নতুন প্রজন্ম কি শিখছে তা নিয়ে আতংকিত না হয়ে আপনি কি কি শিখছেন এবং অপরকে শিখাচ্ছেন সেই দিকে বেশি গুরুত্ব দিলে আর নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমার আপনার ভাবতে হবে না।
.
যতটুকু মনে হচ্ছে ১৯৯১- ৯৯ সাল পর্যন্তই যেই জেনারেশন টা জন্ম নিছে এটাই সর্বশেষ জেনারেশন যাদের কমন সেন্স বলে কিছু আছে।
আমরা প্রযুক্তি নিয়ে নিজেকে যতটা আপডেটেড মনে করি ততটা আপডেটেড আমরা না।
বিদেশীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে আমাদের গলাধঃকরণ করাচ্ছে আর আমরা সেটা নিয়ে হৈহুল্লোড় করে, নেগেটিভলি ইউজ করে নিজেদের ক্লাসি ভাবি। কিন্তু প্রযুক্তি আমাদের খেয়ে দিচ্ছে সে দিকে খেয়াল রাখি না।
আমরা বাংলাদেশীরা কয়টা প্রযুক্তি বিশ্ববাজারে ছড়াতে পারছি? উল্টো প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের খেয়ে দেয়।
.
৮-৯ বছর আগে যখন ছোট ছিলাম আম্মা আমাকে অনেক গল্প শুনাতো। ভূতের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, নদ-নদীর গল্প, বাংলা ছবির সুজন-সখী দেখার গল্প, শুকতারা ঝড়ে যাওয়ার কল্প কথা।
এখন আম্মা আর শুনায় না গল্প। অবসর সময়ে স্টার জলশার কিরণমালা নিয়ে বসে থাকে।
আর আমি সিমসিমির সাথে গল্প করি। আহ!
.
একটা বাচ্চা কিভাবে তার দেশ সম্পর্কে জানবে, কিভাবে নিজে আচার ব্যবহার করবে, কিভাবে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে সে শিক্ষা পায় তার পরিবার থেকে। কিন্তু ইয়ো ডুড পরিবার সন্তান জন্ম দিয়ে ইয়ো ডুড-ই বানিয়ে দেয়।
বাচ্চা কান্না করলে ৩৬" সনি টিভিতে নবিতা বা মটু পাতলু দিয়ে বসিয়ে রাখে।
আগের মত আর রুপকথার গল্প শুনিয়ে বাচ্চার কান্না থামানো হয় না।
একটু বড় হলেই তাদের ভিডিও গেমস ধরিয়ে দেওয়া হয়। যাতে বাবা-মা কে বিরক্ত না করে। অথচ আমরা ছোট বেলায় সাতার কাটা শিখেছি, কোন গাছে ঘুঘু পাখি ছিল তা খুজে বের করেছি।
কোন পুকুরে মাছ আছে সেখানে বরশি নিয়ে বসেছি।
এখন বড়শি দিয়ে ভিডিও গেমসের মাছ ধরে। আর সাতার? ওতো সুইমিং পুলে ভেসে ভেসে সাতার কাটা শিখে নিবো নে।
.
আরেকটু কিশোর বয়স এলেই বলিউডের কোন নায়িকার কত সাইজ তা নিয়ে বসে যায়। বাবা-মা ইমরান হাশমির ফ্যান। আর ছেলে আলিয়া ভাটের।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আরবী শিক্ষা গ্রহন করতে হতো। এখন দুপুর ১২ টায় ঘুম ভাংগে।
সারাদিন অফিস করে এসেছি বাবা এখন জালাস নে বাবা এই নে স্মার্টফোন এটা নিয়ে টিপতে টিপতে ঘুমিয়ে পড়।
আমার খালা আগে আমাকে বই কিনে দিতো। গোপালভাড়ের ১০০ সেরা গল্প, বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বগাথা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প। প্রচুর গল্পের বই ও পড়তাম।
এখন অবসরের সময়ে খালার ছবিতেই ক্যাপশন পড়ি আর ফেসবুকিং চ্যাট আড্ডা, কোন বন্ধু কয়টা মাইয়া পটাইলো ফেসবুকে তা নিয়া মেতে থাকি।
.
