চেঙ্গিস খান: (১১৬৭-১২২৭) ছিলেন মধ্যযুগের দুধর্ষ মঙ্গোল নেতা। মানবসভ্যতার সবচে বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আজও অমর হয়ে রয়েছেন। চেঙ্গিস খান তাঁর জীবদ্দশায় একবার বলেছিলেন, It is forbidden ever to make peace with a monarch, a prince or a people who have not submitted. চেঙ্গিস খানকে নেপোলিয়ন ও আলেকজান্দারের সমকক্ষ মনে করা হয়। যদিও নেপোলিয়ন কিংবা আলেকজান্দার চেঙ্গিস খান এর মতো ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশের স্থপতি নন । চেঙ্গিস খান এর ছেলেরা এমন এক সাম্রাজ্য শাসন করে গেছেন- যে সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল রাশিয়ার ইউক্রেইন থেকে কোরিয়া অবধি । তাঁর দৌহিত্ররা চিন, পারস্য ও রাশিয়ায় শক্তিশালী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিল । তাঁর বংশধরেরা ছিল মধ্য এশিয়ায় পরাক্রমশালী সম্রাট।
রাশিয়া। সাইবেরিয়া। সাইবেরিয়ার দক্ষিণে হ্রদ বৈকাল। হ্রদ বৈকাল ধারেই একটি নদী। নদীর নাম ওনান । (জায়গাটা মঙ্গোলিয়ার উত্তরে) সেই ওনান নদীর পাড়েই মধ্যযুগের দুধর্ষ মঙ্গোল সম্রাট।এবং চেঙ্গিস খান-এর জীবনের গল্পটা শুরু হতে পারে এভাবেই ...ওনান নদীর কথা বললাম। নদীটি পরে চেঙ্গিস খান-এর জীবনে দারুন প্রভাব রেখেছিল। সে কথায় পরে আসছি। চেঙ্গিস খান-এর জন্ম সম্বন্ধে স্থানীয় মঙ্গোল লোককাহিনী অদ্ভূত অদ্ভূত সব কথা বলে। বলে যে চেঙ্গিস খান-এর পূর্বপুরুষের নাকি উত্থান ঘটেছে ধূসর নেকড়ে ও মাদী হরিনের মিথীয় সম্মিলন থেকে । জন্মাবার পর নবজাতকের হাতে নাকি ছিল রক্তের দলা! কেন? শিশুটি বিশ্ববিজয়ী হবে বলেই...। এমন কথা মঙ্গোলরা বলতেই পারে। কেননা, এরা এখন যতই সভ্য হোক, একাদশ/দ্বাদশ শতকের মঙ্গোলরা ছিল আসলে যাযাবর। মঙ্গোলদের ধর্ম ছিল শামানবাদ। শামানবাদ কি? শামানবাদ হল এক ধরনের তান্ত্রিকতা। এ ছাড়া মঙ্গোলরা পূর্বপুরুষের আত্মার পূজাঅর্চনাও করত । মঙ্গোলদের একটি বৃহৎ অংশের ধর্ম ছিল তেনগ্রিবাদ। তেনগ্রি ছিলেন আকাশদেবতা। নাকি দেবী? সেই তেনগ্রি দেবতাই নাকি সব কিছুর নিয়ন্ত্রা। তাই বলছিলাম, চেঙ্গিস খান-এর পূর্বপুরুষের উত্থান ঘটেছে ধূসর নেকড়ে ও মাদী হরিনের মিথীয় সম্মিলন থেকে । নবজাতকের হাতে নাকি ছিল রক্তের দলা! শিশুটি বিশ্ববিজয়ী হবে বলেই... এমন কথা পৌরানিক উপকথায় বিশ্বাসী মঙ্গোলরা বলতেই পারে।
যাক।
চেঙ্গিস খান-এর বাবার নাম ইয়েসুগেই। তিনি ছিলেন পূর্ব মঙ্গোলিয়ার স্থানীয় মঙ্গোল সর্দার। মঙ্গোল গোত্রের শাসকদের বলা হত খান। ইয়েসুগেই ছিলেন খান-এর ভাইয়ের ছেলে ছিলেন। পূর্ব মঙ্গোলিয়ায় দীর্ঘদিন ছিল মঙ্গোল গোত্রের শাসন। মঙ্গোলদের প্রতিদ্বন্দি গোত্র ছিল তাতাররা। ১১৬১ সালে তাতাররা মঙ্গোলদের পরাজিত করে; তাতাররা উত্তর চিনের জিন গোত্রের সঙ্গে সন্ধি করে মঙ্গোলদের পরাজিত করেছিল। এরপর থেকে পূর্ব মঙ্গোলিয়ায় মঙ্গোলদের আধিপত্য কমে যেতে থাকে।
