গ্রিক দার্শনিক জেনোফোনেস; সেই প্রাচীন যুগেই বলেছিলেন “Men create the gods in their own image.” প্রাচীন গ্রিসের সেই সক্রেটিক-পূর্ব যুগে প্রচলিত বহু ঈশ্বরবাদী ধর্মীয় বিশ্বাস অস্বীকার করে গ্রিক দার্শনিক জেনোফোনেস উপনীত হয়েছিলেন এমন এক একেশ্বরবাদী ধারনায় - যা বিস্ময়কর ভাবেই পরবর্তীকালের খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদী ধ্যানধারনায় সঙ্গে তুলনীয় ...
প্রাচীন গ্রিসের ব্যাপ্তি ছিল ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশজুড়ে। মাঝখানে দ্বীপবহুল এজিয়ান সমুদ্র- এর পশ্চিমে ইউরোপীয় গ্রিসের মূল ভূখন্ড ও এর পূর্বে (এশিয়ার )আইওনিয় গ্রিস। এই আইওনিয় গ্রিসের সুমধুর এয়েলিয় ভাষাতেই একদা হোমাদের মহাকাব্য গীত হয়েছিল- এই আইওনিয় গ্রিসের মাইলেটাস নগরেই মহান দার্শনিক থালেস জন্ম দিয়েছিলেন সভ্যতার প্রথম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার।
মানচিত্রে এশিয়া মাইনর ; পুবে লিদিয়া। এরই দক্ষিণে ছিল কোলোফোন নামে ছোট নগরটি ...
যা হোক। আইওনিয় গ্রিসে অনেকগুলি নগররাষ্ট্র ছিল। লিডিয়া তারই একটি। কোলোফোন নামে ছোট নগরটি ছিল লিডিয়ার দক্ষিণে । দার্শনিক জেনোফোনেস এর জন্ম কোলোফোন নগরে। ৫৭০ খ্রিস্টপূর্ব। দার্শনিক জেনোফোনেস-এর বাবার নাম দেক্সিয়াস। যা হোক। পারস্য সাম্রাজ্য তখন দুটো ভাগে বিভক্ত ছিল। ক) মেডেস বা মদ্র। এবং খ) পারস বা পারস্য। ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বে হারপাগাস দ্য মেড আওনিয়া আক্রমন করে। কথিত আছে, মৃত্যুভয়ে জেনোফোনেস জন্মনগর ত্যাগ করেন। এরপর তিনি সমগ্র গ্রিক বিশ্বে ঘুরে বেড়ান। অনেকে আবার বলেন জেনোফোনেস ছিলেন চারণ কবি। কাজেই ঘুরে বেড়ানোর নেশা ছিল তাঁর- পারস্যের হারপাগাস দ্য মেড কোলোফোন আক্রম না করলেও জেনোফোনেস তাঁর জন্মনগর ত্যাগ করতেন। যা হোক। অনেক ঘুরে ফিরে শেষে ইলিয়ায় এলেন জেনোফোনেস । ইলিয়া ছিল মধ্য ইতালিতে। জায়গাটা ইতালি হলেও ওখানে ছিল গ্রিসের উপনিবেশ । তো, সেই সময়টায় ইলিয়ার রাজা ছিলেন হিরোন। তিনি জেনোফোনেস এর কবিতা আর গান শুনে মুগ্ধ হলেন। বললেন, আমার এখানেই থেকে যান তাহলে। রাজি হলেন জেনোফোনেস । অনেক ঘুরেছেন। ঘুরতে আর ভাল্ লাগছিল না। এখন কোথাও থিতু হলে হয়। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে অনেক কথা মনে হচ্ছে। যেমন, এক অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা বিশ্বজগতকে নিয়ন্ত্রন করে। সেসব শিষ্যদের শেখাতে হবে।
গ্রিক দর্শনে ‘ইলিয়াটিক স্কুল অভ থটস’ বলে একটা কথা আছে। পন্ডিতগন মনে করেন জেনোফানেসই ইলিয়াটিক মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। ‘ইলিয়াটিক স্কুল অভ থটস’ এর বৈশিষ্ট্য হল:
এক/ তখন বলছিলাম, আইওনিয় গ্রিসের মাইলেটাস নগরেই মহান দার্শনিক থালেস জন্ম দিয়েছিলেন সভ্যতার প্রথম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার। ‘ইলিয়াটিক স্কুল অভ থটস’-এর চিন্তাধারা আইওনিয় বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারনার বিপরীত।
দুই/ হিরাক্লিটাস মহাবৈশ্বিক প্রবাহের কথা বলেছিলেন তার বিরোধী। জেনোফোনেস মনে করতেন এক অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা বিশ্বজগতকে নিয়ন্ত্রন করে।
তিন/ মহাবিশ্ব অসীম হওয়ায় এর সত্যিকারের রুপ মানুষের বোধবুদ্ধির বাইরে। যে কারণে জেনোফোনেস বলেছিলেন:“No human being will ever know the Truth, for even if they happen to say it by chance, they would not even known they had done so.” কেবল দার্শনিক অনুধ্যানে চরম সত্য জানা যেতে পারে। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ (মানে, চোখের দেখা বা কানে শোনা) হল সীমাবব্দ আর বাস্তবতার বিকৃত তথ্য দেয়।
মনে রাখতে হবে, জেনোফোনেস এর ইলিয় দর্শনই পরবর্তীকালে দার্শনিক প্লেটোর দর্শনের ভিত্তি। যা, পরবর্তীকালে খ্রিস্টান ও মুসলিম দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। প্লেটো বা আফলাতুন মুসলিশ বিশ্বে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন দার্শনিক।
আজও তাঁর দর্শনের গ্রহনযোগ্যতা অব্যাহত রয়েছে। যা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জেনোফোনেস।
জেনোফোনেস> প্লেটো> ইহুদি-খ্রিস্টান ও মুসলিম দর্শন।
২
দার্শনিক হলেও আসলে জেনোফোনেস ছিলেন মরমী কবি । কবিতা লিখে দর্শন প্রচার করতেন জেনোফোনেস । কবিতা সম্ভবত নিজেই সুর করতেন। তারপর কিথারা (তারের বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে গাইতেন।
যে কারণে দার্শনিক জেনোফোনেস কে প্রাচীন গ্রিসের লালন অবহিত করা যায়।
কিংবা নদীয়ার লালনকে জেনোফোনেস এর সমান্তরালে রাখা যায়।
কিন্তু, কেমন ছিল জেনোফোনেস এর গীতিকবিতার সুর?
