বাংলার একতারাবাদীদের নিয়ে কৌতূল আজও গেল না। কি খোঁজে তারা? কেন গান গায়? গানে কি কথা বলে তারা? কেন তারা এত সহজসরল? কেন নারীকে সেজদা করে? একতারার গঠনও কেমন যেন । রহস্যময়। নারীমূল থেকে একটি একেশ্বরবাদী তার যেন চলে গেছে কোন্ অনন্তে ...
ভাবছিলাম। কোন্ গানে লালনের মূল ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে । লালনসমগ্রর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে তেমন একটি গান পেয়েও গেলাম: এক অজানা মানুষ ফিরছে দেশে ...। এরকম গান অবশ্য আরও আছে। তবে এই গানে যেন বাউলদর্শনের সবকটা কথাই আছে। তবে সে গানের ব্যাখ্যাবয়ান শুরু করার আগে বলে নিই যে-লালনের গানের লালনপন্থিদের ব্যাখ্যা হয়ত অন্য রকম; আমি ঠিক লালনপন্থি নই, কেননা আমার হৃদয়ে লালনপন্থিদের হৃদয়ের মতন অতটা নির্মল বিশুদ্ধতা অনুভব করিনি কোনওদিনই। আমি পিছনের সারির সামান্য এক লালনভক্ত মাত্র। লালনের গানের এসব ব্যাখ্যা ও বয়ান সেই কারণেই এক সামান্য ভক্তের ...এর বেশি কিছু না।
গান
এক অজানা মানুষ ফিরছে দেশে
তারে চিনতে হয়
তারে চিনতে জানতে হয়।
শরীয়তের বুনিয়াদে
পাবে না তা কোনমতে,
জানা যাবে মারফতে
যদি মনের বিকার যায়।
মূল ছাড়া এক আজগৈবি ফুল
ফুটেছে সে ভবনদীর কূল
চিরদিন এক রসিক বুলবুল
সেই ফুলেরই মধু খায়।
শুনেছি এক মানুষের খবর
আলেফের জের মীমের জবর
লালন বলে হস্নে ফাঁফর
মুরশিদ ধরলে জানা যায় ।
বয়ান
যদি বলি, সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই কৌতূহলী মানুষের মূলত এই কথাটাই বলতে চেয়েছে।
এক অজানা মানুষ ফিরছে দেশে
তারে চিনতে হয়
তারে চিনতে জানতে হয়।
লালন অবশ্য এই গানে ‘এক অজানা মানুষের’ কথা বলেছেন; যে মানুষ ‘ফিরছে দেশে।’ কি এর মানে? দেশ বলতে কি আমরা ‘টাইম অ্যান্ড স্পেস’ বুঝব-যাকে বলে দেশকাল? তাইই যদি হয়, তাহলে অজানা মানুষ ‘ফিরছে দেশে’-এর মানে দাঁড়ায় টাইম অ্যান্ড স্পেস -এ কোনও অদৃশ্য সত্তার মুভমেন্ট বা আন্দোলন; খাঁটি বাংলায় যাকে বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে বা নড়াচড়া করছে। সেই অদৃশ্য সত্ত্বা সম্বন্ধে লালন বলেছেন-
তারে চিনতে হয়
তারে চিনতে জানতে হয়।
হ্যাঁ, তারে না চিনলে তো জীবনই বৃথা। মধ্যযুগের দার্শনিক আবু রুশদ যেমন বলেছেন-সত্য একটাই। সেই সত্যের কাছে পৌঁছবার পথ দুটি। (১) ধর্ম। (২) দর্শন। লালন কোন্ পথটি বেছে নিয়েছিলেন আমরা তা জানি। যে কারণে লালন উচ্চারণ করেছিলেন নির্ভয়ে-
শরীয়তের বুনিয়াদে
পাবে না তা কোনমতে,
জানা যাবে মারফতে
যদি মনের বিকার যায়।
পাবে না ‘তা’ কোনমতে, এই ‘তা’ হচ্ছে সেই সত্য-যা সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে কৌতূহলী মানুষকে ভাবাচ্ছে। লালনের মতে শরীয়তের বুনিয়াদ- তোলা জলে স্নান-এর বেশি কিছু না। মানুষ যে তার চেয়েও বড়। বিশ্বপ্রকৃতি যে উপাদানে গঠিত- মানুষও সেই একই উপাদানে গঠিত। সেই মানুষেরে (নারী/পুরুষ) সামান্য দিকনির্দেশনা কি করে বাধতে পারে? সে মানুষ তোলা জলে স্নান করবে কি -তার অবগাহনের জন্য চাই প্রশান্ত মহাসমুদ্রের নীল লোনাজল, তার অধ্যয়নের জন্য চাই নক্ষত্রের আলোকোজ্জ্বল পাঠশালা, কিংবা গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন তমসা, তার দূর্বার প্রেমসঙ্গমের জন্য চাই সমগ্র বাৎসায়ণ যৌনকৌশল, তার অবিশ্বাসের জন্য চাই জগতের সংকীর্ণ সব ধর্মপীঠসমূহ! তার বিদ্রোহের জন্য চাই রাজপথ, দূতাবাস-রাজতন্ত্র গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। কাজে কাজেই, লালন রোম্যান্টিকহেতু মনে করেন যে- এই মানুষেরে (নারী/পুরুষ) সামান্য দিকনির্দেশনা কি করে বাধতে পারে?
