জিযিবেল (Jezebel) ... ফিনিসিয় রাজকুমারী। সময়কাল? খ্রিস্টপূর্ব নবম শতক। হিব্রু বাইবেলে জিযিবেল এর কথা ঘৃনাভরে উল্লেখ রয়েছে। তার কারণ, জিযিবেল ছিলেন ইজরাইলের রাজা আহাব এর স্ত্রী। তা সত্ত্বেও ইসরাইলি ধর্ম মেনে নিতে পারেন নি জিযিবেল - আমৃত্যু ছিলেন ফিনিসিয় ধর্মের প্রতি অনুরক্ত । তাঁর ধর্মবোধ এতই প্রবল ছিল যে তাঁকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ...
ফিনিসিয় মানচিত্র। জিযিবেল ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৯ শতকের ফিনিসিয় একজন রাজকুমারী। ফিনিসিয় সভ্যতা ছিল মূলত নাগরিক সভ্যতা, যে কারণে, অনুমিত হয়, যথেস্ট পরিশীলিত ছিলেন জিযিবেল। যদিও পৌত্তলিক ছিলেন। একেশ্বরবাদকে মনেপ্রাণে ঘৃনা করতেন!
দেবতা বাল।
ফিনিসিয়দের আরাধ্য দেবতার নাম ছিল Baal. ‘জিযিবেল’ নামের অর্থ : ‘হোয়ার ইজ দ্য প্রিন্স?’ এই প্রিন্স হলেন বাল। বাল যখন পাতালে প্রবেশ করেন পৃথিবী তখন উষর হয়ে ওঠে। তখন ফিনিসিয় প্রার্থনাকারীগন সববেত কন্ঠে আহাজারী করে, ‘জিযিবেল’ ... ‘জিযিবেল’ ... ‘হোয়ার ইজ দ্য প্রিন্স?’ ‘হোয়ার ইজ দ্য প্রিন্স?’ হিব্রুভাষীদের রানী হলেও বাল-এর ওপর প্রবল বিশ্বাস ছিল জিযিবেল এর। কথিত আছে, বাল এর উপসনালয়ে শিশুবলি হত। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়-কেবল ধর্মবিশ্বাসের জন্য নিষ্ঠুর প্রথা মেনে নিয়েছিলেন জিযিবেল। এবং তা কিতাবধারী হিব্রুভাষীদের সমাজে প্রচলনের চেষ্টা করেছেন!
হিব্রু বাইবেলে জিযিবেল অশুভ শক্তির প্রতীক।
জিযিবেল এর বাবার নাম এথবার। তাঁকে বলা হত সিদোনিওদের রাজা। কারণ, ফিনিসিয় নগরী টায়ার ও সিদোন ছিল ফিনিসিয় সাম্রাজ্যে অংশ ছিল। সিদোন থেকেই ওই নাম।
সিদোন এর মানচিত্র। প্রাচীন ফিনিসিয় রাজ্যই বর্তমানকালের লেবানন ।
প্রাচীন ইসরাইল-এর মানচিত্র। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে রাজ্যটি দুটি খন্ডে বিভক্ত ছিল। উত্তরের রাজ্যের নাম ইসরাইল; দক্ষিণের নাম জুদাহ। উত্তরের ইসরাইলের রাজার নাম ছিল আহাব। তাঁর সময়কাল ৮৭৪ থেকে ৮৫৩ খ্রিস্টপূর্ব।
রাজনৈতিক কারণেই এথবার এর সঙ্গে ইসরাইলের রাজা আহাব এর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে রাজা আহাব এর সঙ্গে রাজা এথবার এর কন্যা জিযিবেল এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ফলে, হিব্রু সাম্রাজ্যে ফিনিসিয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত ধর্মের ক্ষেত্রে। ইসরাইলী নগরগুলিতে ফিনিসিয় উপাসনালয় গড়ে উঠতে থাকে।
জিযিবেল -এর সিল। জিযিবেল স্বামীর সঙ্গে ইসরাইল রাজ্য শাসন করেছেন।
