পড়ছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মহীউদ্দীন আহমেদ অনূদিত ও আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত এডগার অ্যালান পো'র 'শ্রেষ্ঠ গল্প' বইটি। মোট সাতটি গল্প নিয়ে মাত্র আশি পৃষ্ঠার ছোট পরিসরের একটা বই।
বিশ্ব সাহিত্যে বেশ কয়েকটি কারণে এডগার অ্যালান পো স্মরণীয় হয়ে আছেন। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বা সাই-ফাই এবং গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা বলা হয় তাকে। এছাড়াও একজন কবি, ছোটগল্প লেখক, সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচক হিসেবে তাকে মার্কিন সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ প্রতিভা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৮০৯এ বস্টনে তাঁর জন্ম। এক বছর বয়েসে বাবা পরিবারকে পরিত্যাগ করেন, মা মারা যান দু’বছর বয়েসে। জন অ্যালান নামে ধনাঢ্য এক ভদ্রলোকের পরিবারে পালকপুত্র হিসাবে বড় হন, তাঁর নামে অ্যালান শব্দটি এখান থেকেই যুক্ত।
মাত্র চল্লিশ বছরের স্বল্প পরিসরের জীবন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি, যার পুরোটাই ছিল দারিদ্র, শোক, দুঃখ, বঞ্চনা আর ব্যর্থ প্রেমের বেদনায় পরিকীর্ণ। যার প্রচ্ছন্ন প্রভাব তার সৃষ্ট কর্মেও কিছুটা লক্ষ্য করা যায়।
তাঁর মৃত্যু নিয়েও রয়েছে কিছুটা রহস্য। কিছু অদ্ভূত কাহিনিরও জন্ম দেয় তাঁর মৃত্যু। অ্যালান পো'র একটি প্রিয় পোষা বিড়াল ছিল, যেটিকে তিনি প্রায় সময়ই তার কাঁধের উপর রেখে লিখতেন। তাঁর মৃত্যুর পর যখন তাঁর শাশুড়িকে মৃত্যু সংবাদটি দেওয়া হয় তখন তিনি বিড়ালটিকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান। পো'কে নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে ব্যপারটি হলো মৃত্যুও তাঁর লেখালেখি থামাতে পারেনি! ১৮৬০ সালে লিজ্জি ডোটেন নামের একজন মহিলা কবি বেশ কিছু কবিতা প্রকাশ করেন এবং তিনি দাবি করেন পোর প্রেতাত্মা তাকে কবিতাগুলো বলে গিয়েছেন। এ কথা শোনার পর পো'র বাগদত্তা সারাহ ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর সাথে থাকতে চলে যান এই ভেবে যে, হয়ত সেই প্রেতাত্মা তাঁর সাথেও যোগাযোগ করবে!
বইয়ের কথায় ফিরে আসি! যে সাতটি গল্প এই বইয়ে স্থান পেয়েছে সেগুলো হল- 'ভ্যালডিমারের মৃত্যু', 'লাল মড়ক', 'আশার বংশের পতন', 'কালো বিড়াল', 'শব্দ', 'মোরেলা' ও 'চোরাই চিঠি'।
অ্যালার পো'র সাহিত্য কর্মে রোমান্টিসিজমের অতিপ্রাকৃত ও অশুভত্বের যে সংমিশ্রণ দেখা যায় তা থেকে এ গল্পগুলোও ব্যতিক্রম নয়। তাঁর শিল্পের উপজীব্য হিসেবে কাজ করেছে তাঁর একান্ত নিজস্ব উত্তেজনাকর স্বপ্ন, বিরল দৃশ্য ও অতীন্দ্রিয় এক জগৎ। নাট্যসৃজনপ্রবণতা তাঁর ছোটগল্পে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য দান করেছিল। অ্যালান পো'র গল্পগুলো বিভীষিকাময়, উদ্ভট, ভৌতিক কিংবা রহস্যে ঘেরা। যে কারণে অনেকে অ্যালান পো'র নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে খুন, রহস্যময় কোনো কাক, জীবন্ত কবর এবং মৃত্যুর পর ফিরে আসা অদ্ভুত কোনো মহিলার ছবি। তবে যতই অদ্ভূত কিংবা উদ্ভট (এবং অনেকের মতে তাঁর লেখনী দুর্বোধ্য) হোক না কেন, তাঁর প্রতিটি গল্পেই মানুষের মনস্তাত্ত্বিক এবং নৈতিক বাস্তবতার তীব্র প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। চিন্তার জগতে আলোড়নের উদ্রেক করে তাঁর গল্পগুলো। মননশীলতার উপর গভীর দাগ কাঁটতে সক্ষম তাঁর এই গল্পগুলো।
এই গল্পগুলোর একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তারঁ গল্পগুলোতে তিনি মানুষের সবচে’ নীচ স্বভাবের মনোবৃত্তিগুলি তুলে ধরেছেন খুবই সাবলীলভাবে, কোনটা শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন নিয়ে, আবার কোনটা তার সাথে ডার্ক হিউমার মিলিয়ে একটু কৌতুকপ্রদ। সবগুলিই ফিরে ফিরে মৃত্যু বিষয়টাকে টেনে নিয়ে এসেছে। আর প্রতিটা ভিলেইনই মানবিক - তাদের প্রতি যতটা না ঘৃণা জাগে, তার থেকে বেশি হয় করুণা।
'ভ্যালডিমারের মৃত্যু' গল্পে দেখতে পাই- জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা একজন মানুষকে সম্মোহন করা ও তাঁর প্রভাব। মৃতপ্রায় একজন মানুষকে সম্মোহনের প্রভাবে কতদিন পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? কিংবা আদৌ সম্ভব কিনা। সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এ গল্পে।
দ্বিতীয় গল্পটির নাম 'লাল মড়ক'। মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্লেগের সময় যখন রাজ্যের প্রজারা রোগাক্রান্ত, মৃত্যুপথযাত্রী, প্রিয়জনের বিয়োগবেদনায় শোকাতুর। তখন প্রিন্স প্রস্পেরো নামে এক রাজকুমার তাঁর বন্ধুবান্ধব, পরিবার, আর সমশ্রেণীর অভিজাতদের নিয়ে বহু বছরের রসদসমেত চলে গেলেন দূরের এক দুর্গে। যেন এই রোগ তাদের আক্রান্ত না করতে পারে। বিরাট উচু ও মজবুত একটা দেয়াল দুর্গটিকে ঘিরে রেখেছে। দেয়ালের মধ্যে বিরাট সব লোহার দরজা। সে দুর্গে অতন্দ্র প্রহরা, কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানে প্লেগের জীবাণু নিয়ে ঢোকে। বহির্বিশ্বের মৃত্যুর বাস্তবতাকে ভুলতে আর দৈনন্দিন জীবনের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্যে প্রস্পেরো একটা পার্টি দিলেন।
কিন্তু সে পার্টিতে অদ্ভূত ভাবে এক নবাগতের আগমন ঘটলো। সে আসলো কাফনের মত লাল কাপড়ে আপাদমস্তক আবৃত হয়ে, মুখে মৃতের মুখোশ। দৌড়াতে লাগলেন রাজককুমার কে। এ ঘর থেকে ও ঘরে। শেষে রাজকুমার কে ছোঁয়া মাত্র ভয়ে-বিভীষিকায় সাদা হয়ে প্রস্পেরোর আত্মা দেহত্যাগ করলো! প্রস্পেরোকে রক্ষা করতে তাঁর পারিষদবর্গ ছুটে এলেন, আক্রমণ করলেন রক্তিম আগন্তুককে। তার আলখেল্লা ধরে টান দিতেই তাঁরা দেখলেন প্রহেলিকা- পোশাকের নিচে নেই কেউ! তারপর একে একে সকলে রক্তিম ত্বক নিয়ে প্লেগের আক্রমণে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। দুর্গের প্রাচীরের ভেতরে চলল লাল মৃত্যুর রাজত্ব! এ গল্পের সেই আগন্তুক যেন অসহায় প্রজাদের প্রতিরূপ হয়ে এসেছে। আর জানান দিয়েছে মৃত্যুর উর্ধ্বে কেউ নয়। মৃত্যুর করাল গ্রাস কাউকে ছাড়ে না।
