টং দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম।
শফিক মামার দোকান। ছোটকাল থেকেই এই দোকানটাকে ঘিরে আমার খুব আগ্রহ। সার্কাসের হাতি আসতো। শফিক মামার দোকানে আসতো হাতি। পিঠে তার সওয়ারী। কত বিশাল প্রাণী। সালাম দিতো শফিক মামাকে । শফিক মামা দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিতো হাতির সুরের দিকে।
ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি তখন মজিবুর স্যার জিজ্ঞেস করলেন,”অই তুই বড় হয়ে কি হবিরে”?
আমি নির্লীপ্ত ভংগিতে বললাম,”আমি বড় হয়ে চায়ের দোকান দিবো”। নাম হবে “টং”।
ক্লাস ভর্তি সবাই হেসে উঠলো।
মজিবর স্যার বললেন ,”হাসিস না কেউ। আচ্ছা টং দিতে চাস কেন?”
আমি এবার উতসাহিত বললাম,”স্যার আমাদের বাড়ীর নীচের রাস্তায় এক টং দোকান আছে। শফিক মামার দোকান। সেই দোকানে বিশাল বড় হাতি আসে। সেই হাতি দোকানের মালিক শফিক মামাকে সালাম দেয়। কত্ত বড় প্রাণী চিন্তা করেন। সেই প্রাণী যদি টং দোকানের মালিককে সালাম দেয় তাহলে কত সম্মানের ব্যাপার চিন্তা করেন। তাই আমিও টং দোকান দিবো আর হাতির সালাম নিবো”।
এবার মজিবর স্যারের মুচকি হাসি ছাড়া কারো মুখে হাসি দেখলাম না।
যাই হোক কয়েক বছরে বুড়িগঙ্গার পানি কালোর চেয়েও কালো হয়েছে। আর আমার টং দোকান এর মালিক হবার সম্ভাবনা বেড়েছে।
ক্লাস নাইনে ফেল করলাম। ম্যাট্রিক পাশ করলাম কস্টে । ইন্টারে আর হলো না। ফেইলই করে বসলাম।
বাবা বললো,”সবাইরে দিয়া পড়ালেখা হয় না”। তোর ও মনে হয় হইবো না। কোন কাজ কর।
কি কাজ করবো চিন্তাই আসে না। তাই সেই শফিক মামার দোকানে বসে চা খাই। চা খেলে মাথায় দার্শনিক টাইপের চিন্তা ঘুরে। অনেক রিক্সাওয়ালাকেও দেখেছি আব্রাহাম লিংকনকে নিয়ে এমন ভাবে গল্প করতে যেনো লিংকন সাহেব আর তিনি ছোট কালে একসাথে পুকুরে গোছল করতেন। একজনের লুংগি আরেকজন ফাজলামি করে খুলে দিতেন। আর লিংকন মুখ খারাপ করে বলতেন,”শালার পোলা এইটা কি তোমার বাবার লুংগি?
যাই হোক কত ব্যাবসায়ের চিন্তা ঘুরে। হিসাব আর মিলে না। আমি চা খাই। চায়ের কাপে পিপড়া ভাসে। পিপড়া ফেলে দিয়ে আবার কাপে চুমুক দেই।
একদিন বসে বসে চা খাচ্ছিলাম এমন সময় দেখলাম দামী একটা গাড়ী এসে থামলো টং দোকানের পাশে। ভাবলাম কোন বড়লোকের ছেলে হয়তোবা সিগারেট নিতে থেমেছে।
কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে এক সুদর্শন পুরুষ নামলো গাড়ী থেকে। হাতে সাধারন এক মোবাইল। চোখে চশমা। কিন্তু তার সব থেকে সুন্দর হচ্ছে তার চোখ। পুরুষদের চোখ এতো সুন্দর হয় জানতাম না। তার দুচোখে যেনো আত্ববিশ্বাসের পাহাড় আছে। প্রচন্ড উচ্ছল তার চোখ দুটো।
সে এসে আমার পাশে বসলো। এক কাপ চা নিলো। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,”ধুর শালা কি বালের চা বানাইলো। গরুর মুত ও মনে হয় এর থেইকা ভালা”।
আমি হা হা করে হেসে উঠলাম।
সে বললো কি ভাই হাসেন কেন?
