সৈয়দ নজমুল হক (১৯৪১-১৯৭১) একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী। পেশাগত জীবনে তিনি একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি আলবদর বাহিনী দ্বারা অপহৃত হন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবনঃ
সৈয়দ নজমুল হক ১৯৪১ সালের ৫ জুলাই খুলনা জেলার কান্দাপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। একই জেলার পয়গ্রাম কসবা গ্রামে ছিল তাঁর পৈতৃক নিবাস। নিজ গ্রামেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৬৪ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা এবং ১৯৭০ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনঃ
সৈয়দ নজমুল হক ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁরই সম্পাদনায় ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকদের পত্রিকা Vista প্রকাশিত হয়। সেই বছরই তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালে (পিপিআই) সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দ নজমুল হক পিপিআই-এর চিফ রিপোর্টার পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। ১৯৬৭ সালে সৈয়দ নজমুল হক পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ইনফরমেশন সার্ভিসের জন্য মনোনীত হন। কিন্তু সমাবর্তন মামলায় তাঁর ভূমিকার জন্য পুলিশের ছাড়পত্র না পাওয়ায় চাকরিতে যোগদানে ব্যর্থ হন। পরে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। নজমুল হক ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সম্পূর্ণ প্রসিডিংস-এর রিপোর্ট করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে অক্টোবরে ইউরোপ সফরে গেলে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে সৈয়দ নজমুল হক তাঁর সফরসঙ্গী হন। এ সময় তিনি বিবিসি এবং লন্ডন টেলিভিশনে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও জাতীয়তাবাদের পক্ষে তাঁর জোরালো মতামত তুলে ধরেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজমুল হক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য “শ্যামা” পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালনায় “চন্ডালিকা” নৃত্যনাট্য ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলে এবং ১৯৭০ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মঞ্চস্থ হয়। এছাড়া তিনি নিয়মিত ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনে নাটক, কথিকা ও একাঙ্কিকায় অংশগ্রহণ করেন। নজমুল হক ১৯৬০-৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন।
আন্দোলনে ভূমিকাঃ
ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নজমুল হক সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এছাড়া ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল কার্জন হল প্রাঙ্গণে। সেখানে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলনে অংশ নেন। একারনে তিনি মিছিল থেকে গ্রেফতার হন এবং কনভোকেশন মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে কারারুদ্ধ হন। পরে তিনি উচ্চ আদালতের রায়ে মুক্তি পান।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাঃ
নজমুল হক ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতন ও নৃশংসতার সংবাদ বহির্বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই কারণে ঐ বছরের ৬ আগস্ট সামরিক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তাঁকে ঢাকায় নিয়ে এসে নজরবন্দী রাখা হয়। ১৯ অক্টোবর পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
নিখোঁজঃ
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা সৈয়দ নজমুল হককে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
সূত্রঃ
(১) স্বরনের আবরনে মরনেরে রাখে ঢাকি : আমার চাচা সৈয়দ নজমুল হক
(২) উইকিপিডিয়া
(৩) বাংলাপিডিয়া