যাক। চেঙ্গিসের জন্ম সময়ে চেঙ্গিসের বাবা ইয়েসুগেই একজন তাতার গোত্রপ্রধানকে বন্দি করেছিলেন। সেই বন্দি তাতার গোত্রপ্রধানের নাম ছিল তেমুজিন। নামটা ইয়েসুগেই -এর পছন্দ হয়েছিল । ইয়েসুগেই ছেলের নাম রাখল তেমুজিন।
তেমুজিন এর বয়েস নয় হলে একটা ঘটনা ঘটল।
ওর বাবা ওকে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে রওনা হলেন।। গন্তব্য: পূর্বমঙ্গোলিয়ার সর্বশেষ সীমানা। ওটা ছিল কোনকিরাত গোত্রের এলাকা। তারাই তেমুজিন এর মায়ের গোত্রের লোকজন। আসলে ইয়েসুগেই ওখানে গেছিল ছেলের পাত্রী খুঁজতে; পাত্রী পাওয়া গেল। নাম-বোরতে। বয়স ১০। সেকালের প্রথা ছিল কন্যাবস্থায় কন্যার হবু শ্বশুড় কন্যাকে কন্যার পৃতগৃহ থেকে নিয়ে লালনপালন করবে। তাইই হল। যৌতুক হিসেবে তেমুজিন পেল বাদামি পশমের কোট।
এর পরের ঘটনাটি বেশ নাটকীয়।
কিছুকাল পরের কথা। ইয়েসুগেই ফিরছিলেন বাড়ি। পথে একদল তাতারের সঙ্গে তার দেখা। তারা বলল, আসুন, খানা খান।
ইয়েসুগেই রাজী হলেন। তাতাররা তাকে তাবুতে নিয়ে গেল। তাতারদের মধ্যে একজন পুরনো শক্রকে চিনে ফেলল। সে ইয়েসুগেই এর খাবারে বিষ দিল। ইয়েসুগেই টের পেয়েই কোনও মতে তাবু থেকে বেরিয়ে ঘোড়ায় চড়ে মঙ্গোল সীমান্তে পৌঁছতে পারলেন। মঙ্গোল গোত্রের কজন ছুটে এসেছিল। ইয়েসুগেই ধুকতে ধুকতে তাদের বললেন, আমি ... আমি বোধহয় বাঁচব না। আমি মরলে সর্দার হবে তেমুজিন -আমার ছেলে। বলে ইয়েসুগেই মারা গেল।
তাইচিয়ুত নামের গোত্রের নেতারা চাইছিল মঙ্গোলদের গোত্রপ্রধান হবে। এ উদ্দেশ্যে তারা ইয়েসুগেই -এর স্ত্রী আর তার সন্তানদের একঘরে করে ফেলল।
তেমুজিন এর বিধবা মা ওদের স্বপক্ষে টানার চেষ্টা করলেন। লাভ হল না। কাজেই বিপদ এড়াতে অন্যত্র চলে যেতে লাগল। তেমুজিন বড় হতে লাগল। তাইচিয়ুত তেমুজিন দের তাবু আক্রমন করল। ভাগ্যিস মা আর বউ ছিল সেই পূর্বমঙ্গোলিয়ার সর্বশেষ সীমানা। ওটা ছিল কোনকিরাত গোত্রের এলাকা। তেমুজিন নিকটবর্তী অরণ্যে পালাল । শেষরক্ষা হল না। শেষে তাইচিয়ুত দের হাতে বন্দি হল। তাইচিয়ুত রা অবশ্য তেমুজিন কে মেরে ফেলল না। বন্দি হিসেবে রাখল। গলায় কাঠের তৈরি রিং পরিয়ে বন্দি করে রাখল। এক রাতে। ওনান নদীর ধারে খাওয়াদাওয়া করছিল তাইচিয়ুত গোত্রের লোকেরা। প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তেমুজিন নদীতে নেমে গেল...যা হোক। একজন চিনে ফেলেছিল। সেই বাঁচাল। তার সঙ্গে কিছু খাতির হয়েছিল- সেই তাইচিয়ুত গ্রোত্রপ্রধানকে বলল, রাতে খুঁজে আর কী হবে-ভোর হোক। তাইচিয়ুত গ্রোত্রপ্রধানকে কথাটা মেনে নিল। পরে, অনেক রাতে তেমুজিন ওর প্রাণরক্ষাকারীর তাঁবুর কাছে চলে যায়। সে তেমুজিন কে লুকিয়ে রাখে। পরে পালাতে সাহায্য করে।
তেমুজিন এরপর পূর্বমঙ্গোলিয়ার সর্বশেষ সীমানায় চলে যায়।
তেমুজিন এর মায়ের কোনকিরাত গোত্রের লোজন কাছে। গোত্রের নাম । তারা তাকে আশ্রয় দেয়। মা আর বউয়ের সঙ্গে পুর্নমিলন হয়।
এরপর তেমুজিন মধ্য মঙ্গোলিয়ায় আসে।