মূলত একটা শিশু কিভাবে বেড়ে উঠবে তা নির্ভর করবে তার পরিবার কিভাবে তাকে ট্রিট করবে তার উপর। পরিবারের গুরুজনকর্তৃক শিশু মৌলিক শিক্ষা না পেলে সেই শিশু কিশোরে পরিণত হয়ে ভ্যালেন্টাইনস ডে কবে সেটা বলতে পারবে কিন্তু ভাষা দিবস কবে তা বলতে পারবে না।
যেদিন আপনি আপনার পরিবারের ছেলেমেয়ের হাতে ক্লাশ অফ ক্লান খেলার জন্য স্মার্ট ফোন তুলে না দিয়ে ক্লাশ অফ ক্লানের মত একটা জনপ্রিয় গেমস কিভাবে নিজে বানাতে পারবে তাতে উদ্ধব্ধ করবেন সেদিনই নতুন প্রজন্ম নিয়ে গর্ব করতে পারবেন।
.
আমার মেঝো ভাই বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেছে। বাসায় অনেকগুলা পিসি। পিসিতে আমাকে গেমস খেলতে দেওয়া হয়, ফেসবুকিং করতে দেওয়া হয়। কিন্তু যদি পিসিকে খুলে এর ভিতরের যন্ত্র মাদারবোর্ড, রেম, হার্ডডিস্ক, প্রসেসর নিয়ে নাড়াচাড়া দিয়ে শিখতে চাই এগুলা কেন, কি জন্য এখানে বসানো হলো সেদিন আমাকে আর বাসায় রাখবে না।
যেই কয়টা ছাত্রছাত্রী মেধা খাটাতে চাচ্ছে তাদেরকেও সিলেবাসের ভিতর জীবন আটকে দিচ্ছে আমাদের পরিবার গুলো।
এজন্যই বোধহয় আমাদের দেশের আইনস্টাইন, নিউটনরা জন্ম নেয় না।
আমাদের মাথায় আপেল পড়লে আপেল কে আগে খাবে তা নিয়ে উঠে পড়ে লাগি কিন্তু আপেল কেন মাথায় পড়লো উপরে উঠে গেল না কেন তা নিয়ে ভাবি না।
যারাও ভাবতে চায় তাদের ডায়লগ শুনতে হয় " এই ছেলে কাল না তোমার পরীক্ষা? নিউটনের সূত্র ৩ টা মুখস্থ করছো? আপেল উপরে ফিক্কা মেরে কি ভাবছো তুমি নিউটন হইয়া গেছো। বেয়াদপ পোলা আপেল খাও বুদ্ধি বাড়বে এরপর আইনস্টাইনের সূত্র গুলাও গলাঃধকরণ করতে হবে যে"
.
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের পরিবার জিপিএ ৫ মুখী কিন্তু মেধা যা চাচ্ছে সেই দিকে অগ্রগামী নয়।
আমাদের বাবা-মা কে যদি বলি আমাকে DSLR কিনে দেও আমি ফটোগ্রাফি তে কোর্স করবো, আমি পরিচালক হবো, আমি ভাল আর্ট করবো।
তাহলে আগে ডাইলগুটনী দিয়া বাড়ি দিয়া বলবে অমক-তমুক স্যারের পড়া শেষ কর কাল কোচিংয়ে যাইয়া নোট গিলবি কোর্স কইরা কি হইবি? তোকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে।
অমুক বাড়ির তমুক পোলা এ প্লাস পাইছে তুই জিপিএ ৪ কেন তোর মইরা যাওয়া উচিত।
আমাকে আমার পরিবার, আমার শিক্ষাব্যবস্থা, আর প্রযুক্তির অপব্যবহার খেয়ে দিয়েছি। অনেককেই খাচ্ছে চিবিয়ে চিবিয়ে ধুমরে মুচড়ে।
.
