বাংলার মাটিতে যতই বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গা হোক না কেন -বাউল গান বাংলার মাটিতে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
সেদিন লালনের একটি গান শুনতে শুনতে ভাবছিলাম কারা বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে গেল? তারা কি অবিশ্বাসী। কেননা, লালন তো নিজেই আল্লাহ্ সম্বন্ধে বলেছেন-
কেউ বলে পরম ইষ্টি
কারো না হৈল দৃষ্টি;
যাদের দৃষ্টি হয়নি-তারাই কি ভাঙ্গতে গেল বাউলভাস্কর্য?এই রকম একটি ভাবনায় আমি ভীষন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। কেননা, আমি জানি, লালনের কোনও কোনও গানের পরতে পরতে রয়েছে ইসলামের ব্যাখ্যা। "পাবে সামান্যে কি তার দেখা"-সেরকমই একটি গান। গানের কথাগুলি এইরকম-
পাবে সামান্যে কি তার দেখা
বেদে নাই যার নার রুপরেখা।
নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে
সদাই ফেরে অচিন দেশে।
দোসর তার নাইকো পাশে
ফেরে সে একা একা।
কেউ বলে পরম ইষ্টি
কারো না হৈল দৃষ্টি;
বরাতে দুনিয়া সৃষ্টি,
তাই নিয়ে লেখাজোখা।
কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেব?
সে তুলনা কি আর দেব?
লালন বলে গুরু ভেব
যাবে রে মনের ধোঁকা।
এবার, আমি যা বুঝেছি, ক্ষাণিক ব্যাখ্যা করার চেস্টা করি।
পাবে সামান্যে কি তার দেখা
বেদে নাই যার নার রুপরেখা।
পাবে সামান্যে কি তার দেখা-এই লাইনটির দার্শনিক ব্যাখ্যা সম্ভব। কিন্তু আমি আজ সে দিকে যাব না। সহজ ভাবেই বলি, আল্লাকে পাওয়ার পথ সোজা নয়।
বেদে নাই যার নার রুপরেখা।
বেদ বা জগতের ধর্মগ্রন্থসমূহ আল্লাহ্ বা ঈশ্বরের ইঙ্গিতমাত্র। ধর্মগ্রন্থে তো আল্লা বা ঈশ্বরের পূর্নাঙ্গ সাক্ষাৎ পাওয়া যাওয়ার কথা না।
নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে
সদাই ফেরে অচিন দেশে;
দোসর তার নাইকো পাশে
ফেরে সে একা একা।
নিরাকার ব্রহ্ম মানে-নিরাকার আল্লা। আল্লার যে আকার-সাকার নাই সেকথা মুসলমানমাত্রই বিশ্বাস করে। কাজেই তার দোসর থাকারও কথা নয়। কাজেই- অচিন দেশে একা একা ঘুরে ফেরে ।
কিন্তু, অচিন দেশ কি?
অচিন দেশ হল যেখানে আল্লার ঘর: The Unknown. যেখান থেকে আসে উড়ে আসে জীবনরুপ অচিন পাখি। উড়ে এসে আমাদের দেহ খাঁচায় বাস করে। যাকে কখনও লালন বুঝতে পারেন নি। কেঁদে বলেছেন-
আগে যদি যেত জানা
জংলা কভূ পোষ মানে না।
তা হলে হায় প্রেম করতাম না
লালন ফকির কেঁদে কয়
পাখি কখন জানি উড়ে যায়।
একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায় ...
জীবনরুপ অচিন পাখি উড়ে আসে অচিন দেশ বা The Unknown থেকে।
কেউ বলে পরম ইষ্টি
কারো না হৈল দৃষ্টি;
এ দুটি চরণ, আমার মতে, লালনের কবিত্ব শক্তির অপূর্ব উদাহরণ। ঈশ্বরকে কেউ বলে পরম ইষ্টি বা আত্মীয় বা নিকটজন।
কারো না হৈল দৃষ্টি;
কেউ আবার সারাজীবন ঈশ্বরকে খুঁজে পেল না। তাই লালন বলছেন-
কেউ বলে পরম ইষ্টি
কারো না হৈল দৃষ্টি;
বরাতে দুনিয়া সৃষ্টি,
তাই নিয়ে লেখাজোখা।
ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন বলেই এতকিছু। এই যে বেঁচে আছি। বেঁচে থেকে এ গানের ব্যাখ্যা লিখছি।
বরাতে দুনিয়া সৃষ্টি-
বরাতের এক মানে কপাল বা ভাগ্য। আসলে দুনিয়া সৃস্টি হতই। কাজেই, বিশ্বাসীদের কাছে এ জগৎ অর্থহীন ও আকস্মিক নয়।
কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেব?
সে তুলনা কি আর দেব?
সবচে গুরুত্বপূর্ন চরণ। সৃস্টির আগের মুহূর্তের কথা বলছেন লালন। মহাদেব মানে মহাদেবতা, মানে আল্লা। ধ্যান মানে- সৃষ্টির আগেকার আল্লার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা। যে মুহূর্তটিকে জানতে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের শেষ নেই। এ বছর আদিকণা কি রকম ছিল সে বিষয়ে ব্যয়বহুল পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে ইউরোপে। আল্লার পরিকল্পনা জানতেই। লালন যেটা গানে বলেছেন। সেই সৃস্টিমুহূর্তই তো সব কিছুর মূলে-এই জীবনজগৎ, আমাদের জন্মমৃত্যু। তাই সৃষ্টিমুহূর্তের কোনও তুলনা হয় না।
সবশেষে লালন বলছেন-
লালন বলে গুরু ভেব
যাবে রে মনের ধোঁকা।
লালন বলছেন, আল্লাহ্ই যে সবের মূলে সেটা বিশ্বাস করতে হবে। তা হলেই মনের সংশয় কাটবে।
এই গানটা সেদিন শুনতে শুনতে ভাবছিলাম- কারা বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে যায়!
তারা অবিশ্বাসীরা নয় তো?
লালন আল্লার পরমভক্ত। ইসলামের নবীরও।
কাজেই, যারা বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গতে যায়-তারা কিছুতেই বিশ্বাসী নয়!
*ফরহাদ মজহার তাঁর “ভাবান্দোলন” বইতে এই গানটির বিশদ ও অসাধারণ ব্যাখ্যা করেছেন।
অবশ্যই পড়ে দেখবেন।