এ রকম অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ও চরিত্র ১৭৫৭ কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। বাংলার শেষ হতভাগ্য নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা, সেনাপতি মীরজাফর আলী খান, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারিনী ঘসেটি বেগম, স্বার্থপর ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদ এবং ইংরেজ বেনিয়া শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী রবার্ট ক্লাইভ। ১৭৫৭ কেবল বাংলার পটপরিবর্তনই নয়, সে সময় এমন সব ঘটনা ঘটেছিল যার অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করে আজও আমাদের কপাল কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
মুর্শিবাবাদের মানচিত্র। এককালের (সংযুক্ত) বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী ছিল এই মুর্শিদাবাদ। ভাগীরথী (গঙ্গা) নদীর তীরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ নগর পূর্বাঞ্চলীয় মুগল প্রদেশ সুবাহ বাঙ্গালার প্রধান নগররুপে বিখ্যাত ছিল। অষ্টাদশ শতকে বাংলার নওয়াবদের আবাসস্থল ছিল মুর্শিদাবাদ নগর।
এই মুর্শিদাবাদ নগরেই নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার দ্বিতীয় স্ত্রী লুৎফুন্নেসার উত্থান ঘটেছিল, ১৭৫৭-র রঙ্গমঞ্চে লুৎফুন্নেসার সেই উত্থান ছিল অতি বিচিত্র। প্রথম জীবনে লুৎফুন্নেসা ছিলেন মুর্শিবাবাদের নওয়াবের হাজারদুয়ারি প্রাসাদের এক হিন্দু পরিচারিকা । মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি প্রাসাদে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার মা আমিনা বেগমের সেবায় নিয়োজিত ছিল রাজকুনোয়ার । আমিনা বেগম রাজকুনোয়ার কে আপন কন্যার মতো স্নেহ করতেন। নম্র স্বভাবে রাজকুনোয়ার ছিল অত্যন্ত রুপসী এবং মধুরভাষীনি ।
মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। এই প্রাসাদের কর্তৃত্ব নিয়েই ১৭৫৭-র ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আর পরবর্তীকালে সেই ষড়যন্ত্রকারীদের জীবনও সুখের হয়নি ... এই প্রাসাদেই এককালে রাজকুনোয়ার বলে এক হিন্দু পরিচারিকা হয়ে উঠেছিল উচ্চাকাঙ্খি ...
রাজকুনোয়ার কি আমিনা বেগম-এর বেদনার্ত বিধবা জীবনের সঙ্গী হয়েছিল? আমিনা বেগম-এর জীবন তো তেমন সুখের ছিল না; আমিনা বেগমের স্বামীর নাম জৈনুদ্দীন। তিনি পাটনার (বিহার) নায়েব সুবাহদার ছিলেন। বিদ্রোহী আফগান নেতারা জৈনুদ্দীন কে হত্যা করে দু ছেলেসহ আমিনা বেগমকে বন্দি করে। আলীবর্দী খান বিদ্রোহী আফগান নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাদের মুক্ত করেন। আমিনা বেগমের অন্য ছেলের নাম মির্জা মেহেদী। একে ১৭৫৭-র পর মীরজাফর আলী খান মির্জা মেহেদী কে ধীরে ধীরে টর্চার করে হত্যা করেছিল। তখনও বেঁচে ছিলেন আমিনা বেগম। শুনেছিলেন বড় ছেলের পর ছোট ছেলের হত্যার রোমহর্ষক কাহিনী...