বিয়ের পর দুটো কারণে দুর্যোগ ঘনিয়ে ওঠে। (এক) তখন একবার বলেছি যে হিব্রুদের রানী হলেও বাল-এর ওপর প্রবল বিশ্বাস ছিল। পক্ষন্তরে হিব্রুভাষীরা উপসনা করত সর্বশক্তিমান ইয়াওয়ের। (দুই) রাজ্য পরিচালনার বিষয়ে জিযিবেল এর ধারণার সঙ্গে ইসরাইলীদের ধারণা পার্থক্য ছিল। জিযিবেল ফিনিসিয়ার একচ্ছত্র অধিপতির কন্যা। বিশ্বাস করতেন, ‘জোর যার মুলুক তার।’ যা ইচ্ছে করার অধিকার রয়েছে রাজার। উদাহরণসরূপ বলা যায়। রাজা আহাব এর প্রাসাদটি ছিল জিযরিল নামে একটি জায়গায়। প্রাসাদের পাশেই একটি দ্রাক্ষাকুঞ্জ ছিল: মালিক নাবোথ। আঙুর বাগানটি আহাব কিনতে চাইলেন। নাবোথ বিক্রি করতে রাজী নন। জিযিবেল নাবোথ কে হত্যা করে দ্রাক্ষাকুঞ্জের মালিকানা স্বামীকে দেন।
জিযিবেল এর এই রকম রুক্ষ আগ্রাসী ছবিই ইউরোপের খ্রিস্টান জগতে আঁকা হয়েছে বেশি
আমি যে সময়ে কথা বলছি সেই সময়ে ইসরাইলে ঐশি পথপ্রর্দকের নাম ছিল এলিজা। ইনিই ইসলামী বিশ্বের হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম নামে পরিচিত। পয়গম্বর এলিজার জেহু নামে একজন অনুচর ছিল। সে পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। যা হোক। পয়গম্বর এলিজার নেতৃত্বে একেশ্বরবাদী ইয়াওয়ে আন্দোলন দানা বাঁধে। ওদিকে রানী জিযিবেল এর অনুগতের সংখ্যাও কম ছিল না। ফলত দুটি স¤প্রদায়ের মধ্যে অনিবার্য হয়ে ওঠে সংঘাত । স্বভাবতই জিযিবেল বাল এর পক্ষ নেয়। রাজা আহাব মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে চাইলেন। পয়গম্বর এলিজা পক্ষ নেন ইয়াওয়ের।
মুখোমুখি রাজা আহাব, জিযিবেল ও পয়গম্বর এলিজা
পয়গম্বর এলিজার নির্দেশে জেহু আহাব পরিবারের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান ঘটায়। তাদের সপরিবারে হত্যা করে। মৃত্যুর সময় জিযিবেল দেবতা বাল এর ধর্মীয় পোশাক পরে ছিলেন বলে কথিত আছে । জেহু প্রাসাদের খোজাদের রানীকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে হত্যা করতে নির্দেশ দেয় যাতে রাস্তার কুকুরেরা উৎসব করতে পারে!
শিল্পী গুস্তাফ ডোর এর আঁকা জিযিবেল এর মৃত্যু
জিযিবেল এর মৃত্যু। আরেকটি ভার্সান।
জিযিবেল এর বিরুদ্ধে পয়গম্বর এলিজার বিজয় আব্রাহামিক ধর্মের বিশাল বিজয় বলে চিহ্নিত করা যায়। নয়তো এক ফিনিসিয় রাজকুমারীর প্রভাবে ইব্রাহিমের ধর্মটি হয়তো বিলুপ্ত না হলেও বিকৃত হয়ে যেত!মাঝে-মাঝে মনে হয় এমনই কাম্য-কেননা ফিনিসিয় দেবতা বাল এর উপসনালয়ে শিশুবলির কথা মনে হলে শিউরে উঠি! ওল্ড টেস্টামেন্টের "টেন কমান্ডমেন্টস" অনেক মানবিক ...
জিযিবেল এর ওপর আল মুজাহিদ এর এই লেখাটি পড়তে পারেন ...