মধ্যমঙ্গোলিয়া তখন শাসন করত কেরেইট গোত্রের শক্তিশালী শাসক তুঘরিল। তুঘরিণ তেমুজিন এর বাবার মিত্র ছিলেন। মনে থাকার কথা। যৌতুক হিসেবে বাদামি পশমের কোট পেয়েছিল তেমুজিন। সেটিই সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে তুঘরিলকে উপহার দেয়। উপহার পেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে তুঘরিল বললেন, আচ্ছা আমি তোমার দায়িত্ব নিচ্ছি। হাজর হলেও তোমার বাবা আমার মিত্র ছিলেন। মহান ইয়েসুগেই! দুরাত্মা তাতাররা হত্যা করেছে।
এইকথা শুনে তেমুজিনের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।
উত্থান
মঙ্গোলিয়ার উত্তরে ছিল এক গোত্র। মেরকিত। তারা তেমুজিনের তাবু আক্রমন করে বসল। মেরকিতরা তেমুজিনের বউকে নিয়ে পালাল। তেমুজিন তুগরিলকে বলল, সাহায্য করুন। জামুকা নামে এক মঙ্গোল সর্দারকেও তেমুজিন সাহায্য করতে বলে। তিন জনে মিলে তেমুজিনের বউকে উদ্ধার করে; এরপর মেরকিত গোত্রকে নিশ্চিহ্ন করে । এরপর অনেক দিন পর্যন্ত জামুকা আর তেমুজিন আর জামুকা বন্ধু হিসেবে পাশাপাশি পশুপালন করে। পরে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এই সময়েই মঙ্গোলরা তেমুজিনকে তাদের নেতা নির্বাচিত করে। তেমুজিনের উপাধি হয় চেঙ্গিস খান। যার মানে, বৈশ্বিক (সর্বজনীন অর্থে) প্রভূ।
দ্বাদশ শতকের বিশ্ব
এর পর আর্ন্তগোত্রীয় যুদ্ধে প্রধান ভূমিকা রাখতে শুরু করলেন চেঙ্গিস। যদিও তুঘরিলের পোষ্য হিসেবেই থাকলেন। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দ। মঙ্গোলরা তাতার অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। সঙ্গে সেই জিন গোত্রকেও ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেয়। ১২০২ সালে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এরপর তাতাররা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । যাই হোক। এই সময়রে তুঘরিলের সঙ্গে চেঙ্গিস খানের সম্পর্ক অবনতি হয়। ১২০৩ সালে তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়। যুদ্ধ শেষ না হতেই- চেঙ্গিস মঙ্গোলিয়ার উত্তরের গভীর অরণ্যে চলে গেলেন। পরের বছর শক্তি বৃদ্ধি করে ফিরে এলেন। এক এক করে বিরোধীদের সম্পূর্ন নিশ্চিহ্ন করলেন। এরপর মধ্য ও পূর্ব মঙ্গোলিয়ার ওপর স্বীয় কর্তৃত্ব স্থাপন করলেন।
১২০৬ খ্রিস্টাব্দ। বসন্তকাল। ওনান নদীর উৎসমুখে মঙ্গোল রাজকুমারদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। সে সম্মেলন শেষে চেঙ্গিসকে বলা হল, ‘মহৎ খান।’
এরপর সামরিক বাহিনী পুর্নগঠনের কাজে অগ্রসর হলেন চেঙ্গিস ।
চেঙ্গিস খান সম্পর্কে গোড়ার কথাই এই -ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশের স্থপতি চেঙ্গিস খান। প্রায় অপ্রতিরোধ্য এক বিপুলসংখ্যক সৈন্যবাহিনীর অধিশ্বর ছিলেন চেঙ্গিস। যে বাহিনী ছিল সুশৃঙ্খল, যে বাহিনীর ‘চেইন অভ কমান্ড’ ছিল অটুট, ছিল তুখোর গতিশীলতা আর উদ্ভাবনী সামরিক রণকৌশলে পূর্ন। ১০, ০০০ অশ্বারোহী মঙ্গোল সৈন্যদের সাজানো হত নানা বিন্যাসে ।
