গ্রিক নারী আসপাসিয়া; বেঁচে ছিলেন যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৪৫০ বছর আগে । বিদগ্ধ ও মেধাবী এক নারীকে পুরুষতন্ত্র কী ভাবে সুদীর্ঘকাল ইতিহাসের বইয়ের পাতায় কলঙ্কিত করে রেখেছে -আসপাসিয়ার জীবন তারই জলন্ত উদাহরণ। তাঁর প্রথম জীবন মাইলেটাসে (এখনকার তুরস্ক ) কাটলেও তাঁর ঘটনাবহুল বাকি জীবন কেটেছিল এথেন্স নগরে। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, বাকপটু, বিদূষী, সুলেখিকা, এথেনিয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক বিষয়ক পরার্মশদাতা, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতির উপদেষ্টা -এমন কী যার রুপগুণের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ সক্রেটিস।
আসপাসিয়ার জন্ম হয়েছিল গ্রিক নগররাষ্ট্র মাইলেটাসের এক শিক্ষিত ও ধনী পরিবারে ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বে ।
মানচিত্রের ডান দিকে মাইলেটাস। এথেন্স নগরটি বাঁ দিকে। অর্থাৎ পশ্চিমে।
আসপাসিয়ার বাবার নাম ছিল অ্যাক্সিওকাস; অ্যাক্সিওকাস মেয়ের যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেকালের গ্রিসে শিশুদের পড়াত দাসেরা। অ্যাক্সিওকাস তাঁর মেয়ের নাম রেখেছিলেন আসপাসিয়া; অর্থ: ‘কাঙ্খিত জন’। পরিনত বয়েসে আসপাসিয়ার ইচ্ছে হয়েছিল তিনি একটি নগরীর (এথেন্স) কাঙ্খিত জন হবেন। নগরী ও নগরীর মানুষের মনে জ্ঞানবিজ্ঞানের আলো জ্বালাবেন। না, তাঁর, ইচ্ছে পূরণ হতে দেয়নি এথেন্স নগরীর একদল কুসংস্কার আচ্ছন্ন সংকীর্ণমনা মানুষ!...যাহোক। আসপাসিয়ার বাবা অ্যাক্সিওকাস মাইলেটাস থেকে এথেন্স এসে পরিবারসমেত থাকতে শুরু করেন। মাইলেটাস থেকে সম্ভবত নির্বাসিত হয়েছিলেন। তখনকার দিনে এথেন্সে বিদেশিদের বলা হত: ‘মেটিক’ । মেটিক মানে, ‘অ-এথেনিয়’। মেটিকরা অতিরিক্ত কর দিত। কোনও এথিনিয় পুরুষ কোনও মেটিক মেয়েকে বিয়ে করলেও তাকে স্ত্রীর পূর্ন মর্যাদা দিতে পারত না।
তো সেই সময়টায় তখন এথেন্সের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন পেরিক্লিস (৪৯৫/৪২৯); কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি আসপাসিয়াকে দেখে থাকবেন।
এমন কি সুন্দরী? তবে একটা কি যেন রয়েছে ...
দেখামাত্রই পেরিক্লিস আসপাসিয়া প্রেমে পড়ে যান। এমনটা তো হতেই পারে। পেরিক্লিসের বয়স তখন ৪৫। আসপাসিয়ার ২০। আসপাসিয়ার বয়স কম হয়ে গেল? কী আর করা! পেরিক্লিস বিখ্যাত মানুষ-তাঁকে ঘিরেই গ্রিকবিশ্বের রাজনীতি ঘুরছে। আর মেয়েরা কেন যেন বিখ্যাত মানুষের প্রতি দূর্বল!
যাক। পেরিক্লিস জানতেন, সমাজে সবারই সীমারেখা আছে। তারপরও তিনি ঝুঁকি নিলেন। পেরিক্লিস-এর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ আগেই ঘটে গিয়েছিল। কাজেই, আসপাসিয়াকে নিয়ে একত্রে অন্যত্র বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। ৪২৯ খ্রিস্টাব্দে প্লেগে মারা যাবার আগে পর্যন্ত পেরিক্লিস আর আসপাসিয়া পুরুষ ও স্ত্রী হিসেবেই একত্রে বসবাস করেছিলেন ।
তা েেপরিক্লিসের ঝুঁকি নেওয়ার কি কারণ?
আসপাসিয়াকে আইনত তিনি বিয়ে করতে পারবেন না-তাই। একে তো আসপাসিয়া অ-এথেনিয় মেটিক-তার ওপর আসপাসিয়াকে দেখার আগে পেরিক্লিস এথেনিয় নাগরিকত্বসংক্রান্ত একটি কঠোর আইন করেছিলেন। সেই আইন অনুযায়ী এথেনিয় পিতা ও অ-এথেনিয় মাতা এথেন্সে পূর্ন নাগরিকত্ব পাবে না। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল অভিজাতদের ক্ষমতা খর্ব করা -যাতে তারা এথেন্সের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য রাষ্ট্রের সহায়তা না পায়। নিজের জীবনেই পেরিক্লিস এই আইনের ফেড়ে পড়লেন! আইন অনুযায়ী যেহেতু আসপাসিয়া এথেন্সের পূর্ন নাগরিক নয়-পেরিক্লিসের সঙ্গে বিবাহ বৈধ নয়!
আসপাসিয়ার একটি ছেলে হয়েছিল পেরিক্লিসের ঔরসে। তার নামও রাখা হয়েছিল পেরিক্লিস; সে আবশ্য পরে নাগরিকত্ব পেল। । পরিনত বয়েসে গ্রিক সেনাপতি হয়েছিল পেরিক্লিস।
আসপাসিয়ার সঙ্গে পেরিক্লিস আলাদ বসবাসের পর এথেন্সের সর্বত্র শুরু হল ফিসফাস। কানাঘুঁষা।
কেন?
এক) একে আসপাসিয়া ছিলেন ভিনদেশি মেটিক ...
দুই) আসপাসিয়ার সঙ্গে পেরিক্লিসের সম্পর্কটাকে অনেকেই মনে করত কেলেঙ্কারী। কেলেঙ্কারী নিয়ে মানুষের আগ্রহের অভাব একালের মতন প্রাচীনকালেও ছিল না।
তিন) পেরিক্লিস আসপাসিয়াকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন; সমান চোখে দেখতেন। যা ছিল গ্রিক পুরুষের কল্পনার বাইরে। নারী সম্বন্ধে পেরিক্লিস একবার বলেছিলেন, Your great glory is not to be inferior to what God has made you, and the greatest glory of a woman is to be least talked about by men, whether they are praising you or criticizing you.
এ কারণেই, পেরিক্লিস শুধু সেকালের কেন, আমাদের সময়ের পুরুষদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
চার) পেরিক্লিসের ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধবরা প্রায় সবাই ছিলেন অ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মুক্তমনা ও বিশ্বসভ্যতার মঙ্গলে বিশ্বাসী।
এই কথার ঈষৎ ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
আমাদের কিঞ্চিৎ গ্রিসের ইতিহাসের পিছনে চলে যেতে হবে। ...পারস্যের সঙ্গে গ্রিসের বিরোধ অনেক পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০-র দিকে (পেরিক্লিসের তখন মাত্র ৫ বছর বয়েস) পারস্যের সম্রাট জারেকসেস (৪৮৬-৪৬৫) গ্রিস আক্রমন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বৃহৎ এক সামরিক ও নৌবাহিনী গঠন করলেন। ম্যারাথনের যুদ্ধে তার পিতা দারয়বৌষ-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি সসৈন্য গ্রিসের মূলখন্ডের দিকে এগুতে থাকেন। পারসিক বাহিনীর দুর্মর আগ্রাসনে গ্রিসের উত্তরের থেসালি ও বিয়োশিয়া পদানত হলো। জারেকসেস -এর নেতৃত্বে থার্মফাইলে র্স্পাতান গ্রিকদের পর্যুদস্ত (যা হলিউড-এর বিখ্যাত ছবি “দ্য থ্রি হানড্রেড” -এর বিষয়বস্তু ) করে দ্রুত এথেন্সের দিকে এগিয়ে যায় পারসিক যোদ্ধারা। এথেন্সও করায়ত্ত করা হলো। অবশ্য আথেনীয় বন্দরের কাছে সালামিস প্রানালীর যুদ্ধে পারসিকরা হেরে যায়। এর প্রধান কারণ, গ্রিকদের নৌযুদ্ধের সাফল্য। অবশ্য ঠিক ওই সময়ে ব্যাবিলনে বিদ্রোহের খবর পেয়ে জারেকসেস গ্রিস থেকে মেসোপটেমিয়ায় ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। পারস্যের পক্ষে বাদবাকি যুদ্ধ পরিচালনা করলেন সেনাপতি মারদোনিয়াস । তিনি আথেন্সে অব্যাহত লুন্ঠন চালালেও, ৪৭৯-এ প্লাটেয়ায় পরাজিত হলেন।
পারস্যের পরবর্তী আগ্রাসন মোকাবেলা করার লক্ষ্যে এর দুবছর পর আথেনীয় রাজনীতিবিদ আরিসতাইদেস আওনীয়ার গ্রিক নগরগুলোর সঙ্গে গ্রিসের মূলভূমির নগররাষ্ট্রগুলি সংযুক্ত করে একটি জোট গঠন করলেন; জোটটি দেলিয় জোট নামে পরিচিত। দেলিয় জোট-এর নেতা হিসেবে এথেন্স নিয়মিত কর পেত। একদা এথেনীয় নেতা অ্যারিসটাইদেস দেলিয় জোটকে সমানাধিকারের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রসংঘে পরিনত করলেও, ৪৭৯ এবং ৪৪৯-এর মধ্যবর্তী দশকগুলোতে সেই উদ্দেশ্য ধুলিসাৎ করে দিয়ে সদস্যরাষ্ট্রকে বশে রাখতে চাইল আথেন্স । কর না-দেওয়ার লক্ষ্যে বিদ্রোহ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আথেন্সের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে করা হলো প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদ-বিদ্রোহ নির্দয়ভাবে দমন করল আথেন্স। বিদ্রোহ দমন করার মতো যথেষ্ট সামরিক শক্তি ছিল তার কাছে; গ্রিকবিশের¦ সবচে বড় নৌবহরটিই ছিল আথেন্সের।
যা হোক। এথেন্স নগরীর মধ্যেই অ্যাক্রোপলিস নামে অনুচ্চ একটি পাহাড় রয়েছে। তার ওপরেই এথেন্সবাসীর উপাসনালয় পার্থেননটি রয়েছে। ওই প্রার্থনালয়টিতে ছিল এথেন্সের রক্ষকারী দেবী এথেনার মূর্তি । দেবী আথেনা অলৌকিক শক্তির অধিকারী একজন দেবী। একজন অলৌকিক শক্তির অধিকারী দেবীর মন্দির নির্মানের পিছনে এথেন্সবাসীর গভীর আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। কেননা, দেবী এথেনাই তো সেই পারসিক আক্রমনের মহাদুর্যোগের সময় এথেন্স নগরীকে রক্ষা করেছিল । কাজেই, বিশ্বকে দেখানো দরকার এথেন্সও প্রতিদান দিতে পারে। এমনই হওয়ার কথা। কারণ, গ্রিকদের মধ্যে এথেন্সই শ্রেষ্ঠ। শুধু তাই নয়Ñপার্থেননের ভিতরকার অলঙ্করন এবং প্যাঁচা একদা গ্রিক জগতের সাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিনত হয়েছিল; এথেন্সের উন্নতি ও গৌরবময় অধ্যায়ের প্রতীকে পরিনত হয়েছিল প্যাঁচা ও পার্থেনন ।
তথ্যটি পারস্য জানত। সে কারনেই পারস্যের সৈন্যরা পার্থেনন ধ্বংস করেছিল।
৪৬১ খ্রিস্টপূর্বে ক্ষমতা এলেন পেরিক্লিস । তিনি ৪৪৯-এ ধ্বংসপ্রাপ্ত পার্থেননের সংস্কার কাজে হাত দেন। পার্থেনন নিয়ে আথেন্সবাসী গর্ব করত; করারই কথাÑ পার্থেননে তাদের আত্ম অহংকারের প্রতিফলন ঘটেছিল। এদের পূর্বপুরুষ মহা প্রতাপশালী পারস্যকে পরাজিত করেছিল (৪৮০-৪৭৯); আথেন্স নগরী সেই বিজয়ের সাক্ষী। উপরোন্ত, যুদ্ধের পর থেকেই আথেন্সের অর্থনীতি দিন দিন মজবুত হয়ে উঠছিল। কাজেই পার্থেনন-সংস্কর ছিল এক উচ্চাকাঙ্খী নগরের এক উচ্চাকাঙ্খী মানুষের পরিকল্পনা।
পেরিক্লিস
ফিদিয়াস ছিলেন তখনকার দিনের প্রতিভাবান এক ভাস্কর। পেরিক্লিস ফিদিয়াসকেই পার্থেননে দেবী এথেনার ভাস্কর্য তৈরির দায়িত্ব দিলেন। শুধু এথেন্সে আরও সুন্দর সুন্দর ভবন তৈরি করা হয়েছিল-যা কারিগরী ও রুপশৈলীতে ছিল অনন্য।
এসব কারণেই প্রাচীন গ্রিস বলতে মূলত এথেন্সকেই বোঝায় । আার এথেন্স মানে প্লেরিক্লিসের এথেন্স। আসলে গ্রিসের স্বর্ণযুগই হচ্ছে পারস্যযুদ্ধের পরে পেরিক্লিয় এথেন্স।
পেরিক্লিসের এথেন্সের বাড়িটি এথেন্সের শিল্পীসাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবিদের কেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা বসত। সক্রেতিস তো ছিলেনই -অন্যদের মধ্যে ছিলেন নাট্যকার এউরিপিদেস ও সফোক্লেস; নাট্যকার সফোক্লেস বলেছিলেন
It is hope that maintains most of mankind, সফোক্লেস আরও বলেছিলেন,
I depict men as they ought to be, but Euripides portrays them as they are. সফোক্লেস আরও বলেছিলেন, How dreadful knowledge of the truth can be-when there’s no help in truth!
পেরিক্লিসের বাড়িতে নিয়মিত যেতেন ঐতিহাসিক হিরোডোটাস, ভাস্কর ফিদিয়াস. সংগীতবিদ দামোন; দার্শনিক অ্যানাক্সগোরাস, প্রোটাগোরাস ও ইলিয়ার জেনো।ব্যাক্তিত্বের দিক থেকে পেরিক্লিস নিজেই ছিলেন সূর্যসম তার ওপর ছিল আসপাসিয়ার অপ্রতিরোধ্য চান্দ্রিক আকর্ষন। পেরিক্লিসের এথেন্সের বাড়িটি এথেন্সের শিল্পীবুদ্ধিজীবিদের কেন্দ্রে পরিনত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক।
পেরিক্লিস ও আসপাসিয়া: ফিদিয়াসের স্টুডিওতে
সত্যিই পেরিক্লিও এথেন্স ছিল গ্রিসের স্বর্ণযুগ। স্বর্ণযুগের পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল কয়েকজন অসাধারন মানুষের মন। যেমন, সক্রেটিস ...তারপর, নাট্যকার এউরিপিদেস; তিনি ছিলেন তাঁর যুগের তুলনায় অগ্রসর চিন্তার অধিকারী। ছিলেন দাসবিরোধী, যুদ্ধবিরোধী ও নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। প্রায়ই এউরিপিদেস বলতেন, A woman should always stand by a woman.ছিলেন অ্যানাক্সগোরাস। ইনি এশিয়া মাইনর থেকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিঃৎসা নিয়ে গিয়েছিলেন এথেন্সে । সূর্য কে বলতেন, আরে ধুরও- ওটা তো একটা জ্বলন্ত পাথর। আকার? আকার, এই ধর বড়জোড় পেলোপনেসীয় উপত্যকার সমান। আর, প্রোটাগোরাস ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানী। বাক্যের ‘পার্টস অভ স্পিচ’ এর কথা তিনিই প্রথম বলেছিলেন। বলতেন, ‘ম্যান ইজ দ্য মেজার অভ অল থিংঙ্কস।’ ইলিয়ার জেনো: ইনিই উদ্ভাবন করেছিলেন সক্রেটিস আর কার্ল মার্কসের প্রিয় ডায়ালেকটিকস্ । ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতবিদ দামোন: পেরিক্লিস এঁরই কাছে সংগীতশিক্ষা করেছিলেন। প্লেরিক্লিসের বয়স তখন ৫০! এর মাত্র ৫ বছর আগে আসপাসিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল পেরিক্লিসের। প্রেম কি করে বদলে দেয় মানুষকে!
পেরিক্লিসের নেতৃত্বে এথেন্স তখন শাসন করছে সমগ্র গ্রিকবিশ্ব । বিশাল তার নৌবাহিনী। অপ্রতিরোধ্য এথিনিয় সাম্রাজ্য। এথেনিয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে পেরিক্লিস। আর, পেরিক্লিসের পরামর্শদাতা আসপাসিয়া! হ্যাঁ, দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন পেরিক্লিসের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর আসপাসিয়ার প্রভাব ছিল। যা হোক। পেরিক্লিস-আসপাসিয়া-সক্রেটিস- এরা সবাই মিলে চেয়েছিলেন সুন্দর করে এথেন্স কে সাজাতে। পিছিয়ে পড়া মানুষের মনে আলো জ্বালাতে । পারেননি। তখন আমি বলছিলাম না- বিদগ্ধ এক নারীকে পুরুষতন্ত্র কী ভাবে সুদীর্ঘকাল ইতিহাসের বইয়ের পাতায় কলঙ্কিত করে রেখেছে -আসপাসিয়ার জীবনতারই জলন্ত উদাহরণ। আসপাসিয়ার সঙ্গে পেরিক্লিস আলাদ বসবাসের পর এথেন্সে কানাঘুঁষা শুরু হল। জানথিপপাস ছিল পেরিক্লিসের প্রথম স্ত্রীর সন্তান। সেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাবার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে দ্বিধা করেনি। সর্বত্রই অশান্তির ছায়া। নগরের বেশির ভাগই মানুষই অর্ফিয়াসপন্থি কুসংস্কারাচ্ছন্ন পিছিয়ে থাকা। অন্যদিকে দার্শনিক অ্যানাক্সগোরাস।/ প্রোটাগোরাসরা ...এঁরা মূলত সফিস্ট দার্শনিক; প্রচলিত দেবদেবীতে শ্রদ্ধা ছিল না এঁদের। কোনও সার্বজনীন ও ধ্র“ব মূল্যবোধ্যে বিশ্বাস ছিল না। এঁদের মনোভাব লালনের একটি গানের প্রকাশ পেয়েছে-পাপ পুন্যের কথা আমি কারে-বা শুধাই/এক দেশে যা পাপ গন্য/অন্যদেশে পুন্য তাই ...এইর কম লোকদের মধ্যে আবার বেসামাল এক মেটিক নারী। এথেন্সের লোকে আসপাসিয়াকে কলঙ্কিত করতে ভিত্তিহীন নানান কথা বলে বেড়াল। বলা হল আসপাসিয়ার ব্রথেল আছে। সে পেরিক্লিসের বিকৃত যৌনক্ষধা মিটানোর জন্য নিত্যনতুন মেয়ে জোগায়। আরও বলা হল, আসলে আসপাসিয়া মাইলেটাস নগরীতে অনাথ ও অবাঞ্ছিত ছিল । মেয়ে শিশু বলেই অবাঞ্ছিত ছিল। মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতে বাবা দেবী আফ্রোদিতির প্রার্থনাগৃহে সেবাদাসী হিসেবে দান করেছিল। অনেকে আবার বলল, আল্কিবিয়াদেস নামে একজন এথেনিয় মাইলেটাসে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। আল্কিবিয়াদেস যখন এথেন্স ফিরল সঙ্গে অনাথ আসপাসিয়াকে নিেেয় এসেছিল। এথেন্স এসে আসপাসিয়া রক্ষিতা হল।কৌতূক কবিতার রচিয়িতা হারমিপপাস মামলা করলেন আসপাসিয়ার বিরুদ্ধে। অভিযোগ দেহব্যবসা! অভিযোগটি অবশ্য প্রমানিত হয়নি। প্রমাণিত না হলেও অনুমান করি সেই সব দিনগুলি পেরিক্লিস আর সক্রেটিসদের জন্য ছিল তিক্তকর। আসপাসিয়ার বিরুদ্ধে সবচে বড় প্রচারণা ছিল: আসপাসিয়া রক্ষিতা ছিলেন! এই অসত্য কথার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদেরাও লিখেছেন:আসপাসিয়ার বাড়ি হয়ে উঠেছিল এথেন্সের ক্ষমতাধর পুরুষদের মধুচক্র। আরও লেখা হল: আসপাসিয়া ছিলেন এথেন্স নগরীরর সবচে সৃন্দরী, সবচে শিক্ষিতা ‘হেতাইরা’। হেতাইরা শব্দটি গ্রিক; এর মানে রক্ষিতা। হেতাইরা মানে আসলে তার চেয়েও বেশি। তারা ছিল স্বাধীন ও রাষ্ট্রকে কর দিত।হেতাইরা-রা গ্রিক নারীদের চেয়ে ছিল শিক্ষিত। হেতাইরাদের জানতে হত ইতিহাস দর্শন রাজনীতি বিজ্ঞান ও শিল্পকলা; এ কারণেই তারা শিক্ষিত লোকদের সঙ্গে অনায়াসে কথা বলতে পারতেন।হেতাইরাদের প্রত্যহ সন্ধ্যায় সিম্পোজিয়া আয়োজন করতে হত। সিম্পোজিয়া মানে আসলে নৈশভোজ। এথেন্সের ক্ষমতাধারী পুরুষরা নৈশভোজে আসত। তাদের স্ত্রীরা অবশ্য যেতেন না! তারা ছিল প্রভাবশালীদের সঙ্গী বা ‘পাললাকিয়া’ (এটিও গ্রিক শব্দ)। বলা হল পেরিক্লিস এর ‘পাললাকিয়া’ ছিলেন আসপাসিয়া। আসলে আসপাসিয়া নিজ মেধাতেই হয়ে উঠেছিলেন সক্রেটিসের মতন জ্ঞানীগুণীদের মধ্যমনি; ছিলেন পেরিক্লিসের জীবনের ধ্র“বতারা। সহজ সত্য হল: পেরিক্লিস ভালোবাসতেন আসপাসিয়াকে। আসপাসিয়ার জন্ম মাইলেটাসে বলেই এথেনিয় আইনে পেরিক্লিস তাঁকে বিয়ে করতে পারেননি। রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন বলে নগর ছেড়েও চলে যেতেও পারেন নি আসপাসিয়াকে নিয়ে। পেরিক্লিস প্রথম জীবনে এথেনিয় নিয়মকানুন মেনেই এক নিকট আত্বীয়াকে বিয়ে করেছিলেন। জানথিপপাস ও পারালাউস নামে তাঁর দুই ছেলেও ছিল। তবে বিয়েটা সুখের হয়নি। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর পুরুষ আত্বীয়বর্গে অনুমতি নিয়েই ৪৪৫ খ্রিস্টপূর্বের দিকে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়; এবং মেয়েটিকে অন্য স্বামীর নাম প্রস্তাব করা হয়। প্রথম স্ত্রীর নাম জানা যায়নি।
যাহোক। পেরিক্লিসকে হেনস্থা করার জন্য এথেন্সে তাঁর বিরোধীপক্ষের সামনে একটা সুযোগ আসল। বিশেষ করে ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বের সামিয় যুদ্ধের পর সেই সুযোগ এল। কী কারণে সামোস ও মাইলেটাস যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। পেরিক্লিস এথেনিয় সেনাবাহিনীকে সামোস অভিযানের নির্দেশ দেন। সামোস পরাজিত হল বটে-তবে এথিনিয় বিপুলসংখ্যক এথনিয় সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে। এথেন্সের বিক্ষুব্দ লোকজন এজন্য আসপাসিয়াকেই দায়ী করে। আসপাসিয়া সন্তোষের জন্যই নাকি পেরিক্লিস সামোস আক্রমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। জন্মনগর মাইলেটাসকে ভুলতে পারেনি আসপাসিয়া ।
পেলোপোনেশিয় (৪৩১-৪০৪) যুদ্ধের আগে পেরিক্লিস/আসপাসিয়া ও তাদের বন্ধুরা দারুণ দুর্যোগের মুখোমুখি হয়।
এবার পেরিক্লিসের প্রতিপক্ষরা দার্শনিক অ্যানাক্সগোরাস- এর বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ আনল। এমন কী অ্যানাক্সগোরাস কে বলা হল: ‘পারস্যের দালাল’। সে এথেন্সের জনগনের ধর্মবিশ্বাসে ইচ্ছে করেই আঘাত এনেছে। আনেক্সোগোরাস-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল এথেনিয়ান কর্তৃপক্ষ । মৃত্যুদন্ডই হয়ে যেত -পেরিক্লিস বাঁচালেন ... এথেন্স ছেড়ে চলে গেলেন দার্শনিক অ্যানাক্সগোরাস ।
পেরিক্লিস ও আসপাসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
যে ভাস্কর ফিদিয়াস অ্যাক্রোপলিস পাহাড়ের ওপর দেবী এথেনার ভাস্কর্যটি গড়েছিলেন- সেই ফিদিয়াসের বিরুদ্ধেআনা হল তহবিল তছরুপের অভিযোগ! তাঁর জেল হল; পেরিক্লিস কিছুই করতে পারলেন না। করাগারে ধুকে ধুকে মারা গেলেন ফিদিয়াস ।
পেরিক্লিস ও আসপাসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
দেবতা মানেন না, দেবতাকে উপহাস করেন-এইসব অভিযোগে নাট্যকার এউরিপিদেসও এথেন্স থেকে নির্বাসিত করা হল।
পেরিক্লিস ও আসপাসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বিপদ ঘনিয়ে এল আরও।
তখন আমি বলছিলাম: ...পারস্যযুদ্ধের পর থেকেই আথেন্সের অর্থনীতি দিন দিন মজবুত হয়ে উঠছিল। দেলিয় জোট-এর নেতা হিসেবে এথেন্স নিয়মিত কর পেত। একদা এথেনীয় নেতা অ্যারিসটাইদেস দেলিয় জোটকে সমানাধিকারের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রসংঘে পরিনত করলেও, ৪৭৯ এবং ৪৪৯-এর মধ্যবর্তী দশকগুলোতে সেই উদ্দেশ্য ধুলিসাৎ করে দিয়ে সদস্যরাষ্ট্রকে বশে রাখতে চাইল আথেন্স । কর না-দেওয়ার লক্ষ্যে বিদ্রোহ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আথেন্সের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে করা হলো প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদ-বিদ্রোহ নির্দয়ভাবে দমন করল আথেন্স। বিদ্রোহ দমন করার মতো যথেষ্ট সামরিক শক্তি ছিল তার কাছে; গ্রিকবিশের¦ সবচে বড় নৌবহরটিই ছিল আথেন্সের। এসব কারণে এথেন্সের শত্র“ তৈরি হল। বিশেষ করে স্পার্টা। দীর্ঘদিনের বৈরী। ( একদিন সস্পার্টা আর এথেন্স ,িলেই আগ্রাসী পারস্যকে রুখে দিয়েছিল।) অন্যান্য নগররাষ্ট্রও এখেন্সে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় ভয় পেল।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১। পেলোপনেসিয় যুদ্ধ বাঁধল। (এই যুদ্ধ নিয়েই গ্রিক ঐতিহাসিক থুকিদিদিসের বিখ্যাত বইয়ের নাম, “পেলোপনেসীয় যুদ্ধের ইতিবৃত্ত”)
গ্রিস;মূল ভূখন্ড। পশ্চিমে পেলোপন্নেসাস ও স্পার্টা; পুবে আত্তিকা ও এথেন্স
কমেডি নাট্যকার আরিসটোফোনেস যুদ্ধের জন্য আসপাসিয়াকে দুষলেন। তিনি দাবী করলেন, পেলোপনেসিয় যুদ্ধের
প্রত্যক্ষ কারণ ছিল পেরিক্লিসের মেগারা ডিক্রি। মেগারা ডিক্রি হল মেগারা এথেন্স ও এর সহযোগী নগররাষ্ট্রের সঙ্গে কোনও ধরনের ব্যবসাবানিজ্য করতে পারবে না। এই কারণেই ক্ষেপে উঠে কয়েকজন মেগারাবাসী আসপাসিয়ার ব্রথেল থেকে নাকি মেয়ে চুরি করেছিল। এর সঙ্গে পেলোপনেসিয় যুদ্ধর কী সর্ম্পক-আল্লা মালুম। যা হোক। আত্তিকা হল মধ্য গ্রিসের একটি বিশাল উপত্যকা; এবং এরই মাঝখানে ছিল প্রাচীরঘেরা এথেন্স নগরীটি। পেরিক্লিস আত্তিকার অধিবাসীদের নগরপ্রাচীরের ভিতরে চলে আসতে নির্দেশ দিলেন। র্স্পাটানরা আত্তিকার গ্রামগুলি তছনছ করল। অবশ্য তারা এথেন্সে অনুপ্রবেষ করতে পারল না।
যুদ্ধের পরের বছর মহামারী আকারে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ল এথেন্সে। “পেলোপনেসীয় যুদ্ধ” বইয়ে থুকিদিদিস লিখেছেন: “সঠিক পদ্ধতি না জানা থাকায় চিকিৎসকগন প্রথম কোনো প্রতিকার করতে পারে নি। বরং চিকিৎসকগনের মধ্যেই মৃত্যু ঘটল সর্বাধিক। কারণ তারাই রোগীর সংর্স্পসে আসতেন খুব বেশি । কোনও বিদ্যা বা কৌশলই কাজে লাগল না ...নিখুঁত স্বাস্থ্যবান ব্যাক্তিরও সহসা মাথা দারুন উত্তপ্ত হয়ে পড়ে,চোখ ফুলে লাল হয়,গলার ভিতর ও জিভ রক্তবর্ণ হয়,শ্বাসপ্রশ্বাস কষ্ঠকর ও অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে ... (পৃষ্ঠা,১০৮; অনুবাদ গীতশ্রী বন্দনা সেনগুপ্ত) পেরিক্লিসের বোন ও দুই ছেলে মারা গেল। অনুতাপ বোধ করলেন পেরিক্লিস। কাঁদলেন। হয়তো সফোক্লিসের ভাষায় চিৎকার করে বলতেন, How dreadful knowledge of the truth can be-when there’s no help in truth! আসপাসিয়াও তাঁকে শান্ত্বনা দিতে পারলেন না। উপরোন্ত, লোকে পেরিক্লিসকেই যুদ্ধ ও প্লেগের জন্য দুষল। তাঁকে অপসারণ করা হল। তাঁর বিচারও তারা করল। জরিমানা হল সরকারি তহবিল তছরুপের জন্য । পরে অবশ্য আবার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পেলেন পেরিক্লিস। তবে লাভ হয়নি। প্লেগেই পেরিক্লিসের মৃত্যু হল ৪২৯ খ্রিস্টপূর্বের বসন্তকালে। পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর আসপাসিয়া কি করবেন? কোথায় যাবেন? এমন দিশেহারা অবস্থা। আলাইসিকলেস নামে একজন এথেনিয় সেনাপতির সঙ্গে তিনি একত্রে বসবাস করতে লাগলেন। আলাইসিকলেস-এর সঙ্গেও আসপাসিয়ার বিয়ে হয়নি। কেননা, আসপাসিয়া তখনও অ-এথেনিয় মেটিক। আলাইসিকলেস সেনাপতি ছাড়াও ছিলেন এক গনতান্ত্রিক নেতা। আসপাসিয়ার গর্ভে তাঁর একটি ছেলেও হয়। ৪২৮ খ্রিস্টপূর্বে -অর্থাৎ পেরিক্লিসের মৃত্যুর এক বছর পর আলাইসিকলেস নিহত হন।
এরপর আসপাসিয়া সম্বন্ধে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
মনে থাকার কথা আসপাসিয়ার একটি ছেলে হয়েছিল পেরিক্লিসের ঔরসে। তার নামও রাখা হয়েছিল পেরিক্লিস; পরে সে নাগরিকত্ব পেল। । পরিনত বয়েসে গ্রিক সেনাপতি হয়েছিল পেরিক্লিস। তাঁর ছেলে পেরিক্লিস সেনাপতি হয়। আরগিনাসের যুদ্ধের পর হত্যা করা হয়। তখন বেচে ছিলেন কি না বলা যাচ্ছে না। ধারনা করা হয়, সক্রেতিসের মৃত্যুর আগেই আসপাসিয়া মারা গিয়েছিলেন।এথেন্স ছেড়ে যাননি কোথাও। এথেন্সে পরবর্তীকালে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের দুটি কবর আবিস্কৃত হয়েছে। নামফলকে আসপাসিয়া ও অ্যাক্সিওকাস-এই দুটি নাম উৎকীর্ণ আছে ...মনে থাকার কথা ... এই লেখার শুরুতে বলেছিলাম ... মেয়ের যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন আসপাসিয়ার বাবা অ্যাক্সিওকাস । সেকালে শিশুদের পড়াত দাসেরা। আসপাসিয়া নামের অর্থ: কাঙ্খিত জন ...
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৮:৫০