somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ তা হলে প্রাচীন মিশরের ফারাও হাতসহেপসুত-এর জীবনের গল্পটাই বলি।

২৭ শে নভেম্বর, ২০০৮ সকাল ৯:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

hatshepsut।
প্রাচীন মিশরের এক নারী। যিনি প্রাচীন মিশরের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অবৈধ প্রেমিক সেনমুতকে জীবনভর পাশে রেখেছিলেন। হাত করেছিলেন থিবস নগরের প্রধান পুরোহিত হাপুসসেনেবকে। তবে আধুনিক মিশরবিদদের মতে, নারী হয়েও সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন হাতসহেপসুত-যা সম্ভবত পরবর্তী মিশরের টলেমি যুগের নারীশাসক ক্লিওপেট্রাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। হাতসহেপসুত এর পুরো নাম মাত-কা-রা হাতসহেপসুত। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় মাত-কা-রা মানে: সত্য শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য। মাত হচ্ছে দেবতা “রা”-এর আত্মার দ্বিগুন শক্তি। এভাবেই প্রাচীন মিশরীয় জনগন গ্রহন করেছিল তাদের নারী শাসক হাতসহেপসুতকে। হাতসহেপসুত শব্দের আরেকটি মানে:Foremost of Noble Ladies.

মিশর। মিশরের বুক চিরে বইছে নীল নদ। সে নদের পূর্বতীরে কিনা প্রদেশ। কিনা প্রদেশটি মিশরের মাঝখানে। সেখানেই লুক্সর নামে একটি শহর, নীল নদের পূর্বতীরে। আপনি কখনও লুক্সর শহরে গেলে নীল নদ পেরিয়ে পশ্চিম পাড়ে যেতে ভুলবেন না। কেননা, নীল নদের পশ্চিম পাড়েই “দেইর এল বাহরি।” বাংলায় এর মানে, “উত্তরের মঠ।” ওখানেই অনেক প্রাচীন সমাধিসৌধ আজও টিকে আছে। হাতসহেপসুত-এর সমাধিসৌধটিও ওই দেইর এল বাহরিতেই। হাতসহেপসুত এর সৎ ছেলে ৩য় থুতমোসিস হাতসহেপসুত এর বিদ্বেষবশত মৃত্যুর পর সমাধিসৌধটি ধ্বংস করে দিয়েছিল।
কেন?
সে কথাই আজ বল।
প্রাচীন মিশরই সভ্যতাকে দান করেছিল পরকাল সম্বন্ধীয় ধ্যানধারনা। তখনকার দিনের মিশরের লোকজন পরকালের ভালোমন্দ নিয়ে আচ্ছন্ন ছিল। লিখেছিল মৃতের বই বা “বুক অভ ডেড।”
হাতসহেপসুতও এর ব্যাতিক্রম ছিল না। ক্ষমতা গ্রহন করে দইর এল বাহরিতে সমাধিসৗধ নির্মানের পরিকল্পনা করেছিল হাতসহেপসুত।



প্রাচীন মিশরের ইতিহাস আসলে প্রাচীন মিশরীয় রাজবংশের ইতিহাস। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসকে রাজবংশের কালানুক্রম হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। যেমন পুরনো রাজবংশ, নতুন রাজবংশ।
নতুন রাজবংশের একটি উপবিভাগ আবার “অষ্টাদশ রাজবংশ।” অষ্টাদশ রাজবংশের সময়কাল ছিল ১৫৫০ ১২৯২ খ্রিস্টপূর্ব। সময়কালটি প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। শক্তিশালী ক’জন ফারাও শাসন করেছেন সে সময়টায়। থুতমোসীয় গোত্রের ফারাওরা শাসন করেছেন বলে অষ্টাদশ রাজবংশটি থুতমোসিয় রাজবংশ নামেও পরিচিত। টুথানখামুন, আখেনাতেন, নেফারতিতি- এর সবাই ছিলেন অষ্টাদশ রাজবংশের ।
হাতসহেপসুত ছিল অষ্টাদশ রাজবংশের পঞ্চম ফারাও।