'আশার বংশের পতন' গল্পটি রোডেরিক ও ম্যাডেলিন আশার নাম দুই যমজ ভাই-বোনের গল্প। বোন ম্যাডেলিন অসুস্থতার চরম অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়বার পর ভাই রোডেরিক তাকে মৃত ভেবে অন্ধকার এক কুঠুরিতে রেখে আসেন। মানুষের জীবসত্তা ও বুদ্ধিসত্তার দ্রবণই হচ্ছে মানবজীবন- এ কথায় লেখক বলতে চেয়েছেন এখানে।
পরের 'কালো বিড়াল' ও 'শব্দ' নামক দুটি গল্পে আমরা দু'জন খুনিকে দেখতে পাই। যারা প্রথমে খুন করেও পরে তা স্বীকার করেছে এবং অনুশোচনায় ভুগেছে। মৃত আত্মা তাদের স্বস্তিতে থাকতে দেয় নি। ক্রোধ মানুষের জীবনটাকে কীভাবে তছনছ করে দিতে পারে তারই প্রতিচ্ছবি যেন 'কালো বিড়াল' গল্পটি।
'শব্দ' গল্পটি ঠান্ডা মাথায় এক বৃদ্ধকে খুন করে তার দেহাবশেষকে টুকরো টুকরো করে বাড়ির মেঝের নিচে গুম করে ফেলার কাহিনী- যার শেষ খুনীর পাপবোধের ফলস্বরূপ তার মনস্তত্ত্বে মেঝের ফ্লোরবোর্ডের নিচ থেকে আসা বুড়োর চলমান হৃদপিন্ডের ধকধক আওয়াজ। আর কেউ শুনতে না পেলেও সে আওয়াজ তাকে পাগল করে ফেলে। আর যার পরিণতিতে অবশেষে পুলিশের সামনে সে মেঝে খুঁড়ে বের করে ফেলে নিজের কীর্তিকলাপের প্রমাণ!
'মোরেলা' গল্পের সারসংক্ষেপ এর বদলে একটু অংশ তুলে দিচ্ছি-
"হ্যাঁ আমি মরে যাচ্ছি। আমার ভেতরে রয়েছে সেই স্নেহবীজ- সেই ছোট্ট মোরেলাকে রেখে যাচ্ছি, তুমি তাকে ভালোবাসো। যখন আমার প্রাণ চলে যাবে তখন সে শিশু বাঁচবে- সে হবে তোমার এবং মোরেলার সন্তান। কিন্তু সেই দিন হবে দুঃখের দিন, যেমন সাইপ্রাস দীর্ঘদিন ধরে বাঁচে, তেমনি এ দুঃখ হবে দীর্ঘস্থায়ী। কেননা তোমার সুখের দিন বিগত প্রায়। গোলাপ হয়ত বছরে দু'বার ফোটে কিন্তু জীবনে সুখের দিন দু'বার আসেনা।"
কথাগুলো অদ্ভূত, সুন্দর। না?
শেষ গল্প হচ্ছে 'চোরাই চিঠি'। এই গল্পে অন্যান্য গল্পের মত মৃত্যু নেই। বিভীষিকা নেই। নেই অতিপ্রাকৃত কোন ঘটনা। বরং গোয়েন্দা গল্প এটি। রাজপ্রাসাদ এর এক সম্মানিত মহিলার একটি চিঠি খোয়া যায়, যা প্রকাশ পেলে সেই মহিলার সম্মান হানি ঘটবে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- চিঠিটি চুরি হয়েছে সেই মহিলাটির সামনে। এবং তিনি চোরকে চিনেন। তাঁর কিছু করার ছিল না এমন এক পরিস্থিতিতে চুরি হয় এটি। এবং চিঠিটি চুরি করেছে এক মন্ত্রী। অবশেষে সে চিঠি উদ্ধাদের দায়িত্ব এসে পড়ে প্যারির পুলিশের উপর। তবে তা অবশ্যই অতি গোপনীয়তার সাথে উদ্ধার করতে হবে। উদ্ধার করতে পারলে রয়েছে মোটা অংকের পুরস্কার।
যারা রোমহর্ষক ছোটগল্প পড়তে পছন্দ করেন, তাঁরা নিশ্চিন্তে পড়তে পারেন বইটি। অনুবাদ বেশ সাবলীল ছিল। অবশ্য 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র' ও 'সেবা'র অনুবাদের মান নিয়েও তেমন প্রশ্ন নেই। ধ্রুব এষ এর প্রচ্ছদে বইটির মুদ্রিত মূল্য একশত টাকা মাত্র।
হ্যাপি রিডিং!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১২