মিথিলা। এই শব্দটি বাংলায় বেশ পরিচিত। এটি অনেকের নামও, বিশেষত মেয়েদের । এ কারণে প্রশ্ন জাগে মিথিলা-র প্রকৃত ইতিবৃত্ত কী। কোথায় এর উৎপত্তি? আমরা অনেকেই রামায়ন পড়েছি বলে জানি মিথিলা ছিল প্রাচীন ভারতের একটি নগরী। কিন্তু, ঠিক কোথায় ছিল মিথিলা? ...আরেকটি কথা। পঞ্চদশ শতকের মিথিলার এক কবির সঙ্গে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট ...মিথিলার আলোচনার সূত্রে সেই মৈথিলী কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত খোঁজ খবর নিতে হয় ...
প্রাচীন ভারতবর্ষের মানচিত্র । পূর্ব দিকে বিদেহ রাজ্যটির অবস্থান লক্ষ করুন। বিদেহ রাজ্যটির রাজধানী ছিল মিথিলা।খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ নাগাদ প্রাচীন ভারতবর্ষে ১৬ টি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যগুলির নাম:- অঙ্গ মগধ কাশী কোসল বজ্জি মল্ল চেদি বৎস কুরু পাঞ্চাল মৎস সুরসেন অস্মক অবন্তী গান্ধার ও কম্মোজ। একত্রে এই রাজ্যগুলি ষোড়শ মহাজনপদ নামে পরিচিত।
মিথিলা নগরের অবস্থান বের করতে হলে আমাদের ‘বজ্জি’ রাজ্যটির দিকে তাকাতে হবে। তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ নাগাদ প্রাচীন ভারতের বজ্জি রাজ্যটি ছিল একটা যুক্তরাজ্য বা কনফেডারেশন। আটটি মৈত্রীবদ্ধ গোষ্ঠী (পালি ভাষায় অঠঠকূল) বজ্জির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিদেহগন, লিচ্ছবিগন, জ্ঞাতৃকগন এবং বজ্জি প্রধান।’ (দেখুন, সুনীল চট্টোপাধ্যায়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। প্রথম খন্ড। পৃষ্ঠা, ১১৪) আগেই বলেছি। বিদেহ রাজ্যের রাজধানী ছিল মিথিলা। বর্তমান উত্তর বিহারের তিরহূত জেলা ও দক্ষিণ নেপালের জনকপুর মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন বিদেহ রাজ্য। সত্যমিথ্যা জানি না, মিথিলা নগরীরর পরিধী ছিল নাকি ৫০ মাইল।
নেপালের জনকপুরের মানচিত্র। প্রাচীন মিথিলা নগরের অবস্থান ছিল ধানুসা জেলায়।
স্মরনাতীত কালে বিদেহ রাজ্যে জনক নামে এক রাজা ছিলেন। আমরা মহাকাব্য রামায়নে এ তথ্যটি পাই। রাজা জনক ছিলেন রামের স্ত্রী সীতার পিতা। মিথিলা বিদেহ রাজ্যের রাজধানী হওয়ায় সীতার সঙ্গে মিথিলার একটি সম্পর্ক আবিস্কার করা গেল। তার মানে সীতা ছিলেন মিথিলাবাসী।
সীতা। শিল্পীর চোখে।
বর্তমান জনকপুরের রত্নসাগর। কোনকালের রাজা জনক ও জনককন্যা সীতার স্মৃতি ধরে রেখেছে।
বিদেহ শাসকদের বলা হত জানকী। পান্ডিত্যের খ্যাতি ছিল। সরস্বতী ছিল বৈদিক যুগের নদী। নদীটির অবস্থান ছিল ভারতবর্ষের পশ্চিমে। বৈদিক যুগে নদীটি শুকিয়ে গেলে বিদেহগনের পূর্বপুরুষগন পূর্বযাত্রা করে গঙ্গার উত্তরে এসে বসবাস করতে থাকে। তার মূলত কৃষিকাজ করতেন। কথিত আছে, রাজা জনক সীতাকে হলকর্ষনের সময় লাভ করেছিলেন।
ভারতবর্ষজুড়ে জনপ্রিয় বিশ্বাস এই ... রাজা জনক সীতাকে হলকর্ষনের সময় লাভ করেছিলেন।
এভাবে সরস্বতী উপত্যকার সভ্যতা লালন করে মিথিলাকেন্দ্রীক বিদেহ রাজ্যটি বৈদিক সভ্যতার পীঠস্থান হয়ে ওঠে । বিদেহ নামটি এসেছে বি -দেহ থেকে। একজন মৃতরাজা থেকে ... উপকথামতে যার পুত্ররা একজন ঋষি কর্তৃক সৃষ্টি হয়েছিল । যে ঋষিটি মৃত রাজার দেহের ওপরে নানা কৃত্য অনুষ্ঠিত করেছিল।