দূর থেকে মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। ... এর একতলায় আছে অস্ত্রাগার, রেকর্ড ঘর এবং অফিস ঘর। সিরাজের তরবারি, আলিবর্দীর তরবারী, নাদির শাহের বর্ম ও শিরস্ত্রান, মীরকাশিমের মুঙ্গের এর কারখানার বন্দুক এবং আরও বিভিন্ন ধরনের বন্দুক, ছোরা, বল্লম, খঞ্জর রয়েছে এই অস্ত্রাগারে। এছাড়া পলাশীর যুদ্ধে যে কামান ফেটে গিয়ে মীরমদন নিহত হয়েছিলেন সেটি এবং অকৃতজ্ঞ মহন্মদী বেগ যে ছোরা দিয়ে সিরাজ কে হত্যা করেছিল সেই ছোরাটাও সযত্নে রক্ষিত আছে অস্ত্রাগারে।
নওয়াব আলীবর্দীর স্ত্রী শরীফুন্নেছা। তার বড় মেয়ে মেহেরুন্নেসা; লোকে তাকে ঘসেটি বেগম নামেই চিনত। দু’ বোনের ব্যাক্তিত্ব পার্থক্য ছিল; একজন অ্যাকটিভ তো অন্যজন প্যাসিভ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার মতো মনে হয়। এ ক্ষেত্রে শেখ রেহানা =আমিনা বেগম; আর ঘসেটি বেগম= ... আমিনা বেগমের তুলনায় ঘসেটি বেগম অনেক ডায়ানামিক পারসোনালিটির অধিকারী ছিলেন- সেই তুলনায় আমিনা বেগম অনেকটাই নিষ্প্রভ...উপরোন্ত সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বড় বোন।কাজেই ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকার কথা না।
তাই বলছিলাম রাজকুনোয়ার কি আমিনা বেগমের বেদনার্ত বিধবা জীবনের সঙ্গী হয়েছিল ?
মুর্শিদাবাদের বর্তমান ছবি।
নিসন্দেহে বুদ্ধিমতি ছিল রাজকুনোয়ার। নার্ভাস আমিনা বেগম কে সাহস যোগাত? আমিনা বেগম এর সঙ্গে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের তরুণী হিন্দু দাসী রাজকুনোয়ার বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল-যা ১৭৬৫ অবধি টিকে ছিল।
মুর্শিদাবাদের বর্তমান ছবি। রাজকুনোয়ার কি মুর্শিদাবাদের মেয়ে? রাজকুনোয়ার কি বাঙালি ছিল? নাকি পশ্চিমদেশিয়? মানে উত্তর ভারতের? রাজকুনোয়ার বাঙালি হলে কি স্থানীয়? মানে মুর্শিদাবাদের মেয়ে? বাঙালি মেয়েরাও তো সেই রকম সুন্দরী হয়। কোনওকালে এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে কি?
আমরা অনুমান করতে পারি রাজকুনোয়ার কেবল রুপসী ও বুদ্ধিমতী ছিল না, ছিল উচ্চাকাঙ্খিও, মানে অ্যাম্বিশাস। সে তরুন সিরাজকে দেখত মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি প্রাসাদে। ভবিষ্যতের বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নওয়াব। সিরাজ সুদর্শন ও সুন্দর তরুণ। তবে যেন কিছু দুঃখী নওয়াব। তার কারণ আছে। সিরাজউদ্দৌলার প্রথম বিবাহ হয়েছিল ইরিজ খান নামে একজন অভিজাত ব্যক্তির কন্যার সঙ্গে, সেই মেয়ের নাম উমদাতুন্নিসা, অবশ্য তাকে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সবাই ‘বহু বেগম’ বলে ডাকত। উমদাতুন্নিসার কোনও সন্তানাদি হয়নি, তাছাড়া বহু বেগম আনন্দ-বিলাসে মগ্ন থাকে, নওয়াব-এর তেমন খোঁজখবর নিত না ...এসব কথা আমিনা বেগম জানতেন ... ওদিকে রাজকুনোয়ার আমিনা বেগমের মন জয় করেছিল। তিনি কৌশলে পুত্রের সেবায় রাজকুনোয়ার কে নিয়োজিত করেন (বিষয়টি আমাদের একালের অনেকের কাছে ‘অড’ লাগতে পারে) ... ওদিকে রাজকুনোয়ার-এর ব্যবহার অত্যন্ত মধুর, দেখতে রূপসী তো বটেই, যে কারণে নওয়াব তো মুগ্ধ হয়েই ছিল।
আসলে কেমন দেখতে ছিল রাজকুনোয়ার?