মঙ্গোল সৈন্য
মঙ্গোল সৈন্যবাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল হঠাৎই আক্রমন করে বসা। যাকে বলে সারপ্রাইস অ্যাটাক। সামনে থেকে শক্রপক্ষকে আক্রমন করে পর্যুদস্ত করে মঙ্গোল সৈন্যরা সহসাই পিছন থেকে আক্রমন করে দিশেহারা করে ফেলত প্রতিপক্ষকে। শক্রর প্রাথমিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে ফেলে মঙ্গোলরা অঞ্চলটি ঝড়ের গতিতে তছনছ করে ফেলত। সৈন্যদলের যোগাযোগ রক্ষা করা হত ড্রামবিট আর সাংকেতিক পতাকা উড়িয়ে। মঙ্গোল সৈন্যরা অতিদ্রত সেনাপতিদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করত । প্রতিটি মঙ্গোল সৈন্যই ছিল দক্ষ তীরন্দাজ ও নিপুন অশ্বারোহী। তাদের বর্ম ছিল চমড়ার। ছিল কার্যকরী ধনুক ও তীর । মঙ্গোল সৈন্যদের তরবারিটি ছিল বাঁকানো -ক্ষুরধার। চেঙ্গিস খান এর সাফল্য সম্বন্ধে জনৈক ঐতিহাসিক বলেছেন,The instrument of his victories, the superbly efficient Mongol army, seems to have owed nothing to foreign models. It was developed and perfected in intertribal wars before it was turned, with irresistible effect, against the nations of Asia and Eastern Europe. It is, in fact, as a military genius that Genghis Khan lives in history.
চিন বিজয়
১২০৫ খ্রিস্টাব্দেই তাঙগুটসদের আক্রমন করেছিল চেঙ্গিস খান-এর অনুগত মঙ্গোল সৈন্যরা। এই তাঙগুটসদের শিকড় তিব্বত এ। ওরা বাস করত এখনকার চিনের ওরডস আর কানসু অঞ্চলে। ১২০৭ ও ১২০৯ খ্রিস্টাব্দেও চেঙ্গিস খান-এর অনুগত মঙ্গোল সৈন্যরা তাঙগুটসদের ওপর চরম আঘাত হানে। এতে করে চিনের মূল ভূখন্ডে পৌঁছনোর পথ যায় খুলে । ১২১১ খ্রিস্টাব্দ। চিনের প্রাচীরের উত্তর অংশে হানা দেয় মঙ্গোলরা। ১২১৩ খ্রিস্টাব্দে তারা প্রাচীরে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়। ১২১৫ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে মঙ্গোল সৈন্য পিকিং আক্রমন করে; নগরটি তারা তছনছ করে। চিনের সম্রাট পিকিং ছেড়ে পালালেন কাইফেং । কাইফেং জায়গাটা হলুদ নদীর দক্ষিণে। এরপর একজন সেনাপতির অধীনে চিনের দায়িত্ব দিয়ে চেঙ্গিস খান মঙ্গোলিয়ায় ফিরে যান।
পরিবার, ধর্ম, ও অন্যান্য
মঙ্গোলিয়ান ভাষা ছাড়া চেঙ্গিস খান অন্য কোনও ভাষা জানতেন না। তবে বিদেশি ভাষা না-জানলেও চেঙ্গিস খান বিচক্ষন বলেই মঙ্গোলিয়ার সীমানার বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে খবর রাখতেন ঠিকই। তাঁর উত্থানের প্রথম পর্যায়েই তিনি মধ্য এশিয়ার মুসলিম বণিকদের গুরুত্ব বুঝেছিলেন; পরিনত বয়েছে তাঁর পরামর্শদাতাদের মধ্যে বেশ ক’জন চৈনিকও ছিল ।
অবশ্য তাঁর সময়ে লোকে তাকে ডাকাত সর্দারের বেশি মর্যাদা দেয়নি। জনগন কি তলিয়ে দেখেনি যে সামান্য ডাকাত সর্দারের পক্ষে চিন ও পশ্চিম এশিয়া জয় করা সম্ভব না!