রাম লক্ষ্মণ, সীতা (ডানে) ও হনুমান (বাঁয়ে)। রামায়নের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন সীতা। মিথিলা নগরের সঙ্গে যার সম্পর্ক ঘনিষ্ট।
প্রাচীন মিথিলার সঙ্গে বঙ্গবাসীর তেমন সম্পর্ক নেই। তবে পঞ্চদশ শতকের মিথিলার এক কবির সঙ্গে রয়েছে। এই কবিটির নাম বিদ্যাপতি। সময়কাল? ১৩৭৪/১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ। বিদ্যাপতির জন্ম মিথিলার সীতামারী মহকুমায় বিসফি গ্রামে। বৈষ্ণব। পারিবারি উপাধি ঠাকুর।
বিদ্যাপতি। মিথিলার এই কবিটি বাংলা ভাষাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
বিদ্যাপতি ছিলেন বৈষ্ণব। মৈথিলী, সংস্কৃত ও অবহ্টঠ ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছেন । অবহটঠ ভাষা কি? পৃথিবীর যে কোনও ভাষাই পরিবর্তনশীল। প্রাচীন পালি-প্রাকৃত ভাষার সর্বশেষ স্তর হল অপভ্রংশ ভাষা। এই অপভ্রংশ ভাষা থেকেই উদ্ভব হয়েছিল অবহটঠ ভাষার। বিষয়টি এভাবে প্রকাশ করা যায়:
পালি-প্রাকৃত>অপভ্রংশ>অবহট্ঠ।
বিদ্যাপতি অবশ্য ব্রজবুলি ভাষাতেও লিখতেন । ব্রজবুলি হল মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় কাব্যভাষা বা উপভাষা।বিদ্যাপতিই ভাষাটির উদ্ভাবক। মৈথিলী ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষা মিশিয়ে ব্রজবুলি ভাষা সৃষ্টি করেছেন বিদ্যাপতি। ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক পদ রচনা করেছেন। ব্রজলীলা বর্ণিত হওয়ায় এর নাম ব্রজবুলি। ব্রজবুলি ভাষায় রাধার বয়োসন্ধি সম্পর্কে বিদ্যাপতি লিখেছেন-
দিনে দিনে উন্নত পয়োধর পীন ।
রাঢল নিতম্ব মাঝ ভেল খীন ।।
আবে মদন রঢায়ল দীঠ ।
শৈশব সকলি চমকি দেল পীঠ ।।
শৈশব ছোড়ল শশিমুখি দেহ ।
খত দেই তেজল ত্রিবলি তিন রেহ ।।
অব ভেল যৌবন বঙ্কিম দীঠ ।
উপজল লাজ হাস ভেল মীঠ ।।
দিনে দিনে অনঙ্গ অগোরল অঙ্গ ।
দলপতি পরাভবে সৈনিক ভঙ্গ ।।
তকর আগে তোহর পরসঙ্গ ।
বুঝি করব জে নহ কাজ ভঙ্গ ।।
সুকবি বিদ্যাপতি কহে পুন ফোয় ।
রাধারতন জৈসে তুয় হোয় ।।
ব্রজবুলি ভাষার উৎপত্তি বিদ্যাপতির হাতে হলেও ভাষাটি পরিপুষ্টি হয়েছে বাঙালি কবিদের হাতেই। ব্রজবুলি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের একটি পদাবলী -
বসন্ত আওল রে !
মধুকর গুন গুন, অমুয়ামঞ্জরী
কানন ছাওল রে ।
শুন শুন সজনী হৃদয় প্রাণ মম
হরখে আকুল ভেল,
জর জর রিঝসে দুখ জ্বালা সব
দূর দূর চলি গেল ।
মরমে বহই বসন্তসমীরণ,
মরমে ফুটই ফুল,
মরমকুঞ্জ'পর বোলই কুহু কুহু
অহরহ কোকিলকুল ।
সখি রে উছসত প্রেমভরে অব
ঢলঢল বিহ্বল প্রাণ,
নিখিল জগত জনু হরখ - ভোর ভই
গায় রভসরসগান ।
বসন্তভূষণভূষিত ত্রিভুবন
কহিছে দুখিনী রাধা,
কঁহি রে সো প্রিয়, কঁহি সো প্রিয়তম,
হৃদিবসন্ত সো মাধা ?
ভানু কহত অতি গহন রয়ন অব,
বসন্তসমীর শ্বাসে
মোদিত বিহ্বল চিত্তকুঞ্জতল
ফুল্ল বাসনা - বাসে ।
তথ্য: ইন্টারনেট ও বাংলাপিডিয়া।
ছবি: ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫০