আরও অনেক আগে সমাজবিজ্ঞান শব্দটি প্রয়োগ করা হলেও ১৮৩৮ সালেই ফরাসী চিন্তাবিদ অগাস্ট কোতে প্রথম শব্দটি তাৎপর্যপূর্নভাবে ব্যবহার করেন। এর পরপরই ইউরোপীয় চিন্তাবিদেরা সমাজসংক্রান্ত তত্ত্ব উপস্থাপন করতে থাকেন। ক্রমশ গড়ে উঠতে থাকে সমাজবিজ্ঞান শাস্ত্রটি।
ইউরোপে সামাজিক বিজ্ঞানের বিকাশে কার্ল মার্কস, ম্যাক্স ভেবার ও এমিল ডুরখেইম -এর অবদান স্মরণীয়। সমাজকে এঁরা নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) বললেন, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো মানুষের চিন্তাকে ও সামাজিক সংগঠনকে নিয়ন্ত্রন করে। ম্যাক্সিমিলিয়ান কার্ল এমিল ভেবার (১৮৬৪-১৯২০) মার্কসের বক্তব্যকে অস্বীকার করে বললেন, মানুষের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। তিনি আরও মনে করতেন, পুঁজিবাদের বিকাশের কারণ প্রোটেষ্টান্টদের কাজের নীতিমালা। ফরাসী চিন্তাবিদ এমিল ডুরখেইম (১৮৫৮-১৯১৭) বললেন, মনোদৈহিক আবেগ ও অর্থনৈতিক শক্তি ছাড়াই সংস্কৃতির নিয়মে সংস্কৃতিকে পাঠ করা যায় । এবং, সংস্কৃতির নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে।
উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ নিয়ে এমন ভাবনা সম্ভব হয়নি ঠিকই -তবে বাউলের গানে সমাজভাবনা উঠে এসেছে ঠিকই।
বিশেষ করে লালনের গানে।
২
লালন যে শুধুই গান করতেন তা নয়- লালন ব্যবসাও করতেন। (দ্র: ফরহাদ মাযহার; ভাবান্দোলন।) উপরোন্ত, লালনের লাঠিয়াল বাহিনীও ছিল। কৃষকের ওপর অন্যায় হলে দলবল নিয়ে ছুটে যেতেন। এসবই লালনের সমাজমনস্কতার ফল। লালনের সমাজভাবনা চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে এই গানটিতে।
এমন মানবসমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতিগোত্র নাহি রবে।
শোনায়ে লোভের বুলি নেবে না কেউ কাঁধের ঝুলি।
ইতর আতরাফ বলি দূরে ঠেলে নাহি দেবে।
আমির ফকির করে এক ঠাঁই সবার পাওনা পাবে সবাই।
আশরাফ বলিয়া রেহাই ভবে কেহ নাহি পাবে।
ধর্ম কুল গোত্র জাতি তুলবে নাকো কেহ জিকির।
কেঁদে বলে লালন ফকির কে মোরে দেখায়ে দেবে।
লালনের সমাজবিচার ও দৃষ্টিভঙ্গি কার্ল মার্কস, ম্যাক্স ভেবার ও এমিল ডুরখেইম সঙ্গে তুলনীয় নিশ্চয়ই নয়-তবে এর মূল্যও কম নয়। কল্যানরাষ্ট্রের ধারনা রয়েছে লালনের সমাজভাবনায়।
শোনায়ে লোভের বুলি নেবে না কেউ কাঁধের ঝুলি।
ইতর আতরাফ বলি দূরে ঠেলে নাহি দেবে।
সবচে বিস্ময়কর, লালন ধর্মহীন মানবসমাজ কামনা করেছেন।
ভাবলে সত্যই অবাক হতে হয়!
‘এমন মানবসমাজ কবে গো সৃজন হবে’ গানটি আবদেল মাননান সম্পাদিত ‘অখন্ড লালনসঙ্গীত’ থেকে নেওয়া হয়েছে।