লেখক মহিউদ্দিন আহমদ কে চিনি তাঁর লেখা 'জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি' বইটির মাধ্যমে। বইটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয় সেসময় থেকেই বইটির পক্ষে বিপক্ষে প্রায়ই প্রথম আলো পত্রিকায় লেখক গবেষকগণ কলাম লিখতেন। জাসদের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আমারও জানার আগ্রহ ছিল খুব, যে কারণে পরবর্তীতে বইটি সংগ্রহ করেছিলাম। বইটাতে লেখকের সহজবোধ্য ও নির্মোহ বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই মুগ্ধতা থেকে পরবর্তী সময়ে এদেশের অন্যতম প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কে নিয়ে লেখা ওনার আরো তিনটি বই কেনা হয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস বেশিরভাগ সময়ই দলের নেতা, কর্মী কিংবা দল সমর্থক কেউ লিখেছেন। নির্মোহ ও নিরপেক্ষ ভাবে রাজনৈতিক দলের ইতিহাস খুব একটা লেখা হয়নি। যে কারণে দেখা যায়, লেখকরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ঘটনা প্রবাহ সাজিয়েছেন, আলোচনা করেছেন এবং সবশেষে নিজেই বিচারক হয়ে একটা রায় দিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ নিজের ধারণাপ্রসূত মন্তব্য পাঠককে গেলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নিরপেক্ষতার চাদর হারানো ইতিহাস খুব বেশিদিন টেকে না। চোখরাঙানি কিংবা আইন করেও সেই ইতিহাস টেকানো যায় না।
আওয়ামী লীগ নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদ দুটো বই লিখেছেন, তার একটি হল- 'আওয়ামী লীগ : উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০'। ভূমিকা, উপসংহার ও পরিশিষ্টবাদে মোট ১৪ টি অধ্যায়ে লেখক আওয়ামী লীগের নানা ঘটনা প্রবাহ পাঠকের সামনের তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তুলে ধরেছেন পর্দার পেছনের বিষয় ও এমন সব খুঁটিনাটি বিষয় ও তথ্য যা অনেকটা সাগর সেঁচে মুক্তা আহরণের মতই কঠিন। কারণ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের অন্যতম পুরনো একটি দল, এই দলের তথ্যের ঝাঁপিটিও অনেক বড়। এই তথ্যগুলো আবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জায়গায়।
আলোচ্য বইয়ে নানা ঘটনা, চরিত্র ও পটভূমিকে তিনি একসূত্রে গেঁথে আওয়ামী লীগের চরিত্র রূপায়ণের চেষ্টা করেছেন। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এটি কি আওয়ামী লীগের ইতিহাস, না ইতিহাসের গল্প? দলের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, না পরম্পরা? দুটোই হতে পারে। মহিউদ্দিন আহমদ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘আমার কাজ অনেকটা রাঁধুনির মতো। বিভিন্ন সূত্র থেকে চাল ডাল তেল মসলা জোগাড় করে তবেই তো রান্না। এ জন্য আমাকে খোঁজখবর করতে হয়েছে।’
আলোচ্য বইয়ের শুরু হয়েছে '৪৭ এর দেশভাগ এবং শেষ হয়েছে '৭০ এর নির্বাচনের মাধ্যমে। দেশভাগের সময়ে বাঙ্গালীদেরকে কংগ্রেস এবং মুসলিমলীগ নেতারা কিভাবে যৌথভাবে বঞ্চিত ও প্রতারিত করেছেন তা চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। দেশভাগের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, তেল-জলের সম্পর্ক, সর্বোপরি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃত্বের পারস্পরিক সন্দেহ-বিশ্বাসকে সামনে নিয়ে এসেছেন। লাহোর প্রস্তাবে একটি রাষ্ট্র বা একাধিক রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল, সেই বিতর্ক তখন বড় ছিল না; তখন ভারতের অধিকাংশ মুসলমান পৃথক আবাসভূমির স্বপ্নে বিভোর ছিল। সে স্বপ্নভঙ্গ হতেও বেশি সময় লাগেনি। যে কারণে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হওয়া পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ নামে উপমহাদেশে তৃতীয় রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল।
আলোচনা হয়েছে ছাত্রলীগের জন্ম ইতিহাস নিয়ে। ছাত্রলীগের নানা গৌরবময় কর্মকান্ড নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইউব খানের সামরিক শাসন, ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তের গনঅভ্যু্ত্থান, সত্তরের নির্বাচনের ইতিহাস নিয়ে সাবলীল আলোচনা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নিয়ে কথা বলতে গেলেই যার নামটি অবধারিতভাবে উঠে আসে তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহিউদ্দিন স্বীকার করেছেন, ‘আওয়ামী লীগের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে চলে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। একজন ব্যক্তি একটা রাজনৈতিক দল ও একটা দেশ যখন এক হয়ে মিশে যায় তখন তাদের আলাদা করে দেখা বা বোঝা কঠিন একটা কাজ।’ পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ নেতা। তারুণ্যের সঙ্গে তিনি সাহস ও জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে মেলাতে পেরেছিলেন বলেই রাজনীতির গতিধারা ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। বয়সে যাঁরা তাঁর চেয়ে তরুণ, তাঁদের ভরসাস্থল হয়েছিলেন শেখ মুজিব। ষাটের দশকের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটিও ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা যাবে না বলে অভিমত দিলে কমিউনিস্ট নেতারা বললেন, ‘এখনো সময় আসেনি, জনগণকে প্রস্তুত করেই চূড়ান্ত সংগ্রামে নামতে হবে।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনাদের কথা মেনে নিলাম, কিন্তু স্বাধীনতাই আমার শেষ কথা।’