চেঙ্গিস খান তাঁর সদ্য প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ সাম্রাজ্যটি আইনের ওপর শক্ত করে দাড় করিয়েছিলেন। স্থানীয় প্রথার ওপরই তৈরি হয়েছিল সে আইন-যাকে মঙ্গোলরা বলত- মহৎ ইয়াসা।
একজন ডাকাত সর্দারের তো এতটা ভাবার কথা না। এ ছাড়া চেঙ্গিস খান এর উপদেষ্টাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাঁর মা। তিনি, অর্থাৎ চেঙ্গিস খান এর মা যুদ্ধে অনাথ শিশুদের দেখাশোনা করতেন।
চেঙ্গিস খান ডাকাত সর্দার ছিলেন না।
প্রশ্ন উঠতে পারে চেঙ্গিস খান এর ধর্ম কি ছিল?
এর উত্তর -চেঙ্গিস খান-এর ধর্ম ছিল এক ধরনের শামানবাদ। শামানবাদ হল এক ধরনের তান্ত্রিকতা। শামান বলতে গুনীন বা ওঝা বোঝায়। আগেই আমি বলেছি যে- মঙ্গোলরা আসলে যাযাবর। ওদের ধর্ম ছিল তেনগ্রিবাদ। তেনগ্রি ছিলেন আকাশদেবতা। মঙ্গোলরা পূর্বপুরুষ পূজা করত। চেঙ্গিস খান অবশ্য ধর্মের বিষয়ে ছিলেন উদার।
তৎকালীন রীতি অনুযায়ী চেঙ্গিস খান-এর বহু স্ত্রী ছিল। তবে প্রথমা স্ত্রী বোরতেই ছিলেন প্রধানা। তারই গর্ভে চেঙ্গিস খান-এর চারটি পুত্র জন্মেছিল। এদের নাম যথাক্রমে: জোচি, জাগাতাই, ওগোদেই এবং তোলুই। জোচির ছেলের নাম ছিল বাতু। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে এক শক্তিশালী মঙ্গোলরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বাতু । রাজ্যটির নাম: গোলডেন হোরড। জাগাতাই পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়ায় একটি সামাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ওগোডেইকে চেঙ্গিস খান তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেছিলেন; ওগোডেই মঙ্গোলিয়া ও উত্তর চিন শাসন করেছিল। তোলুই ছিলেন মানগুর পিতা। মানগু ১২৫১ থেকে ১২৫৯ অবধি মঙ্গোলিয়া শাসন করেছিলেন । তোলুই। এর আরও দুজন বিখ্যাত পুত্র ছিল। এদের নাম কুবলাই খান ও হালাগু খান। কুবলাই খান চিনে য়ুয়ান বংশ স্থাপন করেছিলেন। তোলুই। হালাগু খান পারস্যে ইল-খানিদ বংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
পশ্চিম অভিযান ও মৃত্যু
এবার চেঙ্গিস খান-এর এর বাদবাকি অভিযানের কথায় ফিরি।
মনে থাকার কথা-আমি তখন বলছিলাম যে- ১২১৫ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে মঙ্গোল সৈন্য পিকিং আক্রমন করে; নগরটি তারা তছনছ করে। চিনের সম্রাট পিকিং ছেড়ে পালালেন কাইফেং । কাইফেং জায়গাটা হলুদ নদীর দক্ষিণে। এরপর একজন সেনাপতির অধীনে চিনের দায়িত্ব দিয়ে চেঙ্গিস খান মঙ্গোলিয়ায় ফিরে যান ...
