বহুযুগ আগে এদেশের সংস্কৃতি ছিল মেয়েরা শুধুমাত্র ঘরের মধ্যে থাকবে। ঘরকন্যার কাজ করবে। ছোট মেয়েরা বড় হওয়ার আগে তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। ঘরের বাইরে মেয়েদের কখনও দেখা যেতো না।
দু একটা মেয়ে যদি এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যেতো তার নামে কুৎসা রটানো হতো আর বিয়ে হতো না তার খুব সহজে।
.
আমার এক দাদী বলতো " মাইয়্যা গো কাম হইছে খাটে
আর পোলা গো কাম হইছে মাঠে "
পূর্বের এই ধ্যান-ধারণার ধারক ও বাহক ছিল কাঠ মোল্লারা।
যাদের ভাষ্যমতে মেয়েরা হচ্ছে তেতুলের মত, দেখলেই লালা ঝড়ে।
সুতরাং মেয়েরা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গেলে তা দেখে পুরুষের দৈহিক আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হতে পারে।
.
এই প্রচলন শুধুমাত্র কাঠ মোল্লাদের কাছে নয় বরং সকল ধর্মের ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের কাছে প্রচলিত রীতিগত প্রথা।
জেরুজালেমে পাঁচ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের সাইকেল চালানোকে ‘নির্লজ্জতা’ আখ্যায়িত করে তা নিষিদ্ধ করেছেন ইহুদি এক ধর্মগুরু। ( কমেন্টে লিংক)
আবার ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে ১২ থেকে ৫০ বছরের মহিলাদেরই শুধুমাত্র ঢুকতে দেওয়া হয় না। কারণ তাদের ঋতুচক্র চলার সম্ভাবনা থাকে। ( লিংক কমেন্টে)
.
কিন্তু শালীনতা বজায় রেখে শুধু সাইকেল চালানো কেন? নিশাত মজুমদারের মতো এভারেস্ট জয় করেও আসা সম্ভব।
কিন্তু প্রধান প্রতিকূলতা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
... আমাদের দেশে মেয়েদেরকে সেভাবে কোন কাজে উৎসাহ দেয়া হয় না। ‘লোকে’ কী বলবে, এইটা আমরা বেশি ভয় পাই। যতটা না মেয়েরা বড় হতে হতে নিজেরা ভয় পায়, বড়রা বিশেষ করে নিজের সবথেকে আপনজনেরা – বাবা-মা, ভাইবোন, পরিবারের অন্যরা, তাদের মনে ভয়টা জোর করে ঢুকিয়ে দেয় –
তুমি তো পারবা না! তুমি করলে সবাই ছি ছি করবে! তোমাকে বিরক্ত করবে, তোমাকে মন্দ বলবে। - ইত্যাদি, ইত্যাদি। হ্যাঁ-এর আগেই না!....
.
দেশের অর্ধেক পুরুষ আর অর্ধেক নারী। অর্থাৎ প্রায় ৮-৯ কোটি নারী।
এত বড় জনগোষ্ঠী কি খাটে থাকলে দেশের উন্নতি হবে নাকি পর্যাপ্ত শালীনতার মাধ্যমে মাঠে পুরুষের সাথে এক হয়ে কাজ করলে। কোনটা যুক্তিযুক্ত?
পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো থেকে আমরা ২০০ বছর পিছিয়ে আছি এখনো। ভাবা যায়?
একই আবদ্ধ চিন্তা ধারার কারণে পাশ্ববর্তীদেশের তুলনায় আমাদের দেশের মাথাপিছু আয় অনেক কম।
.
নেদারল্যান্ডের এক রাজধানীতে ৭ লাখ মানুষ তবে সাইকেলের সংখ্যা ১০ লাখ। অর্থাৎ সাড়ে ৩ লাখ মহিলা ৫ লাখ সাইকেল চালায় শুধুমাত্র আমস্টারডাম রাজধানীতে।
কিন্তু আমাদের ঢাকায় প্রায় ১ কোটি নারী আছে ( সম্ভবত)।
তবে নারী সাইক্লিং হাতে গোনা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার হবে কি না সন্দেহ আছে।
নারী সাইক্লিং এর সংখ্যা কম হওয়ার ২ টি কারণ হতে পারে :
১. লোকে কি বলবে? ( অর্থাৎ আমাদের নারীলোভী দৃষ্টি ভঙ্গি)
২. অপর্যাপ্ত সড়ক ( অর্থাৎ আলাদা সাইকেল রুট নেই এবং সেইফ রোডের অভাব)
.
পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সড়ক ও মহা সড়কে সাইকেল চালানো আলাদা রুটের ব্যাবস্থা আছে যার মাধ্যমে যানজট নিড়সন অর্ধেক হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশে আলাদা সাইকেল রুট তো নেই তার উপর মেয়েদের সাইকেল চালাতে দেখলে নানা কটুক্তিমূলক কথা ছুড়ে দেওয়া হয়।
যার কারণে পিতা-মাতা ও নিজের মেয়েদের স্বাধীনভাবে সাইকেল চালানোর অনুমতি প্রদান করে না।
.
তবে এইবার উত্তরাঞ্চলে বন্যায় বন্যার্তদের ত্রান দিতে গিয়ে তার উলটো দিক পরিলক্ষিত করলাম।
উত্তরবঙ্গ-র বেশিরভাগ গ্রামের মেয়ে স্কুল-কলেজে,মাদ্রাসায় যাতায়াত করে সাইকেল দিয়ে।
এক সরেজমিনে দেখা গেছে উত্তরবঙ্গ-র গ্রাম অঞ্চলের শতকরা ৭৫ ভাগ মেয়ে শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে সাইকেলে। (লিংক কমেন্টে)
ব্যাপারটা কত চমৎকার!
শহুরে মেয়েদের তুলনায় গ্রামের মেয়েরা সব প্রতিবন্ধকতা, বাধা-বিপত্তি পেড়িয়ে বেশি সাইকেল চালানোর প্রতি আগ্রহ।
.
এইবার এই প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে আমার কয়েকজন মেয়ে বন্ধু ও তার পরিচিতরা মিলে সাইকেল চালানো নিয়ে বেশ আগ্রহ সহকারে আগাচ্ছে।
খুব ছোট্ট পরিসরে শুরু করলেও ১০ দিনের ট্রেনিং শেষে সাইক্লিং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ জন। যাদের গুরুত্বসহকারে ট্রেইন করে আসছে ট্রেইনার সায়েদ ভাই।
এই জন্যে সায়েদ ভাইকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাই।
.
নিশ্চিত এই মেয়েদের রাস্তায় সাইকেল চালানো দেখা ২ ধরণের প্রাণী রয়েছে।
একদল মনে মনে ভাবে, "বাহ অপূর্ব! মেয়েরা আগাচ্ছে সমানতালে। ( কিন্তু তারা সরাসরি উতসাহ প্রদান করে না)"
আরেকদল ভাবে, "ছেঃ ছেঃ সমাজটা নষ্ট হয়ে গেল, এই মেয়েদের আর বিয়ে হবে না। ছেঃ"
.
কিন্তু একবার ভাবুনতো যখন দেখবেন একসাথে ২০ টা মেয়ে এক রাস্তা দিয়ে ২০ টা সাইকেল নিয়ে রাইড করছে।
রাস্তা না পুরো এলাকাটাই কিন্তু কেপে যাবে।
এদের মাঝে অনেকে বিভিন্ন ন্যাশনাল আর ইন্টারন্যাশনাল গেমসেও অংশগ্রহণ করতে পারবে।
.
আচ্ছা এমন ও তো হতে পারে আমার এই বন্ধুদের মাঝ থেকেই একজন সাইকেল বাদ দিয়ে স্কুটি চালিয়ে কোন সরকারী ব্যাংকের অফিসে যাবে অথবা হতে পারে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও।
তখন কি মেয়েটিকে বিয়ে করার পাত্রের অভাব হবে নাকি সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে?
তবে মূল ভিত্তিটা আমাদেরই গড়ে দিতে হবে। আমাদেরই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। শুধু ছেলে নয় মেয়েদের ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর খুব বেশি জরুরী।
উৎসাহ না দিতে পারলেও অন্তত দুর্বার এগিয়ে যাওয়া মেয়েদেরকে নিরুৎসাহিত না করি।
তবে উৎসাহ দেওয়াটা সবচেয়ে জরুরী। যেহেতু দেশটা আমাদের, দেশের দায়িত্বটাও আমাদের।
তাই নয় কি বন্ধু?
Change your OUTLOOK, Break the PREJUDICE ...
And Make Bangladesh proud again as we were done in 1971.