এখনও অনেকে মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করেন সশস্ত্র লড়াই এর মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার জন্য আওয়ামীলীগ কিংবা শেখ মুজিবের কোন প্রস্তুতি ছিলনা। পাকিস্তানীদের আক্রমণের কারণে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠে এই শ্রেণির লোকদের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হয়। ১৯৬২ সনে শেখ মুজিবের ত্রিপুরা মিশনটি লেখক এখানে সুস্পষ্টভাবে তুলে এনেছেন। এর মধ্যে দিয়ে দেখা যায় শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীকার আদায়ের পথটিও খোলা রেখেছিলেন। ত্রিপুরা মিশনে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রেজা আলীকে ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দলের বাইরেও সবসময় শেখ মুজিবের যে একটি নিজস্ব নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিলো তা আলোচ্য গ্রন্থে প্রমাণিত হয়েছে। একই সাথে ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের গড়া 'নিউক্লিয়াস' এর প্রসঙ্গটি আনলে আরো ভালো হতো। নিউক্লিয়াস নিয়ে তিনি অবশ্য বিশদ আলোচনা করেছেন তাঁর লেখা 'জাসদের উত্থান পতন' বইয়ে।
জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামীলীগে অভ্যন্তরে পরস্পরবিরোধী ধারার অবস্থান এবং তাদের মধ্যে মত বিরোধের কারণে বারবার দলের অভ্যন্তরে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম থেকেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ, পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ৫৭ সালে দলের ভাঙ্গন, প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে ভাসানী কর্তৃক হেনস্তা করা, সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামীলীগ পুনুরুজ্জীবন করার সময় দলের সিনিয়র নেতাদের ভূমিকা, এনডিএফ থেকে বেরিয়ে আওয়ামীলীগকে রাজনীতিতে সক্রিয় করার সময় আতাউর রহমান খান আবুল মনসুর আহমেদের মত নেতাদের তীব্র বিরোধিতা, ছয় দফার বিরুদ্ধে দলের নেতাদের একাংশের অবস্থান এবং মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সালাম খানদের নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামীলীগ গঠনের মত বিষয়গুলো লেখক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে।
'আওয়ামী' শব্দটি যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দেওয়া, তা আগে জানা ছিল না। একই সাথে '৭০ পর্যন্ত ভাষানীর নানা ভূমিকা সংক্ষেপে উঠে এসেছে এখানে।
অবাক হয়েছি শেরে বাংলা ফজলুল হক সম্পর্কে পড়তে গিয়েছে। এ.কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবনের সুবিধাবাদী অবস্থান, ঘনঘন রাজনৈতিক মত ও পথ পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচ্য গ্রন্থে পাঠকের সামনে পরিষ্কার ভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন রোজগার্ডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের উদ্বোধনী অধিবেশনে শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক কিছু সময়ের জন্য যোগদেন এবং বক্তব্য প্রদান করেন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন “ফজলুল হক কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি একটা বক্তব্য দেন। কয়েক মিনিট পরেই তিনি সম্মেলনস্থল ছেড়ে চলে যান। হয়তো তাহার ভয় ছিল পাছেনা সরকারের এডভোকেট জেনারেলের পদ হারাইতে হয়”। শুধু তাই নয় আওয়ামীলীগে সাংগঠনিক কমিটির প্রথম সভা হয় ১৫০ মোগলটুলীতে। ফজলুল হক এই সভাতেও যোগদান করেছিলেন। ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এতে অন্যান্যের মাঝে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং একে ফজলুল হকের নাম ও ছিল। কিন্তু পরদিন ফজলুল হক তার বিবৃতি অস্বীকার করেন। তবে পাকিস্তান কায়েমের পরপর ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে এ.কে ফজলুল হকের যে কথোপকথন লেখক পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন তাতে ফজলুল হকের সাহসের প্রশংসা করতেই হয় এবং বলতেই হবে তিনি সত্যিকার ভাবেই শেরে বাংলা।
নানা প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার কথা। মানিক মিয়ার ঢাকা আগমন এবং ইত্তেফাক প্রকাশের পটভূমিটি এখানে লেখক চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রীর কিছু আক্ষেপের কথাও তুলে ধরেছেন লেখক।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭০। প্রায় পুরো সময়টি আওয়ামী লীগকে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে, মাঝখানে ১৩ মাসের কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হওয়া ছাড়া। শাসকদল হিসেবে আওয়ামী লীগ সফল বা ব্যর্থ সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু মাঠের আন্দোলনে এখনো পর্যন্ত দলটি অদ্বিতীয়। অন্যান্য দল ও নেতারা যখন বারবার মত ও পথ পরিবর্তন করেছেন, শেখ মুজিব লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থেকেছেন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, 'পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজনীতিতে বাঙালির চাওয়া-পাওয়া আবর্তিত হয়েছে প্রধানত গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে। একই দাবি অন্য দলগুলোরও ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যত স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছে, অন্যরা তা পারেনি।' একারণেই হয়তো ন্যাপে বাঘা বাঘা সব নেতার উপস্থিতিও জনগণের মন জয় করতে পারেনি।
রাজনীতি সচেতন পাঠক অথবা স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝতে ও জানতে আগ্রহী হলে পড়তে পারেন মহিউদ্দিন আহমদ এর এই বইটি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:২০