ট্রা ছিলেন সুন্দরী। আগামেমননশূন্য মাইসিনির রাজপ্রসাদে অনেক পুরুষই ক্লাইটেমনেসস্ট্রার আশেপাশে ঘুরঘুর করত। এদের একজন এইজিসথাস। সম্পর্কে আগামেমনন-এর কাজিন। কন্যাশোক ভুলতে এবং স্বামীকে অপমান করকেই যেন এইজিসথাসএর সঙ্গে অবাধ প্রেমে মগ্ন হলে শোকগ্রস্থ রানী। ক্লাইটেমনেসস্ট্রার গর্ভে একটি মেয়ের জন্ম হল। সেই মেয়ের নাম রাখা হল এরিগোনে।
ওরেস্টেস তখন ছোট। মায়ের অনৈতিক জীবন ইলেকক্ট্রার মনে বিষাদময় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তবে আরেক কন্যা ক্রাইসোথেমিস এর মনে নাকি মায়ের পরকীয়ায় কোনও ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়নি!
গ্রিক মিথ এখানেই বিস্ময়কর।
প্রাচীন কালে সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধ ট্রয়যুদ্ধ। তবে এখনকার ঐতিহাসিকগন বলছেন সুন্দরী হেলেনের জন্য ট্রয়যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। তাহলে? ট্রয়যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নৌবানিজ্য পথের দখল। বিশেষ করে লবনের ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা ...এখন যেমন তেলের জন্য ইঙ্গমার্কিনীরা জোট বেঁধেছে, সেরকম। তাহলে রাজা আগামেমনন এর কন্যাবলি অর্থনৈতিক স্বার্থেই?
রাজা আগামেমনন ফিরে এলেন। সঙ্গে কাসান্ড্রা । ট্রয়ের রাজা প্রিয়ামের কন্যা। যুদ্ধজয়ের পুরস্কার হিসেবে লাভ করেছেন আগামেমনন।
ক্লাইটেমনেসস্ট্রা স্বামীকে স্বাগত জানাল।
আগামেমনন প্রাসাদে ঢুকলেন। স্নান করতে গেলেন। কাসান্ড্রা রথে অপেক্ষ করছিল । বলা হয় ট্রয়ের নারী পুরোহিত। কাসান্ড্রা দৈববশে আগামেমনন হত্যাদৃশ্যটি অবলোকন করে। ভবিতব্য মেয়ে নিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করে। ক্লাইটেমনেসস্ট্রা অপেক্ষা করছে। স্নানঘর থেকে আগামেমনন বেরিয়ে এলেন। ক্লাইটেমনেসস্ট্রা এক টুকরো কাপড় দিয়ে স্বামীর গলায় ফাঁস ...এরপর উপর্যপুরি ছুড়িকাঘাত করলেন। এইজিসথাস কাছাকাছিই ছিল।
ইলেকট্রা। মিথ ও ইউরোপীয় সাহিত্যে তীব্র মানসিক যন্ত্রনায় ভোগা একটি নারী চরিত্র। ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্স' ইলেকট্রার নাম থেকেই এসেছে। মেয়েদের নাকি বাবার প্রতি আকর্ষন থাকে ...যেমন আগামেমনন এর প্রতি টান ছিল ইলেকট্রার ...
মাকে ঘাতকের ভূমিকায় দেখে ইলেকট্রার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ওরেসটেস তখন নাবালক। ওরেসটেস কে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এথেন্স পাঠিয়ে দিল। ইলেকট্রা কেন মনে করেছিল ওরেসটেস কে ক্লাইটেমনেসস্ট্রা হত্যা করতে পারে? নিজেকে ইলেকট্রা নিরাপদই ভেবেছিল কেন? যা হোক। মায়ের এহেন নৈতিক অপকর্মে ক্রাইসোথেমিস এর নাকি কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি! ক্রাইসোথেমিস কি বোন ইপহিজেনিয়ার হত্যাকান্ড ভুলতে পারেনি?