বললাম”আপনার কথা শুনে ভাই”।
সে বললো,”কইয়েন নারে ভাই আমার কথা শুইনা সবাই হাসে। সবার কাছে জোকার নামে পরিচিত ছিলাম। একবার বন্ধুদের আড্ডা থেকে চলে যাবার সময় বললাম আজ আমার পেটে অনেক ব্যাথা করছে। সব বন্ধুরা হাসা শুরু করলো। আরে আমি পেট ব্যাথায় মরতেছি ওরা হাসে। মনে করে ফান করি।
আমি আর হাসতে পারলাম না।
কথায় কথায় জানলাম, উনি একজন কোটিপতি। হেন আছে তেন আছে। কিন্তু বলতে চায় না নিজের ব্যাপারে। খোচাখুচির পর জানলাম এগুলা।
তো জিজ্ঞেস করলাম,”আপনি কোটিপতি মানুষ টং দোকানে আসলেন কেন? ইচ্ছে করলেই যে কোন রেস্টুরেন্টে দামী দামী খাবার খেতে পারেন।
উত্তরে বললো,”নারে ভাই দামী খাবার ভাল্লাগেনা। ইচ্ছা করে না। এক সময় ছাত্র ছিলাম। এভাবে টং দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে এই গরুর মুতের মত চা খাইতাম। টাকা কম থাকতো। হিসাব করে চলতাম। দামী রেস্টুরেন্টের দিকে তাকাই থাকতাম। কোনোদিন ও ঢুকার সাহস করি নাই। বন্ধুবান্ধব খাইতো গল্প করতো আমিও শুনতাম। অনেক বাধা পেড়িয়ে আজ কত টাকা কামাইছি কিন্তু সেই খাওন আইজ ও খাই নাইরে ভাই। শখ মরে গেছে। টং দোকান ভুলতে পারি নাই।
কথায় কথায় আমার কথা জানতে চাইলো। ফেইল করার কথা বললাম।
শুনে এবার উনি হাসতে লাগলো।
বললাম হাসেন কেন ভাই?
সে বললো ভাইরে আপনি তো পুরা আমার ডুপ্লিকেট। আমি ক্লাস নাইনে ছিলাম দুইবার। টেনে একবারই। ইন্টার তো সেকেন্ড ইয়ারেই আটকাই গেলাম। অথচ আজ দেখেন আমি কত কিছু করলাম। ব্যাংকে গেলে সেইসব উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা দাড়ায়া সালাম দেয় আমারে। শুধু যে টাকার জন্য তা কিন্তু না। তারা আমাকে শ্রদ্ধা করে আমার ব্যাবসায়িক জ্ঞানের জন্য।
জীবনে উন্নতি করতে চাইলে ৩৩ পাইতে হয় নারে ভাই। অন্য হাজারো উপায় আছে পাশ করার। মনে রাখবেন “এক্সামে ৩৩ এর নীচে পেলে আপনি ফেইল কিন্তু বাস্তব জীবনে পাশ করার অনেক রাস্তা আছে”।
কথা শুনে আমি অবাক, কীরে ভাই বললো কি এগুলা।
সে এরপর বললো,”যাইরে ভাই রুমে যাই। আপনার ভাবী বিরানী রান্না করছে। গিয়ে খাবো। এই নেন আমার কার্ড। আমি আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিবো আপনি সে রাস্তায় নিজেই হাটবেন।
ওই মামা বিল কত হইছে। পাচ ট্যাকা। এই চায়ের লাইগা পাচ টাকা। হুর পুরাই লস।। লও।
এই বইলা গাড়ীটা টান দিয়ে চলে গেলো অবাক করা লোকটি।
কার্ডের দিকে চোখ বুলালাম।
তাতে লেখা,
আজিজুল হাসান
আত্ববিশ্বাসে ১০০ তে ১১০ ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৬