মধ্য এশিয়ায় কুচলুগ দ্য নাইমান নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল। সে কারা খিতাই নামে একটি রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল; সে সেখানকার শাসককে উৎখাত করে। চেঙ্গিস খান-এর নির্দেশে কাশগর থেকে মঙ্গোল সৈন্যরা কুচলুগ দ্য নাইমান কে অনুসরন করে পামির মালভূমি পেরিয়ে আফগানিস্তানে পৌঁছে যায়। এরপর মঙ্গোল সৈন্যরা কুচলুগ দ্য নাইমান কে হত্যা করে। এভাবে এসব অঞ্চল মঙ্গোল সৈন্যদের তথা চেঙ্গিস খান-এর অধিকৃত হলে যায়। খিবা বা খোরেজম ছিল মধ্য এশিয়ারপশ্চিমে বৃহৎ একটি খানেত। আমি আগেই বলেছি ‘খান’ হল মঙ্গোল অধিপতিদের উপাধি; এবং সেকালে এদেরই অধিকৃত অঞ্চলকে বলা হত খানেত। খিবা বা খোরেজম-এর শাসক সুলতান মুহাম্মদ সমগ্র মধ্য, এশিয়া আফগানিস্তান ও পারস্যের (ইরানের) ইরানের কিয়দংশ নিজ দখলে নিয়েছিলেন। ফলে, অনিবার্যভাবে মঙ্গোল সৈন্যরা খিবার শাসক সুলতান মুহাম্মদের মুখোমুখি হয়ে যায়।
সির দরিয়া নদীর পাড়ে ছিল সুলতান মুহাম্মদের নিয়ন্ত্রানাধীন ওতরার নগর। সে নগরে দূত পাঠিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান । সুলতান মুহাম্মদের অনুগত সৈন্যরা দূতকে হত্যা করে। ১২১৯ খিস্টাব্দ; বসন্ত কাল। সুলতান মুহাম্মদকে নিশ্চিহ্ন করতে মঙ্গোলিয়া থেকে চেঙ্গিস খান রওনা হলেন । ওতরার নগর অবরোধ করেন। চেঙ্গিস খান দুজন সেনাপতি পাঠালেন সুলতান মোহম্মদকে কতল করার জন্য। সুলতান মোহম্মদ পারস্যে পালিয়েছিলেন। শেষমেশ সুলতান মোহম্মদকে কাসপিয়ান সাগরের এক দ্বীপে মৃত্যুর মুখোমুখি হন। ১২২০ খ্রিস্টাব্দ। চেঙ্গিস খান সসৈন্য বুখারা এলেন। বুখারার পতন হল। বুখারার পর সমরখন্দ অধিকৃত হল মঙ্গোলদের। এরই মধ্যে ওতরার নগরেরও পতন হল।
ওদিকে পশ্চিমমুখী আক্রমন চলছিলই। মঙ্গোল সেনাপতিরা ককেশাস পাড়ি দিয়ে ক্রিমিয়ায় পৌঁছে। ক্রিমিয়ায় রুশ ও কিপচাক তুর্কিদের পরাজিত করে। এরপর মঙ্গোল সৈন্যরা কাসপিয়ান সাগরের উত্তর পাড়ে পৌঁছয়। সেখানে চেঙ্গিস খান অপেক্ষা করছিলেন।
১২২০ সালের গ্রীষ্মটি চেঙ্গিস খান সমরখন্দের দক্ষিণের একটি পাহাড়ে কাটান। এরপর তাঁর নির্দেশে সৈন্যরা তেরমেজ শহর আক্রমন ও দখল করেন। এরপর ১২২০/২১ সালে চেঙ্গিস খান তাজাকিস্তানে সমরাভিযান পরিচালনা করেন।
১২২১ সালের প্রথম দিকে অক্সাস নদী পেরিয়ে সুপ্রাচীন বলখ নগরী ধ্বংস করেন। বলখ সে সময় পারস্যের খোরাসানের অংশ ছিল। সে সময় সুলতান মুহাম্মদের ছেলে সুলতান জালালউদদীন কাবুলের কাছে একযুদ্ধে মঙ্গোলদের পরাজিত করেছিল। চেঙ্গিস খান সসৈন্য সিদ্ধু নদের পাড়ে পৌঁছান। দুপক্ষের যুদ্ধ হয়। সুলতান জালালউদদীন পরাজিত হলেন। নদীতে ঝাঁপিয়ে প্রাণে বাঁচলেন।
১২২৫ খ্রিস্টাব্দ। মঙ্গোলিয়ায় ফিরে গেলেন চেঙ্গিস খান । পরের বছর তাংগুটস্ দের সঙ্গে আবার যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। মনে থাকার কথা। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দেই তাঙগুটসদের আক্রমন করেছিল চেঙ্গিস খান-এর অনুগত মঙ্গোল সৈন্যরা। যুদ্ধের স্থান। লিপুয়ান পাহাড়। কানসু। অগাস্ট ২৫। ১২২৭। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মারা গেলেন।