চীনে ২০-২১ বছরেই ওপেন হার্ট সার্জারির স্পেশাল ডাক্তার হয়ে পাশ করে ডিগ্রি নেয় আর আমার সোনার বাংলায় ছেলেমেয়েদের বুড়া ঝুনঝুনা হইয়া ওপেন হার্ট সার্জারি স্পেশালিষ্ট হতে হয়। অনেকে বাচ্চা নিয়া ট্রেনিং করে।
কেউ পরিবারের চাপে প্রেস্ক্রিপশন লিখার মত ডাক্তার হইয়া ঝইড়া পড়ে।
.
ছোটবেলা থেকেই নেশা থাকা উচিত ঘটনার পিছনের ঘটনা খুজার জন্য। আর এখনকার ছেলেমেয়েদের নেশা গুটি ফাটাইবো, নিকোটিন ফুকবো তা নিয়া। এই নিকোটিন দেহের কি কি ক্ষতি করে অংগ প্রতংগ কোথায় সমস্যা করে সেটা নিয়া মাথা ঘামাইয়া কি হবে? তার বাবা-ই তো বড় নেশাখোর, আর ভাইদের কথা নাই বললাম। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আর পরিবার দায়িত্বশীল না হলে নতুন প্রজন্মের কাছে এটা ও শুনতে হতে পারে ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ বলে কোন কথাই ছিল না। পাক-ইন্ডিয়ার খোচাখুচির ইট্টু আচ লাগছিলো বাংলাদেশে আর কি!
.
ছাত্রছাত্রীদের ভাবনার দেয়াল সিলেবাস, এক্সাম, কোচিংয়েই বর্ডার করা হয়েছে এর বাইরে যেতে চাইলেই পরিবার এবং শিক্ষা ব্যবস্থা গুলি কইরা শিক্ষার্থীদের তারকাটা বেড়ায় ফেলানীর মত ঝুলাইয়া রাখে।
আমাদের সমাজ ও দায়ী। এখানে তুমি দুই উদ্ভিদের জীন নিয়া নতুন উদ্ভিদ বানানোর জন্য বছরের পর বছর গবেষণা করতে পারো কিন্তু সমাজের লোকজন ভাববে তুমি কৃষিকাজ করো, ক্ষ্যাত কোথাকার গাছ আর মাটি নিয়ে পড়ে থাকো।
.
ছেলেমেয়েগুলা জিপিএ ৫ না পেলেও বলতে পারার কথা আমাদের স্বাধীনতা দিবসের কথা। এই যে লজ্জাজনক ব্যর্থতা কার? এই দায়ভার কার?
ব্যর্থতা আমাদের পরিবারের। কারণ এখানে মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। এই দায়ভার আমাদের এডুকেশন সিস্টেমে যেখানে হাতে কলমে শিক্ষা নেই। এখানকার শিক্ষা মগজ বোঝাই করায়।
ভিডিও টা সত্য না মিথ্যা তা নিয়ে ইস্যু লম্বা না করে আপনার স্কুলমেট বা কলেজমেট গুলোকে এই প্রশ্ন গুলো করেন:
১. ছয়দফা আন্দোলন কতসালে হয়েছে?
২. গণ অভ্যুত্থান কত সালে হয়েছে?
৩. কাকে বাংলার বাঘ বলা হয়?
আমি ড্যাম শিউর ৪০% এই উত্তর পারবে না। কিছুকিছু উত্তর আমিও পারি না। কিন্তু কেন আমি পারি না ? কেন আমার পরিবার আমাকে শিখায় নি এই উত্তর গুলো খুজতে গেলে দেখবেন আপনার সাথের শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স পাশ আর আপনি আদু ভাই।
.