হাতসহেপসুত-এর বাবা ছিলেন অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও ১ম থুতমোসিস । হাতসহেপসুত-এর মায়ের নাম আহমেস। যদ্দুর জানতে পেরেছি, মেয়ে ছিল মা-বাবার নয়নের মনি। ১ম থুতমোসিস ভাবছিলেন-আহ, আমার হাতসহেপসুত যদি হত মিশরের ফারাও। এত সুন্দর আর বুদ্ধিমতী। থিবস নগরের পুরোহিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন ফারাও ১ম থুতমোসিস। পুরোহিতরা আর কী বলবে-তারা একেবারে স্তম্ভিত। এমন অভিনব ধারনা। মিশরের সিংহাসনে বসবে এক নারী।
বিষয়টি ছিল বিস্ময়কর। যদিও সেই সময়কার মিশরের নারীর স্থান ছিল তুলনামূলক সম্মানজনক।The Egyptian tradition of having the Pharaoh marry a royal woman led Thuthmose II to marry Hatshepsut. (The women in Egypt carried the royal blood, not the males. To become Pharaoh, the man had to marry a female of royal blood, often a sister, half sister or other near relative. Usually it was the eldest daughter of the previous Pharaoh.) Thuthmose II died soon after becoming Pharaoh, leaving the widow Hatshepsut, a daughter Neferura... and a son by another wife - Thuthmose III. Women could own land, inherit from family members, and even go to court to defend her rights. But before Hatshepsut, there were queens who had ruled Egypt... but not a female Pharaoh.
কিশোরী বয়সে উপনীত হল হাতসহেপসুত।
রাজবাড়ি ছিল থিবস-এ। থিবস ছিল তখন প্রাচীন মিশরের রাজধানী । ভূমধ্যসাগরের ৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণে। নীল নদীর পূর্বপ্রান্তে। তো, রাজবাড়িতে নানা লোকজন আসত। সেনমুত তাদেরই একজন। সেনমুত ছিল অভিজাত বংশের সন্তান। ফারাও ১ম থুতমোসিস সেনমুতকে বিশেষ øেহ করতেন। হাতসহেপসুত এর ভালো লাগত সেনমুতকে। ছবি আঁকত সেনমুত। কবিতা লিখব। আর বলত সব আশ্চর্য দেশের কথা। দক্ষিণের এক দেশে নাকি রয়েছে অঢেল হাতির দাঁত, বিচিত্র সব পশু আর ঔষধি বৃক্ষ । ভারি অলীক সে দেশ। ওখানেই তো নীল নদের উৎস।
সেনমুতের মুখে সে সব গল্প শুনতে শুনতে কেমন আনমনা হয়ে যেত হাতসহেপসুত। বলল, আমাকে সে দেশে নিয়ে যাবেন?
হ্যাঁ। সেনমুত বলল।
এই সেনমুতই পরে হাতসহেপসুত এর ঘনিষ্ট পরামর্শদাতায় পরিনত হয়েছিল । আমৃত্যু। ইচ্ছে ছিল শবাধারটি থাকবে একই সমাধিগৃহে । সেনমুত-এর সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। হাতসহেপসুত এর সৎ ছেলে ৩য় থুতমোসিস সে রকম হতে দেয়নি।
কেন?
সে কথাই আজ বলব।
হাতসহেপসুত-এর বাবা ১ম থুতমোসিস-এর আরেকজন স্ত্রী ছিল। মুতনোফ্রি। তার ঘরে এক ছেলে হয়েছিল। ২য় থুতমোসিস। ১৪ বছর মিশর শাসন করার পর ১ম থুতমোসিস মারা গেল। নিয়মানুয়ায়ী ২য় থুতমোসিস সিংহাসনে বসল। তবে ২য় থুতমোসিস-এর বয়স ছিল কম। কাজেই পিছন থেকে কলকাঠি নাড়তে লাগল হাতসহেপসুত। এবং সেনমুত।
দুজনে ঘনিষ্ট হয়েছিল অনেক আগেই। রাতের অন্ধকারে মিলিত হত মশালজ্বলা কক্ষে। রতিক্লান্ত দেহে কাঁপা কাঁপা স্বরে হাতসহেপসুত বলত, আমি তোমাকে ভালোবাসি সেনমুত। ভালোবাসলেও তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি আমার সৎ ভাই ২য় থুতমোসিসকে বিয়ে করব। আমি মিশরের ফারাও হতে চাই। অনেক ওপরে উঠতে চাই। আমার সৎ ভাই ২য় থুতমোসিস আমার সিঁড়ি। তুমি আমার পাশে চিরকাল থেক সেনমুত।
থাকব।
বিয়ে হল ২য় থুতমোসিস আর হাতসহেপসুত-এর।
২য় থুতমোসিস অবশ্য আরও একটি বিয়ে করেছিল। বউয়ের নাম ছিল আইসিস । আইসিসের একটি ছেলে হল। ছেলের নামও থুতমোসিস, তবে তৃতীয়। কাজেই হাতসহেপসুত ছিল ৩য় থুতমোসিস-এর সৎ মা।
৩য় থুতমোসিসই হাতসহেপসুত ও সেনমুত-এর শেষ জীবনে চরম সর্বনাশ করেছিল!
যা হোক। সিংহাসনে বসার ৪ বছর পর ২য় থুতমোসিস মারা গেল। চর্মরোগে। ২য় থুতমোসিস মমি পরীক্ষা করে সেরকমই মনে করেন মিশরবিদগন। বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল কি?
যা হোক। নিয়ম অনুযায়ী ৩য় থুতমোসিস বসল মিশরের সিংহাসনে। পিছন থেকে অবশ্য রাজ্য পরিচালন করতে লাগল হাতসহেপসুত এবং সেনমুত । তখন ৩য় থুতমোসিস-এর বয়স ছিল কম। সে মেনে নিয়েছিল। পরে আর সহ্য হয়নি। পরে সে হাতসহেপসুত এবং সেনমুত এর বিরুদ্ধে ঘোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।
এদিকে হাতসহেপসুত আর সেনমুত দুজনে আরও আরও ঘনিষ্ট হয়ে উঠছিল। স্বামী ২য় থুতমোসিস মৃত। হাতসহেপসুত-এর শরীরে তৃষ্ণা। সেনমুত এর সঙ্গে রাতের অন্ধকারে মিলিত হত মশালজ্বলা কক্ষে।



থিবস নগরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন হাপুসসেনেব।
তামাটে বর্ণের বলিষ্ট দীর্ঘ পুরুষ। মাথা কামানো। হাপুসসেনেব ছিল সেনমুত এর ঘনিষ্ট সুহৃদ। দুজনে রাতের অন্ধকারে মিলিত হত মশালজ্বলা কক্ষে। পড়ত মৃতদের বই। যে বইয়ে রয়েছে পরকালের বর্ননা। মশালের আলোয় নগ্ন করত কিশোরী নুবিয় দাসীদের। শরীরে তেল মাখাত। তা ছাড়া একসঙ্গে ব্যবসা করত সেনমুত আর হাপুসসেনেব। রজনের। মমি তৈরি করার সময় দরকার হত রজনের।
আমরা জানি, গোত্রজীবন ভেঙ্গে উদ্ভব হয় রাষ্ট্রের। আর, রাষ্ট্রের টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন ধর্মের । প্রাচীন মিশরের ক্ষেত্রে সেনমুত এবং হাতসহেপসুত ছিল রাষ্ট্র। আর হাপুসসেনেব ছিল ধর্ম। কাজেই তারা তিনজনে একত্রে মিলিত হল।
সেনমুত বলল, হাপুসসেনেব, আপনি থিবস নগরে প্রধান পুরোহিত। লোকে আপনাকে শ্রদ্ধা করে, ভয়ও করে।
হ্যাঁ, তা করে। হাপুসসেনেব বলল।
তা হলে আপনি হাতসহেপসুত-এর জন্মের আগের এক গল্প জনগনের মধ্যে আপনি প্রচার করে দিন।
কী গল্প? কৌতূহলী হয়ে ওঠে।হাপুসসেনেব
এবার হাতসহেপসুত বলল, আমার জন্মের আগে দেবতা আমুন আমার বাবা ১ম থুতমোসিস-এর ছদ্মবেশে আমার মায়ে কাছে এসেছিল। তারপর তারা সঙ্গম করেছিল। কাজেই আমি দেবতা আমুন এর কন্যা।
তাই বলব। বলে হাপুসসেনেব মুচকি হাসল। তারপর কুর্নিশ করল ভবিষ্যতের ফারাওকে।
হাপুসসেনেব গল্পটা ছড়ালো। যে গল্পটা আমাদের কালেও পৌঁছে গেছে । দেবতাসংশ্লিষ্ট গল্পগাথা সহজেই বিশ্বাস করে মানুষ।
আর, হাপুসসেনেব কেও মনে হয় খুশি করেছিল হাতসহেপসুত। হাতসহেপসুত ছিল উচ্চভিলাষী। নামধামের কাতর। তার পক্ষে সবই করা সম্ভব ছিল।



হাতসহেপসুত -এর জন্মকাহিনীটি মিশরজুড়ে তুমুল আলোরণ তুলল। থিবস নগরীর প্রধান পুরোহিত বলল বলেই লোকে সহজে বিশ্বাস করল। দেবতা আমুন থিবস নগরের রক্ষাকারী দেবতা। তারই কন্য হাতসহেপসুত! হাতসহেপসুত কে এক পলক দেখার জন্য জনগন অস্থির হয়ে উঠল।
তিনজনে মিলে জনগনের সামনে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করতে বসল।
হাপুসসেনেব বলল, আপনার নারী বেশে জনগনের যাওয়া ঠিক হবে না।
তা হলে?
এবার সেনমুত বলল, তুমি বরং পুরুষের ছদ্মবেশ নাও।
তাই করেছিল হাতসহেপসুত।
তখনকার দিনে ফারাওরা নকল দাড়ি পড়তেন, মাথায় পরত খাত নামে আবরনী। কাজেই হাতসহেপসুত পুরুষের পোষাক পরে নকল দাড়ি লাগিয়ে মাথায় খাট পরে জনগনের সামনে গিয়েছিল।
জনগন অভিভূত।
তারা চিৎকার করে উঠল: মাত-কা-রা হাতসহেপসুত।
মাত-কা-রা মানে-সত্য, শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য।
১৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব। সিংহাসনে বসল হাতসহেপসুত। নিজেকে ঘোষনা করল মিশরের ফারাও।
৩য় থুতমোসিস দাঁতে দাঁত ঘঁষল।



হাতসহেপসুতএর সিংহাসনে বসার কিছু সময় পরের কথা।
একদিন সেনমুত বলল, জনগনের যে কোনও গল্প বেশিদিন মনে থাকে না। তারা সব সময় নতুন গল্প চায়। গল্পের অভাবে জনগন বিদ্রোহ করতে পারে। জনগনের জন্য চাই নতুন নেশা । নতুন গল্প।
কী করতে হবে? হাতসহেপসুত এর মুখে উদ্বেগ।
সেনমুত বলল, মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম, দক্ষিণের এক দেশে নাকি রয়েছে অঢেল হাতির দাঁত, বিচিত্র সব পশু আর ঔষধি বৃক্ষ । ভারি অলীক সে দেশ। ওখানেই তো নীল নদের উৎস। তুমি আমাকে বলেছিলে, আমাকে সে দেশে নিয়ে যাবেন?
হ্যাঁ। আমার মনে আছে। হাতসহেপসুত বলল।
সেনমুত বলল, চল আমরা দক্ষিণের সেই ঈশ্বরের ভূমিতে যাই। জনগন তাহলে নতুন শিহরণ পাবে।
চল।
মিশরের দক্ষিণপুবের উপদ্বীপটিই বর্তমানে সোমালিয়া। মিশরের লোকেরা বলত ঐশ্বরিক ভূমি। অলীক স্বপ্নময় স্থান। নীল নদের উৎসও নাকি ওখানে। সে স্থান নাকি নানাবিধ ঔষধি বৃক্ষে পরিপূর্ন ।
মিশরের জনগন মাত-কা-রা হাতসহেপসুত সেই স্বপীল দেশে যাচ্ছে শুনে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠল।
এক ঝলমলে দিনে নীল নদের পাড় থেকে জাহাজে উঠল হাতসহেপসুত। সঙ্গে সেনমুত। ও অসংখ্য দাসদাসী। সব মিলিয়ে পাঁচটি জাহাজ। ৭০ ফুট দীর্ঘ। বিশাল পাল। সর্বমোট ২১০ জন নাবিক, দাঁড়ি। আর দুধর্ষ মিশরী সৈন্যভরতি জাহাজ তো ছিল।
নৌকা দক্ষিণে ভাসল।
হাতসহেপসুত-এর কী সুখ। তার কক্ষে নীল নদের গন্ধ ভরে আছে। গবাক্ষপথে একটি মধ্যদিনের প্রাচীন আলো এসে ঢুকেছে কক্ষে। সে আলো পড়েছে কাঠের পাটাতনের ওপর। ওখানে বিবলস দেশের নীলাভ কোমল গালিচা পাতা। সেনমুত শুয়ে আছে গালিচার ওপর। নগ্ন। হাতসহেপসুত মুচকি হেসে ওদিকে গড়িয়ে যেতে থাকে।
একদিন নৌকা ভিড়ল নীল নদীর পুব প্রান্তে।
এবার পুবমুখো যাত্রা।
হাতসহেপসুত আর সেনমুত। পালকিতে বসে আছে। সামনে পিছনে কুড়ি সহস্র সৈন্য। হাতসহেপসুত দেখে -অদ্ভূত মাটি অদ্ভূত গাছ অদ্ভূত পশু অদ্ভূত পাখি অদ্ভূত আকাশ আর অদ্ভূত অদ্ভূত সব মানুষ। কালো বেঁটে। কালো বেঁটে মানুষে অদ্ভুত সব ঘরবাড়ি। অদ্ভূত গোত্র। গোত্রটি রানীশাসিত। দুপক্ষের ভাষা নাবুঝলেও সংঘাত বাঁধেনি। বরং রানী উপহার হিসেবে দিল গাছ। যে গাছে ধূপ হয়, হয় রজন ও সুগন্ধী আতর। হাতসহেপসুতরা আরও উপহার পেল হাতীর দাঁত, নানাবিধ পশু, মসলা ও স্বর্ন।
সে সব তোলা হল নৌকায়।
দক্ষিণের দেশকে ইংরেজীতে বলে Land of Punt। আর, ঐতিহাসিকদের মতে প্রথম বিদেশি গাছ লাগানোর প্রথম উদ্যোগ। হাতসহেপসুত এর আমলের শিলালিপিতে দক্ষিণ দেশের অভিযানের কথা লেখা রয়েছে।
থিবস ফেরার পথে নৌকায় হাতসহেপসুত সেনমুতকে বলল, আমি মা হতে যাচ্ছি সেনমুত।
সেনমুত হাসল। বলল, কি নাম রাখবে সন্তানের?
হাতসহেপসুত বলল, ছেলে হলে সেনমুত। আর মেয়ে হলে নেফরুরি।
মেয়েই হয়েছিল হাতসহেপসুত-এর। মেয়ের নাম রাখা হয়েছিল নেফরুরি। পরবর্তীতে হাতসহেপসুত। চেয়েছিল নেফরুরি হবে মিশরের ফারাও। সে ইচ্ছে ৩য় থুতমোসিস গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
এতকাল পরে ভাবছি হাতসহেপসুত-এর সন্তানের পিতা কে? আর কে। সেনমুতই।
কিংবা হাপুসসেনেব।
কে বলতে পারে?
যা হোক হাতসহেপসুতরা থিবস ফিরল।
ঐশ্বরিক ভূমি লোকদের বর্ননা শুনে থিবসবাসী শিহরিত। অবশ্য বেঁটেকালো লোকদের কথা শুনে তারা হাসাহাসি করল। তারা বিদ্রোহ করল না।
হাতসহেপসুত থিবসে প্রতিষ্টা পেয়ে গেল।



মানেথো ছিলেন প্রাচীন মিশরের একজন ঐতিহাসিক। তার লেখা থেকে জানা যায় এককালে হাইকসসরা মিশর আক্রমন করে শাসন করেছিল । মিশরের লোকেরা হাইকসসদের বলত “আমমু”। মানেথো মনে করতেন হাইকসসরা ছিল এশিয় জাতি। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, হাইকসসরা ছিল সেমেটিকভাষী; মেসোপটেমিয়। হাইকসসরা মিশরে পঞ্চদশ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। মিশর থেকে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছিল সপ্তদশ রাজবংশের ফারাওরা। এবং “নতুন রাজ্যের” শাসকরা।
একদিন থিবস নগরীর প্রধান পুরোহিত হাপুসসেনেব বলল, আমমুদের (হাইকসসদের) আমলে এ দেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন হল অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসাবানিজ্য বন্ধ হয়ে আছে।
কী করা যায়? হাতসহেপসুতকে চিন্তাগ্রস্থ দেখাল।
সেনমুত বলল, অন্য দেশের সঙ্গে বানিজ্য আবার শুরু করা উচিত।
তাই করা হয়েছিল। অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসাবানিজ্য আরম্ভ করা হল। যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার করা হল। পথে ব্যবসায়ীদের পাহারা দিল সৈন্যরা।
এসব কারণেই, হাতসহেপসুত-এর শাসনামলের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতির কথা মিশরবিদরা বলে থাকেন।
একদিন সেনমুত বলল, জনগন মনে হয় ঝিমিয়ে পড়েছে। নতুন সামরিক অভিযান প্রেরণ না করলে জনগন আবার একঘেয়েমিতে ভুগবে। তখন তারা বিদ্রোহ করতে পারে।
সামরিক অভিযান? হাতসহেপসুতকে কেমন চিন্তাগ্রস্থ দেখাল। সামরিক অভিযান হাতসহেপসুত-এর পছন্দ না।
হ্যাঁ, সামরিক অভিযান। আমাদের সৈন্যরা বসে থেকে থেকে মুটিয়ে যাচ্ছে।
তো, কোথায়?
সেনমুত সামান্য ভেবে বলল, প্রথমে নুবিয়া। পরে সিরিয়া।
তাই হয়েছিল। হাতসহেপসুতএর শাসনামলে কেবল দুটি সামরিক অভিযানের কথা জানা যায়। নুবিয়া ও সিরিয়ায়।
অবশ্য আরও দুটি অভিযাত্রী দল প্রেরণ করা হয়েছিল বিচিত্র প্রাণি পশু ও স্বর্নর খোঁজে । সিনাই ও বিবলসে। সিনাই সম্ভবত সিনাই উপদ্বীপ। বিবলস কোথায়? ব্যাবিলন কি?



তখন বলছিলাম। মিশরের বুক চিরে বইছে নীল নদ। সে নদের পূর্বতীরে কিনা প্রদেশ। কিনা প্রদেশটি মিশরের মাঝখানে। সেখানেই লুক্সর নামে একটি শহর, নীল নদের পূর্বতীরে। আপনি কখনও লুক্সর শহরে গেলে নীল নদ পেরিয়ে পশ্চিম পাড়ে যেতে ভুলবেন না। কেননা, নীল নদের পশ্চিমপাড়েই দেইর এল বাহরি। বাংলায় এর মানে, “উত্তরের মঠ।” ওখানেই অনেক পিরামিড প্রাচীন সমাধি সৌধ আজও টিকে আছে।
প্রাচীন মিশরের ফারাও হাতসহেপসুত সমাধিসৌধটিও ওই দেইর এল বাহরিতেই।
আধুনিক মিশরবিদগন বলেন, হাতসহেপসুত-এর আমলে তেমন সামরিক অভিযান হয়নি। যা হয়েছিল ধর্মীয় ভবন নির্মান।
আসলে তাইই হয়েছিল।
আমুন ছিলেন মিশরের প্রধানতম দেবতা। তিনি ছিলেন প্রাচীন মিশরের জীবনের নিঃশ্বাস।দেবতা আমুনের পুরোহিতরা প্রভাবশালী ছিল। ক্ষমতা থাকার জন্য ওদের তুষ্ট করার জন্য আমুন দেবতার উদ্দেশ্যে নির্মান করা হল একের পর এক ধর্মীয়কেন্দ্র।
বর্তমান লুক্সর শহরের কাছে প্রাচীন মিশরের আরেকটি পবিত্র স্থান ছিল। কারনাক। সেখানেও অনেক ধর্মীয় ভবন তোলা হল।
হাতসহেপসুত, সেনমুত ও হাপুসসেনেব মিলে বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিল।
সেনমুত ভালো নকশা আঁকতে পারত । ধর্মীয় ভবনাদির নকশা সেই করল। সেই সময়ে মিশরের প্রতিভাবান স্থপতি ছিল আইনিনি। সে সেনমুতের অধীনে কাজ করল।
প্রজেক্ট দেখভালের দায়িত্ব পেল থিবস নগরের প্রধান পুরোহিত হাপুসসেনেব।
হাইকসসরা। মিশর তছনছ করেছিল। ধ্বংস করেছিল প্রাচীন মিশরীয় দেবী মুত-এর মূর্তি।
জনগনকে খুশি করতে প্রথমেই মুত-এর মূর্তিটি প্রতিস্থাপন করা হল।
কত যে শিলামূর্তি নির্মান করা হল। অনেক। এত বেশি যে উন্নত বিশ্বের যেকোনও যাদুঘরে হাতসহেপসুত আমলের শিলামূর্তি নিউইয়কে হাতসহেপসুত নামে আলাদা কক্ষই রয়েছে।
সেই সময় শিলালিপিও স্থাপন করা হয়েছিল। সেনমুতই লিখত সম্ভবত।
Hatshepsut, with the backing of the temple of Amun, proclaimed that she was the divine Wife of the god Amun:
Then his majesty said to them: "This daughter of mine, Khnumetamun Hatshepsut - may she live! - I have appointed as my successor upon my throne...she shall direct the people in every sphere of the palace; it is she indeed who shall lead you. Obey her words, unite yourselves at her command." The royal nobles, the dignitaries, and the leaders of the people heard this proclamation of the promotion of his daughter, the King of Upper and Lower Egypt, Ma'at-ka-Ra - may she live eternally!



মনে থাকার কথা- ৩য় থুতমোসিস ছিল ২য় থুতমোসিস এর ছেলে। মায়ের নাম আইসিস (বা আইসেট) কাজেই হাতসহেপসুত ছিলেন ৩য় থুতমোসিস-এর সৎ মা। একসঙ্গে রাজত্ব করেছিলেন।
৩য় থুতমোসিস কিন্তু ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছিল। জনগনের আর হাতসহেপসুত দের চমক
ভাল লাগছিল না। আর কত? । নারীর শাসন। গেল বার ফসল ভালো হল না। তার আগেরবার প্লাবন হল নীলে। আসলে মিশরের জনগন চাইছিল পরির্বতন। দেখি না ৩য় থুতমোসিস ক্ষমতায় বসলে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি ঝরে কিনা।
৩য় থুতমোসিস আর ভালো লাগছিল না সৎ মায়ের শাসন। পুরুষ হয়েও নারীর অধীন। তার চারপাশে তোষামদকারীরা জুটল। তারা কানে মন্ত্র ঢালল।
তারপরেও প্রায় কুড়ি বছর শাসন করল হাতসহেপসুত।
১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বের পর আর হাতসহেপসুত-এর কথা শোনা যায়নি।
মনে থাকার কথা হাতসহেপসুত ছিল পঞ্চম ফারাও।
অস্টাদশ রাজবংশের ৬ষ্ট ফারাও হল ৩য় থুতমোসিস।
তারপর?
তারপর সম্ভবত ৩য় থুতমোসিস এর নির্দেশে হাতসহেপসুত, সেনমুত এবং ওদের কন্যা নেফরুরিকে খুন করা হয়েছিল। সে প্রতিশোধ নিয়েছিল।
সেনমুত এর ইচ্ছে ছিল তার শবাধারটি থাকবে হাতসহেপসুত-এর সমাধিমন্দিরে। হয়নি। কাছেই তার পৃথক সমাধি হয়েছিল। না। সেনমুত এর মমি পাওয়া যায়নি। শবাধারটির ১২০০ টুকরো পাওয়া গেছে। হাতসহেপসুত এর সমাধি মন্দির আজও টিকে থাকলেও, শবাধারটি ধ্বংস করা হয়েছিল। মমি চুরি হয়েছিল। সেভাবে নির্দিস্ট করে হাতসহেপসুত-এর মমি পাওয়া যায়নি। ৩য় থুতমোসিস ধ্বংস করেছিল। সে প্রতিশোধ নিয়েছিল।
থিবস নগরীর পুরোহিত হাপুসসেনেব-এর কী হয়েছিল?
না। তাকে কেউই মনে রাখেনি। তখন বলছিলাম। হাতসহেপসুত গর্ভবতী হয়েছিল । মেয়ে হয়েছিল। মেয়ের নাম রেখেছিল, নেফরুরি। পিতা সেনমুতই সম্ভবত।
কিংবা হাপুসসেনেব।
কে বলতে পারে?

১০

এই লেখাটি যদিও কাল্পনিক- তবে লেখাটির ভিতে রয়েছে হাতসহেপসুত সংক্রান্ত বেশ কটি ওয়বেসাইটের গবেষনাধর্মী তথ্যাদি। হাতসহেপসুত-এর জীবন নিয়ে কেউ চলচ্চিত্র নির্মান করতে উৎসাহী হলে [চিত্রনাট্যের জন্য] যোগাযোগ করতে পারেন!

তথ্যসূত্র:

Click This Link
http://www.kingtutone.com/queens/hatshepsut/
Click This Link













সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৫১
৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×