somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পৌষ বন্দনা: ভোরে, কুয়াশায়...

২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বছরের শেষের এই শীত-শীত কুয়াশা-কুয়াশা সময়টার জন্য অপেক্ষা করি। যখন ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে ভোরগুলি, শহরের দালানকোঠা। আমার যদিও বাঙালি কবির স্বভাব: ভালো লাগে জুনের অঝোর বৃষ্টি, ব্যঙের ডাক, মেঘলা দিন- তবু কুয়াশার ভোরে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটার জন্য আজও অপেক্ষায় থাকি পৌষের। আমার স্বভাবে প্রখর কুঁড়োমি থাকলেও পৌষের খুব ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি।

শান্তিনগর মোড়ের কাছাকাছি বাড়ি। এও এক বিরল সৌভাগ্য। যেহেতু বেইলী রোডটা খুব কাছে। বেইলী রোড দিয়ে দিয়ে হেঁটে গেলেই রমনা পার্ক। অমন সুন্দর ঘাস ও গাছপালাময় নির্জন স্থান ঢাকায় ক’টি আছে বলুন? এখন তো ওই নিভৃত স্থানটিও ভিড়ের দখলে চলে গেছে! অথচ আমাদের ছেলেবেলায় অত ভিড়ভাট্টা ছিল না। ছেলেবেলায় রমনা পার্কে কত বার যে গিয়েছি। তখন তো এত কড়াকড়ি ছিল না। পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে রমনা পার্কে যেতাম।ভোরে কি বিকেলে। আমি ১৯৮০-৮১ সালের কথা বলছি। ফুটবল খেলতাম। কখনও ক্রিকেট। কাজেই পার্কটির ঘাস, গাছপালা ও কৃত্রিম হ্রদটি আমার শৈশবের স্মৃতিতে একাকার। পৌষের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে পার্কটিকে অন্যরুপে আবিস্কার করি অবশ্য আরও পরে। আমার তরুণ বয়েসে। লক্ষ্য করেছি-আমার স্পর্শকাতর মনে কবিতার উন্মেষের পর পৌষের ধোঁয়াটে কুয়াশার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা রমনা পার্কের গাছগুলি আমার কাছে হয়ে ওঠে গভীর ইঙ্গিতময়। আমার স্বভাবে প্রখর কুঁড়োমি থাকলেও তরুণ বয়েস থেকেই পৌষের ভোরে উঠে চলে যাই পার্কে।
আজ ৮ পৌষ। ১৪১৫।
বহুতল থেকে গুটিগুটি পায়ে যখন বেড়িয়েছি তখন ঠিক ছটা। বেরুতেই শীতেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার চল্লিশ বছর বয়েসী হাড়গুলি আর্তনাদ করে ওঠে। ভীষন অস্বস্তি আর যন্ত্রণা টের পাই। আমার আমি জানি, আর কিছুক্ষণ হাঁটার পর অত শীত লাগবে না। দ্রুত হাঁটতে থাকি। অন্ধকার অন্ধকার রাস্তা । কুয়াশা। শান্তিনগর মোড়টা নির্জন। ডাইনে বেইলী রোড। ফিরব বেইলী রোড দিয়ে। এখন আমি কাকরাইলের দিকে হাঁটছি। দ্রুত । পেট্রলের গন্ধ পাই। একটা বাস আসছে। তার মৃদু গুঞ্জন। হলুদ আলো। কুয়াশার ভিতরে। পকেটে হাত ঢোকই। ফাকা পকেট। মোবাইল ও এম পি থ্রি প্লেয়ারটা নিইনি। ইচ্ছে করেই। নাঃ, ভোরে হাঁটতে বেড়িয়ে গান শুনব না। বরং আশেপাশের কুয়াশায় চোখ রাখব; চোখ রাখব রাস্তায়, ফুটপাতে, ভিজে দেওয়ালে। রাস্তা পাড় হই। বাসটা চলে যায় মালিবাগে দিকে। বাতাসের ঝাপটা আর পেট্রলের গন্ধ পেলাম। আমার পায়ে বাটার কালো রঙের শস্তা কেডস। বঙ্গবাজারের জিন্স। নীলাভ পুলভার। চশমায় মিহিন বাষ্প। দৃষ্টিপথ তাই ঝাপসা। হোক। এই ভোরে সবটা দেখতে চাইনা। এই পথে স্কুলে যেতাম। ছেলেবেলায়। জলখাবার। শাহ্ আলমদের তিনতলা বাড়িটা। এক তলায় পপেল ভাইরা থাকত। লাল রঙের সাইকেল ছিল পপেল ভাইয়ের। আমি ওই সাইকেলটার লোভে প্রায়ই বিকেলে পপেল ভাইদের বাড়িতে চলে যেতাম। ডানে কর্নফুলি গার্ডেন সিটি। বিশাল বহুতল। কেমন নিথর। এই ভোরে সাদেক হোসেন খোকার এক নারীকর্মী ঝারু দিয়ে ঝার দিচ্ছে । নারীকর্মীর পরনে নীল ইউনিফর্ম। কখন এদের ভোর শুরু হয়? এরই মধ্যে চা খাওয়া শেষ? রাস্তার পাশে একটা পুলিশের ভ্যান থেমে আছে। একটা মেয়ে। শ্যামলা। একুশ/বাইশ বছর মনে হল। হাত নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছে। কান পাতলাম। “রামপুরা” শব্দটা কানে এল। যৌনকর্মী? আমি মুখ ফিরিয়ে নিই। কাকরাইর মোড়ে এক বাস থেমে আছে। পেট্রলের গন্ধটা ঘন। ইশা খাঁ হোটেলের কয়েকটা জ্বানালায় আলো। কোন্ মডেলের ঘুম ভাঙল কে জানে! এদের ভোরবেলা পুলিশের সঙ্গে বার্গিনিং করতে হয় না। এদের পয়সাওলা ক্লায়েন্টদের পুলিশেরা ঘাটে না। যত বিপত্তি রাস্তায় মেয়েদের। রাস্তা পাড় হই। ডানে উইলস লিটল ফ্লওয়ার স্কুল। কারা যেন পাতা পুড়িয়েছে। তার তীব্র গন্ধ। আমার কান্না পায়। মাধব । মাধব। আমি ওই স্কুলে পড়তাম। মাধবরা স্কুলের ভিতরে থাকত সেই পুরনো দোতলা বাড়িটায় । মাধবের সঙ্গে খেলতাম। চুরাশিতে পাস করে বেরিয়েছি। পুরনো স্কুলে অনেকেই যায় পুরনো স্মৃতির টানে। কায়েস স্যার সুইসাইড করার পর আমি আর যাইনি। স্কুলটার সামনে এলে অস্বস্তি লাগে। আমি দ্রুত হাঁটতে থাকি। বাঁয়ে কাকরাইল চার্চ। এই ভোরে ওখানে কী রহস্য লুকিয়ে কে জানে। যিশু কি সত্যি আসবেন? মোম জ্বালিয়ে কেউ ওখানে একখানা প্রাচীন পান্ডুলিপির ওপর ঝুঁকে আছে? আমি দ্রুত হাঁটছি। ঘড়িতে ছটা কুড়ি। আমার শরীরের রক্তে জন্মাবধি শর্করার আধিক্য। ইনফানটাইল ডায়াবেটিস। কুড়ি মিনিট ধরে হাঁটার ফলে তার কতটা সুরাহা হল কে জানে। টের পাচ্ছি ঘামছি। এবার বাঁয়ে মোড়। কাকরাইল মসজিদ। স্কুলে পড়ার সময় শুক্রবারের জুম্মার নামাজ পড়তে আসতাম ঐ মসজিদে। কাকরাইল মসজিদের ভিতরে ঢুকলে কেমন এক অনুভূতি হত। যেন সময় থমকে আছে। হাঁটছি। আমার সামনে একজন মাঝবয়েসী থলথলে মহিলা। কালো কেডস। সাদা সালোয়ার-কামিজ। নীল কার্ডিগেন।আমি কবি বলেই দূর্বল বোধ করি। চোখ চলে যায় মধ্যবয়েসী নিতম্বে। দ্রুত হাঁটছেন। ডায়াবেটিস? ফুটপাতে ভেজা পাতা। ডান পাশে পার্কের রেলিং। গাছ। ঘাসের গন্ধ পাই। অনেকেই এসেছে। হাঁটছে। নানা বয়েসি নারীপুরুষ। পার্কের ভিতরে একটা অতি সুন্দর দৃশ্য দেখলাম। বৃদ্ধ দম্পতি। পাশাপাশি হাঁটছেন। বৃদ্ধের হাতে ছড়ি। বৃদ্ধার সাদা শাড়ি ইষৎ গোলাপী কার্ডিগেন। কী সুখ। কী সুখ। এমন জীবন ক’জনের হয়? এদের প্রণাম করব? থাক। আমি যে কবি এঁরা তো তা জানে না। আমি এদের দীর্ঘায়ূ প্রার্থনা করি। তবে কোনও নির্বিকার ঈশ্বরের কাছে নয়। পৌষের এই ভোরের কাছে। এই কুয়াশামাখা গাছগাছালির কাছে। সহসা পার্কের ভিতরে শিশিরমাখার ঘাসের গন্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। আর এরা আমায় ঘন করে ঘিরে ধরে। আমি সচেতন হয়ে উঠি। আমার মনে হয় ইউরোপের শীতার্ত পার্কগুলি কি ঠিক এই রকম? আমি কখনও ইউরোপ যাইনি। পৌষের এই ভোরের শীত-কুয়াশা আমায় ইউরোপ নিয়ে যায়। কেবল এদেশে তুষার ঝরে না। এও এক বিরল সৌভাগ্য। পৌষ তোমাকে প্রণাম। তুমি আমায় প্রতিবছর নতুন এক অনুভূতি দাও। পার্কের গেটের কাছে পৌঁছে যাই। গেটের ওপাশে গাড়ির ভিড়। অনেকগুলি পরিবার। শিশু, বালক-বালিকা। বুড়োবুড়ি। পার্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তা পাড় হয়ে হাঁটতে থাকি। ৭টা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। বেইলী রোডের রাস্তায় এখন মোটামুটি ভিড়। অনেক পার্কে যাচ্ছে। ওদের ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হয়ে গেছে। ওরা যখন পার্কে পৌঁছবে তখন সকাল ৭টা। ততক্ষণে আমি বাথরুমে। নগ্ন। গরম পানি ভরতি বালতি থেকে ধোঁওয়া উঠবে ... হাঁটছি। ফুটপাতে চা ওয়ালা। গামছা ঢাকা ভাপা পিঠে। চাদরমুড়ি লোকজন বসে যাচ্ছে। একটা দিনের শুরু। এখন আর অতটা অন্ধকার নেই। শীত আছে। ডান পাশে অনেকগুলি কুকুর। আমার শরীরে শিহরন বয়ে যায়। অনেকগুলি কুকুর মানেই আদিম হিঃস্রতা। বন্যতা।আমি নিরীশ্বরবাদী সেকুলার। তবে প্রার্থনায় বিশ্বাস করি। যে প্রার্থনা মানুষ গাছ ও পাখিদের জন্য। এই ভোরে এক প্রার্থনা উঠে আসে:পৃথিবীর সকল প্রাণি সুখি হোক। মঙ্গল লাভ করুক।
অনেকটা এগিয়ে এসেছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি কুকুরগুলি তখনও জটলা করে আছে।








সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:১৭
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×