সেসব আর জানার উপায় নেই।
জেনোফোনেস এর গান হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
জেনোফোনেস লালনরুপে জন্ম নিয়েছেন অস্টাদশ শতকের বাংলায়। সেই লালন গেয়েছেন-
আত্মতত্ত্ব জানে যারা/ শাঁইয়ের নিগূঢ় লীলা দেখছে তারা
কিংবা
পাবে সামান্যে কি তার দেখা?
বেদে নাই যার রুপরেখা।
কিংবা
নিরাকারের নিগম ধ্বনি/ সেও সত্য সবাই জানি
নীরে নিরঞ্জন অকৈতব ধন লালন খুঁজে বেড়ায় কোন্ জঙ্গলে।
লালন।
আজ লালানের গানের ভিতরেই খুঁজে নিতে হবে জেনোফোনেস -এর ভাববাদী গান!
কিংবা, আমার আজকাল চন্দনা মজুমদারের একটি গান ভীষন টানছে।
আমার বন্ধু দয়াময়/তোমারে দেখিবার মনে লয়।
জেনোফোনেস -এর ভাববাদী গান কি এরমই ছিল?
এরকম ভাবতে আমি ভীষনই তাড়না বোধ ভীষনই করি!
৩
কবি ও দার্শনিকের মন ছিল বলেই লালনের মতো বিদ্যমান ধ্যানধারনার অসংগতি চোখে পড়েছিল জেনোফোনেস -এর।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান / নারীলোকের কি হয় বিধান?
বিদ্যমান ধ্যানধারনার অসংগতি জেনোফোনেস কবিতায় লিখেছেন। যে কারণে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে ব্যাঙ্গাত্বক।
জাত গেল জাত গেল বলে এ কি আজব কারখানা ...
জেনোফোনেস এর সময়ে সমগ্র গ্রিসে মানবরুপী ঈশ্বরের ধারনা প্রচলিত ছিল । এসব স্থূল ধারনা প্রচার করেছেন হোমার ও বিয়োসিয়ার (গ্রিসের একটি জায়গা) কবি হেসিয়দ। জেনোফোনেস তাঁর কবিতায় বললেন, মানবরুপী দেবতাদের চরিত্র খারাপ। তারা পরকীয় করে, চুরি করে। “Homer and Hesiod have ascribed to the gods all things that are a shame and a disgrace among mortals, stealing and adulteries and deceiving on one another”এসব কি সমাজের জন্য শুভ? তা ছাড়া মানবরুপী ঈশ্বরের ধারনাই তো ভুল। ঘোড়াদের হাত পা থাকলে তারাও তাদের দেবতা ঘোড়াদের মতো করেই তৈরি করত না কি? ?“But if cattle and horses or lions had hands, or were able to draw with their hands and do the work that men can do, horses would draw the forms of the gods like horses, and cattle like cattle, and they would make their bodies such as they each had themselves.”
কাজেই, কবিতায় হোমার ও হেসিয়দের স্থূল ধারনার সমালোচনা করেছেন জেনোফানেস ।
জেনোফানেস মনে করতেন, প্রাকৃতিক ঘটনা বা প্রকৃতি স্বর্গীয় নয় বরং বস্তুগত উপাদানে তৈরি। রংধনু দেবী আইরিস নন-বরং বিশেষ মেঘসম্মিলন। পৃথিবীর বিস্তার অসীম। দৈব জ্ঞানই (ওহী?) সত্য। আর, মানবীয় মতামত বিষয়ী আর সম্ভাব্য। এমন কী আমার (মানে জেনোফানেস এর) মতও ধারনামাত্র।
জেনোফানেস এর ঈশ্বর নিরাকার। যার বর্ননা সম্ভব নয়। ঈশ্বর বুদ্ধিমান ও গতিহীন -সব নিয়ন্ত্রন করছেন চিন্তার মাধ্যমে।
এ এক ধরনের অজ্ঞেয়বাদ।
আমরা জানি, লালনও ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী।