কভার উল্টোলেই চোখে পড়বে কত অজানারে শব্দের উপর দাগ টেনে লেখা 'বাংলার কালজয়ী ক্লাসিক'।
এরপর কি আর এ বইয়ের রিভিউয়ের প্রয়োজন আছে? আমি মনে করি নেই। সাহিত্যে একটা বই ক্লাসিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য অনেকগুলো মানদন্ড পার হতে হয়। নিঃসন্দেহে সেই বইগুলো অবশ্যই সুখপাঠ্য।
'কত অজানারে' তেমনি একটি জীবন ঘনিষ্ঠ চিরায়ত উপন্যাস। কলকাতার ওল্ড পোস্ট অফিস রোডের আদালত পাড়ায় ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনা আর সেসব ঘটনার সাথে জড়িত মানুষগুলোর আখ্যান হচ্ছে এই বই।
বইটির লেখক শংকর, লেখক-পাঠক মহলে এই নামেই তিনি পরিচিত। যদিও তার আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। এই নাম থেকে শংকর নাম ধারণ করার কারণ কী?
সেই ঘটনাটা বলছি একটু পর। তার আগে লেখক সম্পর্কে আর কিছু তথ্য জেনে নিই আমরা।
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই লেখক। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনো ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনো প্রাইভেট টিউশনি, কখনো শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায় শুরু করেন লেখালেখি।
চৌরঙ্গী, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কথামন্থনসহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা পশ্চিমবঙ্গের এই লেখক। 'চৌরঙ্গী'কে বলা হয় লেখকের সিগনেচার বুক।
'চৌরঙ্গী' হচ্ছে 'কত অজানারে' বইয়ের সিকুয়্যাল। অনেকেই হয়তো জানি না, এটা একটা ট্রিলজি। এবং এই ট্রিলজির শেষ বই হচ্ছে 'ঘরের মধ্যে ঘর'।
কত অজানারে রচনার শুরু আগষ্ট ১৯৫৩। লেখকের বয়স তখন মাত্র উনিশ। এরপরের বছর 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ। এবং এরপরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে সামান্য কয়েকটি বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ও পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক মহিমা অর্জন করেছে 'কত অজানারে' তাদের একটি। এবং বস্তুতপক্ষে বিংশশতকে এত অল্প বয়সে কোনো লেখক বাংলা গদ্যসাহিত্যে এমন বিপুল স্বীকৃতি ও সাফল্য লাভে সমর্থ হন নি। শুধু বাংলা নয়, বিশ্বসাহিত্যে এমন বই যে বেশি রচিত হয়নি তা এখন স্বীকৃতির অপেক্ষা রাখে না।
বইটি উত্তম পুরুষে লেখা। গল্প কথক লেখক নিজেই। যাকে নিয়ে কাহিনী আবর্তিত হয়েছে, বলা যায় প্রধান চরিত্র হচ্ছেন যিনি তার নাম- নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল। কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। বিখ্যাত বারওয়েল বংশের আলোকবর্তিকা। এই বংশ ক্লাইভের আমল থেকেই ভারতবর্ষে ছিল, নানা ভাবে নানা পেশায় নানা সময়ে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর মিলিটারি ডিউটিতে তিনি কলকাতায় আসেন এবং পরবর্তীতে অনেকের পরামর্শে আইন পেশায় প্রবেশ করেন।
লেখক মণিশংকর মুখোপাধ্যায় এর নাম সংক্ষেপ হয়ে শুধু 'শংকর' হয়েছিল এই ইংরেজ ব্যারিস্টার সাহেবের কারণেই। লেখকের সাথে যেদিন প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেদিন এই ব্যারিস্টার সাহেব বলেছিলেন এত বড় নামে তিনি ডাকতে পারবেন না, বরং সংক্ষেপে শংকর বলে ডাকবেন। সেই থেকে লেখক এই সংক্ষিপ্ত নামটাই নিজের মাঝে ধারণ করে নেন। পরবর্তীতে সাহিত্য রচনায় তিনি এই নামেই লিখতেন।
আমাদের অতিপ্রিয় লেখক শংকর ছিলেন প্রথম জীবনে নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল সাহেবের সহকারী। আইনজীবি হিসেবে নয়, বরং চেম্বার ক্লার্ক বা অফিস এসিস্ট্যান্ট হিসেবে। আদালত পাড়ায় যারা কিনা 'সায়েবের বাবু' নামে পরিচিত। যাদের মূলত কাজ হচ্ছে কেস লিপিবদ্ধ করা, লাইব্ররী থেকে বই আনা, রেফারেন্স বের করা, শিডিউল তৈরি করা, মক্কেলের সাক্ষাতকার গ্রহণের সময় প্রয়োজনীয় তথ্য নোট করা, মাঝে মাঝে দোভাষীর কাজ করা প্রভৃতি।
কিন্তু এখানে বারওয়েল সাহেব তার সাথে বন্ধুর মতই মিশতেন। 'নাক উঁচু' জাতি হিসেবে ইংরেজদের যে বদনাম রয়েছে, বারওয়েল সাহেব সে বদনাম থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। ওল্ড পোস্ট অফিস রোডের পুরনো টেম্পল চেম্বারের কক্ষে বসে বারওয়েল সাহেব কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুলে বসতেন তার বিশাল অভিজ্ঞতার ঝুলি, কখনো বা মক্কেলের নিজের মুখেই শংকর শুনে নিতেন মানবজীবনের জটিলতম সমস্যার সব দুঃখগাথা। সেসব ছোট ছোট গল্প নিয়েই এই অমর রচনা - 'কত অজানারে'।
বইয়ের ভূমিকাতে লেখক নিজেই অবশ্য বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সুন্দর একটা বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে লেখক বলছেন- "সংসার পরিক্রমার পথ কত বিচিত্র সঞ্চয়ই যে দিনে দিনে পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে তার আর বুঝি ইয়ত্তা নেই। যা একদিন অচেনা থাকে, অজানা থাকে তাকেই আবার একদিন চিনে ফেলি, জেনে ফেলি। অপরিচয়ের অবগুন্ঠন খুলে কখন সে-ই আবার ধরা দেয় মনের কাছে। এই এমনি করেই সঞ্চয়ের পুঁজি একদিন ভারী হয়ে ওঠে, আর স্মৃতির আকাশে রঙ ধরে তখনই।
ঘটনাচক্রে ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রিটের আদালতি কর্মক্ষেত্রে আমাকেও একদিন এমনি অসংখ্য অপরিচিত চরিত্রের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল। সেদিন অচেনাকে চেনা আর অজানাকে জানাই ছিল আমার জীবিকার অপরিহার্য অঙ্গ। তারপর এতদিন পরে হঠাৎ একদিন টের পেলাম কখন যেন আমার আকাশও বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে তাদের রঙে। কখন যেন নিজেরই অজ্ঞাতসারে তাদের আমি ভালোও বেসে ফেলেছি মনে মনে। জানি, আইনের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কটা বিশেষ মধুর নয়। অন্ততঃ সাহিত্যের কমলবনে আইনের কলরব ঠিক ভ্রমর গুঞ্জনের মত শোনায় না। কিন্ত এই গ্রন্থে আমি আইনকে দেখিনি। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটের যে মানুষদের একদিন ভালোবেসেছিলাম তাদেরই আজ অক্ষরে আবদ্ধ করবার চেষ্টা করেছি মাত্র, আর কিছু নয়!"
অর্থাৎ বইটির মূল উপাদান যদিও আদালত পাড়া হতে সংগৃহীত, তবুও এখানে তিনি আইন নিয়ে তেমন আলোচনা করেননি, বরং কতগুলো মানুষের জীবনের গল্পকে তুলে ধরেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। তবে কোর্ট ও এর সিস্টেম সম্পর্কেও বাস্তবধর্মী তথ্য রয়েছে এখানে। উৎসুক পাঠক তা থেকেও উপকৃত হবেন। এখানে আইনপাড়ার নানান পেশার মানুষদের জীবনযাত্রা ও জীবনবোধের পরিচয় পাই আমরা। দেখতে পাই নানা সফলতা- ব্যর্থতার গল্প। এছাড়া তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির একটা খন্ড চিত্রও এখানে দেখতে পাই আমরা।
বেশ অনেকগুলো চরিত্র আলোচিত হয়েছে এখানে। প্রতিটি চরিত্রই নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বতন্ত্র, আলোকিত। ছোকাদা, মেরিয়ন স্টুয়ার্ট, ব্যারিস্টার বীরেন বোস, ব্যারিস্টার সুব্রত রায়, ব্যারিস্টার স্যার হেনরি, ইংরেজ কন্যা হেলেন গ্রুবার্ট, সুরজিত রায়, সুনন্দা দেবী, আরতি রায়, গ্রীক নাবিক নিকোলাস ড্রলাস, বিপ্লবী রবীন্দ্র কলিতা সহ অসংখ্য চরিত্র রয়েছে যেগুলো বিশ্লেষণের খুব বেশি প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি না। প্রতিটি চরিত্রই নানা দিক দিয়ে আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। শংকরের কলমের জাদুতে প্রত্যেকটি চরিত্র ও তাদের ঘটনা জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠেছে। পাঠক বইটি পড়লেই তা বুঝতে পারবে।
সবমিলিয়ে এককথায় যদি বলতে যাই, তাহলে বলবো দুইশ' ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার এক জীবনঘনিষ্ঠ অসাধারণ আখ্যান 'কত অজানারে'। এর প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে আইনসিদ্ধ জীবনদর্শন।
বাংলাসাহিত্যের এই কালজয়ী ক্লাসিকটি পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আপনাকে। হ্যাপি রিডিং।
~
বইয়ের নাম : কত অজানারে
লেখক : শংকর
ধরণ : চিরায়ত উপন্যাস
প্রকাশনী : নিউ এজ পাবলিকেশন্স
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২৫৬
মূল্য : ৩৬০ টাকা (রকমারি ; অরিজিনাল প্রিন্ট) এবং লোকাল প্রিন্ট পাবেন ১২০ টাকায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৮