আমরা লক্ষ করি তরুণ নওয়াব রুপসী রাজকুনোয়ার কে কেবল হেরেমের রক্ষিতা হিসেবে ট্রিট করেন নি; ইচ্ছে করলে সেরকম সেই পুরুষশাসিত সময়ে করতে পারতেন, করেননি .. যে কারণে বাংলার ইতিহাসের এই পর্যায়ে আমরা অদম্য বন্য কামকে সমাহিত পবিত্র প্রেমে রুপান্তরিত হতে দেখি। কাজেই অপ্রাসঙ্গিক হলেও এক্ষণে একালের তুমুল জনপ্রিয় একটা বাউল গানের প্রথম দুটি কলি স্মরণ করি;
করি মানা কাম ছাড়ে না ... মদনে
আমি প্রেমরসিক হব কেমনে?
মুগ্ধ নওয়াব হিন্দু পরিচারিকা রাজকুনোয়ার কে বিবাহ করতে চায়, আমিনা বেগমও এ বিবাহে অসম্মত হন না, নওয়াব রাজকুনোয়ার কে বিয়ে করেন, ভালোবেসে রাজকুনোয়ার-এর নাম রাখেন লুৎফুন্নেসা বেগম।ধর্মান্তরিত লুৎফুন্নেসা বেগমের গর্ভে একটি মেয়ে হয়, ফুটফুটে মেয়েটির নাম জোহরা।
রাজকুনোয়ার-এর উচ্চাকাঙ্খি পরিকল্পনা সফল হয়।
কিন্তু সে কি পেল? যাকে পেল তার জীবনের সঙ্কট কি টের পেয়েছিল?
পলাশীর যুদ্ধ। একাত্তরের যুদ্ধের পাশাপাশি এই একটি যুদ্ধ যা বাঙালির মনে চিরকালের মতো দাগ কেটে আছে...
১৭৫৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের পর নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদ নগর থেকে একাকী পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লুৎফুন্নেসা কান্নায় ভেঙে পড়েন, তাঁকে সঙ্গে নেয়ার আকুল আবেদন করেন। ১৭৫৭ সনের ২৪ জুন। রাত। নওয়াব একমাত্র কন্যা জোহরা, লুৎফুন্নেসা এবং একজন অনুগত খোজসহ মুর্শিদাবাদ শহর ত্যাগ করে। ধরা পড়ে যেতে দেরি হয়নি। সপরিবারে নবাবকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনা হয়। মীরজাফরের জামাতা মীরকাসিম লুকানো সোনা-দানার সন্ধান চেয়ে লুৎফুন্নেসা ওপর অত্যাচার করে। মীরজাফর নবাবকে হত্যার আদেশ দেয় ...
এখন প্রশ্ন এই সেসময় মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সাধারন পরিচারিকা দের ভাগ্যে কি ঘটেছিল? তাদের ভাগ্যে তেমন বিপর্যয়কর কিছু ঘটার কথা নয়। তাদের প্রভূদের পরিবর্তন হয়েছিল মাত্র। রাজকুনোয়ার এর সহকর্মীদের কিছু হয়নি। রাজকুনোয়ার ততদিনে লুৎফুন্নেসা বেগম, কাজেই তাকে পরিবর্তিত ভাগ্যের কোপে পড়তে হয়েছিল।
বুড়িগঙ্গার পাড়ে জিনজিরা প্রাসাদ। বাংলার মুঘল সুবহাদার ২য় ইব্রাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৭) তাঁর প্রমোদ কেন্দ্র হিসেবে প্রাসাদটি নির্মান করেন। ১৭৫৮ সালে মীরজাফর নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের মহিলা সদস্যদের ঢাকায় নির্বাসিত করে এই জিনজিরা প্রাসাদে থাকার নির্দেশ দেন। এটি ঠিক কারাগার নয়, প্রাসাদ। তাই একে বিশেষ কারাগার বলা যায়। এই প্রসঙ্গে কারও কারও বিগত তত্ত্বাবধায়ক আমলের বিশেষ কারাগারের কথা মনে পড়তে পারে।
ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে লুৎফুন্নেসা বেগমের ৭ বছরের দুঃসহ জীবন কাটে । চরম দারিদ্র, দুঃসহ পরিবেশ। যৎসামান্য ভাতা আসত বটে, তবে তা ছিল অনিয়মিত। তার ওপর শোক, গভীর শোক, স্বামীর জন্য শোক। ১৭৮০ সাল। মীরজাফরের নির্দেশে মীরন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার মা আমেনা বেগম ও খালা ঘসেটি বেগমকে একটি নৌকায় তুলে সেটি ডুবিয়ে দেয়। তার আগে ১৭৬৫ সালে ক্লাইভ এর নির্দেশে লুৎফুন্নেসা বেগম, তার কন্যা জোহরা ও নওয়াব আলীবর্দীর স্ত্রী শরীফুন্নেছাকে মুক্ত করে মুর্শিদাবাদে আনা হয়।
কেন ক্লাইভ এই রকম হিতকারী সিদ্ধান্ত নিলেন যেখানে মীরজাফরের নির্দেশে মীরন আমেনা বেগম ও খালা ঘসেটি বেগম কে নৌকায় তুলে সে নৌকা বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিল? মুগল সেনানায়কের হিংস্রতার পাশাপাশি
একজন ব্রিটিশ সেনাধক্ষ্য উদারতা দেখাল। কী ভাবে একে ব্যাখ্যা করা যায়? মুঘলদের তুলনায় ব্রিটিনের উন্নত গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা? ব্রিটেনে (সাম্রাজ্যবাদী হওয়া সত্ত্বেও) নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ছিল বলে?
রবার্ট ক্লাইভ।
মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে শুরু হল দুঃসহ জীবন। লুৎফুন্নেসা বেগম এর জন্য রবার্ট ক্লাইভ তথা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ৬০০ টাকা ভাতা বরাদ্দ করেন। জোহরা ততদিনে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে। মীর আসাদ আলী খান নামে এক পাত্র জুটল। এককালের হাজারদুয়ারির মালিকের কন্যার বিবাহ সম্পন্ন হল অত্যন্ত সাদাসিদে ভাবে। যা হোক। একে একে চার চারটি কন্যা সন্তান মা হল জোহরা। স্বামী মীর আসাদ আলী খান আকস্মিক ভাবে মারা গেলেন। ১৭৭৪ সালে মারা গেল জোহরা। লুৎফুন্নেসা বেগম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এমন ভাবতেন কি- এর চে মুর্শিদাবাদের প্রাসাদের পরিচারিকার জীবন কি ভালো ছিল? ৬০০ টাকায় সংসার চলে না। ১৭৮৭ সাল। লর্ড কর্নওয়ালিশের কাছে ভাতা বাড়ানোর আবেদন করলেন। লর্ড কর্নওয়ালিশ নাকচ করে দিলেন সে প্রস্তাব।
বর্তমান মুর্শিদাবাদের একটি এলাকা । কোথায় ছিলেন দুঃখীনি লুৎফুন্নেসা বেগম?
মুর্শিদাবাদের খোশবাগ-এ ছিল নওয়াবদের সমাধিক্ষেত্র। আলীবর্দী খাঁ ও নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার সমাধির দেখাশোনার জন্য মাসে ৩০৫ টাকা পেতেন লুৎফুন্নেসা বেগম। এর সঙ্গে যোগ হত কোরআন পাঠ ও দান-খয়রাত।
আজও মুর্শিদাবাদ নগরের এরকম অনেক স্থাপত্য লুৎফুন্নেসা বেগমের জীবনের শূন্যতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ...
১৭৯০ স্বামীর কবরের পাশে নামাজ পড়ার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে লুৎফুন্নেসা বেগম। স্বামীর কবরের পাশেই কবর হয়েছিল লুৎফুন্নেসা বেগমের।
উৎসর্গ: কবি শিরীষ ও তায়েফ আহমেদ। এ দুজনেরই সেই বিশেষ সময়টা নিয়ে ‘অবসেসন’ রয়েছে।
ছবি ও তথ্যের উৎস: বাংলাপিডিয়া ও ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্যাদি ...