নিহত আগামেমনন ও ক্লাইটেমনেসস্ট্রা।
যা হোক। আগামেমনন এর মৃত্যুর পর এইজিসথাস হল মাইসিনির রাজা। আর ক্লাইটেমনেসস্ট্রা রানী।
আট বছর কেটে গেল।
ইলেকট্রা ও ওরেসটেস।
এথেন্স থেকে মাইসিনি ফিরল যুবক ওরেসটেস। সে শোকার্ত হৃদয়ে পিতার সমাধি তে গেল। কে যেন ছায়াচ্ছন্ন করিডোরে দাঁড়িয়ে। কে?
আমি।
আমি কে?
আমি ইলেকট্রা।
ওহ্ । দুঃখিনী বোন আমার ...
ওরেসটেস?
বল।
পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেবে না তুমি?
পিতার হত্যার প্রতিশোধ?
হ্যাঁ। বলে ইলেকট্রা ভাইকে সব খুলে বলে।
আগামেমনন এর মুখোশ। এটি মাইসিনি তে খননকার্য চালিয়ে পাওয়া গেছে।
তারপর?
তারপর ইলেকট্রার প্ররোচনায় ওরেসটেস তার মাকে আর মায়ের প্রেমিক এইজিসথাসকে খুন করে। ক্লাইটেমনেসস্ট্রা অবশ্য ছেলের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল।
ওরেসটেস ক্লাইটেমনেসস্ট্রা ও এইজিসথাসকে খুন করছে! ১৬৫৪ সালে বেরনারদিনো মেই-এর আঁকা।
মাইসিনির রাজপ্রাসাদ আবার রক্তাক্ত হল। যে রক্তপাতের সূত্রপাত করেছিলেন দৈবে বিশ্বাসী কাপুরুষ আগামেমনন। দেবী আর্টেমিস কে খুশি করতে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আপনকন্যা ইপহিজেনিয়া কে উৎসর্গ করেছিলেন। আগামেমনন পুরুষ বলেই তাইই করলেন! ক্লাইটেমনেসস্ট্রা কন্যার মৃত্যুশোকে কাতর হলেন। তিনিও হত্যা ও প্রতিশোধের পথ খুঁজতে থাকেন। সে সুযোগ তিনি পেয়েও যান। যে জন্য ক্লাইটেমনেসস্ট্রা গ্রিক ইতিহাসে Femme fatale বা ভয়ঙ্কর রমনী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন।
প্রাচীন দেয়ালগাত্রে ক্লাইটেমনেসস্ট্রা হত্যার দৃশ্য।
একুশ শতকে অবশ্য ক্লাইটেমনেসস্ট্রার প্রতিশোধপরায়ন আচরনের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। স্বামীর ওপর তীব্র ঘৃনা থেকেই ক্লাইটেমনেসস্ট্রা পরকীয়া ও রক্তপাতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কেননা, ক্লাইটেমনেসস্ট্রা বলেছেন, “To give birth is a dreadful thing; despite suffering badly one cannot bring oneself to hate those she has born.”
ক্লাইটেমনেসস্ট্রার পাশে আমরা আরেকজনকে পাই।
সে হচ্ছে ক্রাইসোথেমিস!
মাইসিনির রাজপ্রাসাদের সিংহদুয়ার। এখানেই পুরাকালে এক নৃশংসতম পারিবারিক হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছিল । কত বিয়োগান্ত ঘটনার সাক্ষী এই প্রাসাদ। বিয়োগান্ত,- কেননা গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিদেস বলেছেন: শেষ মুহূর্তে নাকি ইপহিজেনিয়া কে বলি দেওয়া হয়নি! টাওরাস নগরে নিয়ে রক্ষ করা হয়েছিল ইপহিজেনিয়া কে এবং আর্টেমিস এর বদলে হরিণ বলি হয়েছিল। এখানেও আমরা মধ্যপ্রাচ্যের আব্রাহামিক ধর্মের একটি বিশেষ ঘটনার সঙ্গে গ্রিক মিথের সাদৃশ্য খুঁজে পাই ...
ক্লাইটেমনেসস্ট্রা সম্পর্কে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে জানতে হলে এখানে ক্লিক করুন ...
ছবি ও তথ্য: ইন্টারনেট।
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কাঁঠালের আমসত্ত্ব
কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে
এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে । ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন