চমৎকার মেয়েটির সাথে প্রথম দিনের পরিচয়েই মোটামুটি আমার কঠিন ভক্ত হয়ে যায়...ভক্ত মানে একপ্রকার সুপার গ্লু। তার সকল কিছুর পরামর্শদাতা আমি...ডানে যাবো নাকি বামে, এটা করবো নাকি সেটা.... দিনে কম করে হলে ও ৬ বার ফোন।
পর্দা কিনবো কোথা থেকে?
প্রাইস চিন্তা করলে ওয়ালমার্টে থেকে কিনো আর কোয়ালিটি চিন্তা করলে হোম ডেকোর থেকে।
কি কালার কিনবো?
(হাধা) ফার্নিচারের সাথে ম্যাচ করে কিনো।
আমার ফার্নিচারতো ব্লাক তাই পর্দা ও কি ব্লাক কিনবো?
(গাধা) ব্লাক পর্দা কিনে কি ঘরে ছবি ওয়াস করবা????
পর্দা রড কিনবো কোথা থেকে?
একই জিনিস বেশী দাম দিতে চাইলে হোম ডেকোর থেকে কিনো।
এভাবে দশবার ফোনের পর, ওয়ালমার্টে দাড়িয়ে কল দেয় যে, রডতো কালো আর সাদা রং এর আছে, আমি কোনটা কিনবো?'
তাই বলে তাকে গাধা বলার কোনই কারন নেই, ইউক্রেনের ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স, ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া। তার দেশের নাম করা ইউগা টিচার।
প্রায় ইউকএন্ডে সে তার দু'ছেলেদের নিয়ে আমার বাসায় সারাদিন সময় কাটায়, যেকোন ইস্যুতেই আমার বাসায়...... দরকারী বা অদরকারী সেটা কোন বিষয় না। খুব হাসিখুশী, প্রচন্ড পরিশ্রমী, অসম্ভব সুন্দরী...... আমার বাচ্চারা শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করবে আজ কি আইসা আন্টি আসবে? কারন আইসা মানেই অনেক মজার কেক, আইসক্রিম আর গিফ্ট।
মাঝে মাঝে একটু চিন্তা করি, এখানে তো কেউ কারো বাসায় সহজে আসে না আর সে প্রায় ফোন না করেই চলে আসে। কিন্তু কিছুতো বলা যায় না..... সারাদিন বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটায়। আমরা প্রতিদিন নামাজ পড়ি দেখে প্রায় বলে, ''তুমি একটু আমার ছেলেদের ধর্ম নিয়ে কিছু বলো, ওরা জানুক ধর্ম পালনের উপকারিতা''। যদিও সে কোন ধর্মে বিশ্বাসী না কিন্তু সে চায় তার ছেলেরা একটা ধর্ম বেছে নিক।
একদিন বললো, আমি তোমার বাসায় প্রায় না বলে চলে আসি তুমি কি মাইন্ড করো?
আরে মাইন্ড করবো কেনো, আমার সহ বাচ্চাদের ভালো সময় কাটে।
ও বললো, ''ইউ আর সো হ্যাপি কজ ইউ হ্যাব এ লাভলি ফ্যামিলি।''
আমি হাসলাম, সবারইতো ফ্যামিলি আছে, এই তোমার চমৎকার দু'ছেলে, হাজবেন্ড, দেশে বাবা-মা, ভাই-বোন আছে... তোমারও তো চমৎকার ফ্যামিলি আছে।
না, তুমি যা দেখছো তা ঠিক নয়। আমি তোমার বাসায় আমার ছেলেদের নিয়ে প্রায় আসি কারন আমি শেখাতে চাই সত্যিকারের ফ্যামিলি কি? আমি কখনই আমার বাবাকে দেখিনি, আমি বড় হয়েছি আমার সৎ বাবা আর মায়ের কাছে। খুব চাইতাম বাবার আদর কিন্তু সৎ বাবা কখনই আমাকে কাছে টেনে নেয়নি। আমার যখন বয়স ১৭ তখন আমার ক্লাসের একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়। ওর ঘরে আমার বড় ছেলের জন্ম আমার ১৯ বছরে, আমাদের সম্পর্ক তারপরে এক বছর টিকে ছিল। বড় ছেলে বয়স যখন পাচঁ তখন ছোট ছেলের বাবার সাথে পরিচয়। ছোট ছেলের জন্মের পর ওর সাথে সম্পর্ক তিন বছর টিকে ছিল। এ্যালেক্সের সাথে পরিচয় গত বছর, ওকে আমি ভীষন ভালোবাসি। কিন্তু সে তো আমার ছেলেদের বাবা না, এ্যালেক্স সেভাবে ও তাদের কাছে টেনে নেয় না।
দেখো, আমারও ফ্যামিলি আছে কিন্তু আমার ছেলেরা তাদের বাবাদের চিনে না, কখনো বাবার ভালোবাসা পায়নি। আমি সারা জীবন একটা চমৎকার ফ্যামিলির জন্য মুখিয়ে আছি, একটি সত্যিকারের ফ্যামিলি, বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে সত্যিকারের ফ্যামিলি। কিন্তু আমি পাইনি, আমার মাও পায়নি আর আমার সন্তানরা ও পাবে কিনা জানি না। তাই তাদের আমি এ বয়স থেকে বোঝাতে চাই ফ্যামিলির কি, সত্যিকারের ফ্যামিলি কেমন হয়, বাবাদের ভালোবাসা কেমন হয়.....।
আন্টি:
রিসেপশানের ফোনটা অনেক্ষন ধরে বাজছে। তারমানে মিথিলা নেই সেখানে। যেহেতু এটি টেলি-কমিউনিকেশান অফিস, সারাক্ষনই কাস্টমার সার্ভিস দিতে হয়। অফিসের সিস্টেম হলো ৩ বার রিসেপশানে রিং হবে, সেখানে মিথিলা না ধরলে ভিতরের ফোন বেজে উঠবে। এবং অন্য কেউ ধরবে এবং নোট রাখবে প্রবলেম আইডেন্টিফিকেশান সফ্টওয়ারে।
আমি সাধারনত এ সব পাবলিক কল থেকে ১০০ হাত দূরে থাকার চেস্টা করি কারন হিসাব-নিকাশের কাজ করতেই দম যায়, বাড়তি ফোন ধরার সময় কোথায়? আর এক একটা ফোন মানে দশ মিনিট গায়েব। পাবলিক ভাবে টাকা দিচ্ছি মাসে, এক মিনিটের জন্য ফোন নেট অফ থাকতে পারবে না ......... ২৪ আওয়ার সার্ভিস ১০০০ মাইল স্পিডে, ফোনের ডায়াল টিপার সাথে সাথে ইন্টারনেট প্রবলেম সল্ভ হয়ে যাবে......। অসংখ্য কথার অপচয়, আর মাথা ঠান্ডা রেখে, ধৈর্য্য ধরে পাবলিকরে বোঝানো অন্তত আমার কর্ম না। একমাত্র মিথিলাই ট্রেনিং প্রাপ্ত, চমৎকার করে দুয়ে দুয়ে পাঁচ বুঝিয়ে রেখে দেয়....... । আর এটি বাংলাদেশ না যে বসিয়ে বসিয়ে মাস শেষে বেতন দিবে ... আওয়ারলি বেতন.... ঘন্টায় কাজের হিসেব..... সারাদিনের আউটপুট কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেয়। এমন কাজ এসাইন করা থাকে যে এক মিনিট ও নষ্ট করার উপায় নেই.. আর দিন শেষে নিজের কাজেরই হিসাব হবে ফোন ধরার না।
পাঁচবার রিং হবার পর বুঝলাম, ইন্জিনিয়াররা ও নেই টেবিলে তাই বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে খুব আকুলভাবে বাংলায় বলে উঠলো, আপু আমার খুব সাহায্য দরকার, আপনি কি একটু সাহায্য করতে পারবেন?
-কিভাবে সাহায্য করবো?
- কাল আমার মা-বাবা ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে, তাদের বয়স ৮০ এর উপর। আজ পৈাছার কথা কিন্তু কোন ভাবেই খোঁজ পাচ্ছিনা।
- সেক্ষেত্রে আমরা কি করতে পারি, সেলফোন থাকলে তাদের কাছে ফোন করুন।
- সরি আপু বদার করানোর জন্য। তাদের কোন সেলফোন নেই শুধু আপনাদের দেয়া ল্যান্ডফোন আছে। কিন্তু ফোন দিচ্ছি, রিং হচ্ছে কিন্তু কেউই ফোন ধরছে না। আমার বাবার বয়স ৮০ এর উপর আর মায়ের ও কাছাকাছি। তারা দু'জনই খুব অসুস্থ।
- এয়ারপোর্ট থেকে কে রিসিভ করেছে তাদেরকে ফোন করুন আর আমাদের ফোনের কি সমস্যা তা জেনে আবার কল করুন আমি দেখছি এখান থেকে ফোনের কোন সমস্যা আছে কিনা।
- আপু, কি বলবো বলেন আমার ভাই অন্য বাসায় থাকে, ওর সময় ছিল না তাই ও এক ট্যাক্সি কল দিয়ে ড্রপ করেছে ওনাদের এয়ারপোর্ট থেকে।
-মানে কি? আপনার ভাইকে বলেুন খোঁজ নিতে?
ওর খুব ইম্পর্টেন্ট অফিসিয়াল কাজ আছে তাই সময় বের করতে পারছে না খোঁজ নেয়ার।
মানে কি!!! মনে মনে বললাম ছেলে না কুলাঙ্গার!!!! কিন্তু আমি এখানে কি করতে পারি?
মহিলা প্রায় কেদেঁ ফেললো, ভাইয়ের সেল বন্ধ, আপু আমি এমন কাউকে জানি না যে তাদের খোঁজ নিবে, একমাত্র আপনাদের অফিসের নাম্বারই আছে। আমার বাবা দেশে থাকতেই খুব অসুস্থ ছিল, শুধু ভিসার মেয়াদ চলে যাচ্ছে তাই গেছেন। আপনি কি কোনভাবে কাউকে পাঠাতে পারেন।
খুব মায়া হলো, ইমার্জেন্সী সার্ভিসে রিকোয়েস্ট পাঠালাম। এক বাঙ্গালী ইন্জিনিয়ার ভাইকে রিকোয়েস্ট করে সব বলে কয়ে পাঠালাম এড্রেস মতো। ফিরে আসতেই ইন্জিনিয়ার ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম নিজের আগ্রহে। ইন্জিনিয়ার ভাই যা বললো তার সারমর্ম হলো,
ভাই এসেছে এখানে তার বউ এর থ্রোতে। মা-বাবার জন্য সিটিজেনসিপের এপ্লাই করেছে ভাই-বোনদের অনুরোধে। তাদের বয়স ৮০ এর উপর, বউ চায় না শশুড় বাড়ীর লোকজনকে টানটে কিন্তু ভাই-বোনদের অনুরোধে তাদের ভবিষ্যতে বিদেশে আসার পথ করার জন্য মা-বাবার নামে এপ্লাই করে। এখানে তারা ওল্ড-হোমে থাকেন, সরকারী যা ভাতা পায় তা দিয়ে বুড়া-বুড়ি কোনরকমে চলে। বয়স হয়েছে তাই ভদ্রলোক কোনভাবেই আসতে চায়না এখানে, দেশে একটা থাকার জায়গা আছে, কিছু পেনশান আছে, বন্ধু-বান্ধব আত্বীয় স্বজন আছে, নাতি-নাতনী আছে। এখানে কিছুই নেই.... ছেলে-মেয়ে, বন্ধু-বান্ধব আত্বীয়-স্বজন....... একমাত্র ৯১১ ছাড়া, শেষ বেচেঁ থাকার ভরসা। এক বেডের রুমে কোন রকমে দিন পার করে, একা একা হেটে বাজার, রান্না, ওষুধ সব করতে হয়। ভালো লাগে না এভাবে থাকতে, প্রচন্ড ঠান্ডায়, একা একা সারাদিন থাকতে চায়না এখানে বছরের পর বছর। কিন্তু দেশের ছেলে-মেয়েরা জোর করে এখানে পাঠায় নতুবা তাদের বিদেশে আসার পথ হবে না............. তাদের ভবিষ্যত স্বপ্ন পূরণ হবে না ....
ভালো থাকুন।
আগের পর্ব:আমার নিকটতম প্রতিবেশীরা - পর্ব-২
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ৯:৪১