টেষ্ট পরীক্ষায় আমার বন্ধুরা ধুমাইয়া লিখে আর আমি জানালা দিয়া তাকাইয়া ভাবি ফুলটা লাল দেখায় কেন? কালো হইলে কি হত।
ছেলেটা বলটাকে লাথি মারলো এখানে নিউটনের বলতত্ত্ব প্রয়োগ হইলো কিভাবে? রাস্তা দিয়া গাড়ী হর্ণ বাজাইয়া গেল শব্দদূষন। এমন কি সিস্টেম নাই যেখানে হর্ণের আওয়াজ একটা শ্রাব্যতার সীমার ভিতর থাকবে যাতে শব্দ শুধু সামনের গাড়ি শুনতে পায়।
ভাবতে ভাবতে ইন্টারে টেষ্ট পাশ করতে পারলাম না। নাহ এইবার আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না।
এই শিক্ষাব্যবস্থায় ২৫ বছর হওয়ার আগে বিজ্ঞানমনস্ক কিছু ভাবাও পাপ। আর মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে ছাতার মাথা করুম চাকরীর সময় কোঠাটা পাইলেই হয়।
তোমার এখন বয়স হয় নাই বাচ্চা মিসাইল কি তা নিয়ে গবেষণা করার। তুমি আয়রন ম্যান মুভিতে মিসাইল দেখো আর ক্লাশ অফ ক্লান গেমস খেলো বাচ্চাকাচ্চারা।
এই জন্যেই বোধহয় চাঁদে বাংলাদেশের পতাকা নেই। ছোটবেলার মত আয় আয় চাঁদ মামা কবিতা টা পর্যন্ত ও এখন সবাই ভুলে গেছে।
.
নতুন প্রজন্মকে নিয়ে মোটেও চিন্তিত নই এই নতুন প্রজন্মে কি শিখছি তা নিয়ে চিন্তিত।
পরিবারের আগ্রাসী মনোভাব আর ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ নিয়ে চিন্তিত।
একবার ভাবুন তো আমাদের পরিবার গুলো যদি এভাবে শিক্ষা দিতো যে অবসর সময়ে টিভিতে নবিতা না দেখে এই টিভির মাঝে কেন রঙিন কালার হলো? কিভাবে ডিশ লাইনের তারের ভিতর দিয়ে ছবি পাঠানো হয়? ওয়াইফাই তে তার ছাড়া কিভাবে নেট ব্রাউজিং করছি?
এই শিক্ষাগুলো দেওয়া গেলে সাইন্স আমাদের গিলতে হতো না আলাদা সময় বের করে এক্সামের খাতায় লিখে। আপনা আপনি এই দেশে ৪-৫ টা করে গ্যালিলিও জন্ম নিতো।
যে ভাল লিখতে পারে তাকেও কদর করা হয় না। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই-ই তো পড়ার অভ্যাস নাই কিভানে লিখকদের কদর করবে।
তাই আর বিদ্রোহী লিখক ও জন্ম নেয় না।
.
ছোটদের কথার মূল্য ও দেওয়া হয় না অনেক পরিবারে। আমি ম্যাথের একটা থিউর কেন শিখবো? ৪-৫ টা থিউরি কেন নয়? এটা ভাবলে নরকে অর্ধেক চলে যেতে হয়। ম্যাথম্যাটিকস ও এখন মুখস্থ করতে হয়। বাজারে সাজেশন গাইড তো আছেই। পরিবারের বাচ্চাদের মুক্তচিন্তার অধিকারী হতে দেওয়ার সুযোগ গুরুজনদের হাতে।
জিপিএ ৫ এর জন্য শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ দিবেন না। এই ফার্মের এ প্লাসের মূল্য ভার্সিটি লেভেলের আগ পর্যন্তই। সস্তা জিপিএ৫ এর জন্য শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না।
.
নতুন প্রজন্ম তুমি হয়ে যাচ্ছো মহান
প্রযুক্তির খেলায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তুমি
হারিয়ে ফেলেছো মান সম্মান।
গুরুজনকর্তৃক নিষ্পেষিত তুমি থাকো মাথা করে নিচু
সাদা কাগজে গলাধঃকৃত বর্জ উগ্রে দিয়ে
ভাবো নিজেকে উঁচু।
ওহে প্রজন্ম তুমি হইয়ো না মুখস্থধারী
সিলেবাসের গন্ডি পেরিয়ে হতে হবে
মুক্তচিন্তার অধিকারী।