এবং মারফতের অবস্থান এই সীমাবদ্ধ দিকনির্দেশনার বিপরীতে।
মারফত হল সেইসব অসীম মানুষের পথ; যে পথ স্বাধীন -যে পথে যেতে যেতে সে তার উপলব্দিকে শানিত করে কোনও প্রকার দিকনির্দেশনা ছাড়াই। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তার মতো করে উপলব্দিতে পৌঁছে।
গানটির তৃতীয় অনুচ্ছেদে লালন বলছেন,
মূল ছাড়া এক আজগৈবি ফুল
ফুটেছে সে ভবনদীর কূল
চিরদিন এক রসিক বুলবুল
সেই ফুলেরই মধু খায়।
লালন মূলত শিল্পী। শিল্পীরা তাদের মনের ভাব প্রকাশে প্রতীক সঙ্কেতের আশ্রয় নেন। ওপরের চারটি লাইনে লালন তাইই করেছেন- প্রতীক সঙ্কেতের আশ্রয় নিয়েছেন । দ্বিতীয়ত শিল্পীদের প্রিয় বিষয় হল-জীবন ও জগৎ ও এর উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ। এ প্রসঙ্গে লালন লিখেছেন -
মূল ছাড়া এক আজগৈবি ফুল
ফুটেছে সে ভবনদীর কূল
জীবন এখানে মনে হচ্ছে ফুলের প্রতীক। তো ফুল মূল ছাড়া কেন? কথাতো সেটাই। জীবনের উদ্ভব বা সৃস্টির মূলের ঠিকঠিকানা কি? লালন অন্য একটি গানে এই প্রশ্ন তুলেছেন-
কে বানাইল এমন রঙমহলখানা?
তা এই রঙমহলখানা কি আজগুবি নহে? আজও এর মূলের সরুপ জানা গেল না বলে আজগৈবি? তো সে ফুল ফুটেছে ভবনদীরকূলে। ভবনদীরকূল কি প্ল্যানেট আর্থ? আবার ভবনদীরকূল সুজলাসুফলাশষ্যশ্যামলা বাংলাও হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।
এই হচ্ছে ভবনদী ...
ভবনদীর কূল সোলার সিসটেম কি? নাকি মিলকিওয়ে?
যাক। অগ্রসর হই।
শুনেছি এক মানুষের খবর
আলেফের জের মীমের জবর
লালন বলে হস্নে ফাঁফর
মুরশিদ ধরলে জানা যায় ।
এ চারটে চরণে প্রচলিত ধর্ম সম্বন্ধে লালনের সংশয় প্রকাশ। আগের চারটে চরণ স্মরণ করি।
শরীয়তের বুনিয়াদে
পাবে না তা কোনমতে,
জানা যাবে মারফতে
যদি মনের বিকার যায়।
শুনেছি এক মানুষের খবর ... কোন্ মানুষ? এর উত্তর খুঁজতে প্রথম তিনটি লাইনে ফিরে যাই-
এক অজানা মানুষ ফিরছে দেশে
তারে চিনতে হয়
তারে চিনতে জানতে হয়।
লালন বলছেন, এই অজনা মানুষকে বা এই নিরাকার সত্ত্বাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ধর্মীয় শাস্ত্রকারেরা পড়ে গেছে বিপাকে । অন্য একটি গানে লালন বলেছেন-
পাবে সামান্যে কি তার দেখা
বেদে নাই যার রুপরেখা ...
স্বয়ং বেদ যাকে ব্যাখ্যা করতে পারেনি, অন্যরা আর কি পারবে? সমগ্র আদিঅন্তহীন বিশ্বের বস্তুচৈতন্য কি আর সামান্য ভাষায় প্রকাশ পায়? সে জন্য দরকার অনুভূতির। ভাষা পরম বাস্তবতা প্রকাশে অপারগ। তখন আমি বলছিলাম: মধ্যযুগের দার্শনিক আবু রুশদ বলেছেন-সত্য একটাই। সেই সত্যের কাছে পৌঁছবার পথ দুটি। (১) ধর্ম। (২) দর্শন। লালন কোন্ পথটি বেছে নিয়েছিলেন আমরা জানি।
সবশেষে লালন বলছেন-
লালন বলে হস্নে ফাঁফর
মুরশিদ ধরলে জানা যায় ।
কথাটা ঠিক আছে। মুরশিদ মানে গুরু। হ্যাঁ, গুরু অনেক কিছু জানেন বটে। যেমন লালন। লালন আমাদের মুরশিদ। এই একুশ শতকেও।
সবশেষে ভাবছি, এই গানটির সুরটি কি রকম? গানটি তো শোনা হয়নি। লালনসমগ্র পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল-
এক অজানা মানুষ ফিরছে দেশে
তারে চিনতে হয়
তারে চিনতে জানতে হয়।
তারপর কিছু ভাবনা মাথায় এল। যে কারণে এই পোস্ট। আরও ভাবলাম, গানটা যে শুনিনি - সেটা এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। গানের সুরটা ঠিক কেমন তা নিয়ে ভাবা যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৯:১৫