বাঙালি মুসলমান সমাজে সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত করা হয় মীর মশাররফ হোসেন রচিত 'বিষাদ সিন্ধু' উপন্যাসটিকে। বলতে পারেন এরপর সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস বলা হয় কোনটিকে?
সেই দ্বিতীয় জনপ্রিয় ও সর্বাধিক পঠিক উপন্যাসটির নাম বলার পূর্বে এটি সম্পর্কে কয়েকটা চমকপ্রদ তথ্য যোগ করতে যোগ করতে চাই-
♣ ১৯৬৭ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক জহির রায়হান এ উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ১৯৮৭ সালে এ উপন্যাসের ধারাবাহিক নাট্যরূপ সম্প্রচার করে।
♣ ২০১৪ সালে উপন্যাসটির শতবর্ষ পূর্তি পালন করা হয়।
♣ উপন্যাসটি একসময় পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল। বর্তমানেও আছে কিনা তা বাংলা সাহিত্যের ছাত্ররা বলতে পারবে।
♣ কলকাতা ও ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত এ উপন্যাসের ৬০টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
♣ ইংরেজি ১৯৬১ সালে এর সাতাশতম সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং ঐ সময় পর্যন্ত এর সাড়ে পাঁচ লক্ষ কপি বিক্রয় হয় বলে জানা যায়।
♣ উপন্যাসটি বাংলাসাহিত্যে ক্লাসিক মর্যাদা পেয়েছে।
♣ উপন্যাসটির পরিশিষ্ট বা সিকুয়্যাল হিসাবে 'প্রেমের সমাধি' নামে আরেকটি বই প্রকাশিত হয় যেটি এবং এটিও পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
যাক, এবার মূল কথায় আসি। বলছিলাম, বাঙ্গালী ঔপন্যাসিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন রচিত 'আনোয়ারা' উপন্যাসটির কথা। এটি তার রচিত প্রথম ও সর্বাধিক সার্থক উপন্যাস। এটি ১৯১৪ সালের ১৫ জুলাই কলকাতা থেকে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় এ উপন্যাসটি প্রকাশের পেছনেও কাহিনিটাও করুণ। নজিবর রহমান উপন্যাসটি ঠিকই লিখলেন। কিন্তু অর্থাভাবে তখন ছাপাতে পারছেন না। তখন রাজশাহী কলেজ ও রাজশাহী জুনিয়র মাদ্রাসার ছাত্ররা মিলে বইটি মুদ্রনের জন্য লেখককে তিনশত টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। এবং লেখক তামাকের ব্যবসায় ভাগ্যক্রমে সাতশত টাকা লাভ করেন। তারপর সর্বমোট এক হাজার টাকা মখদুমী লাইব্ররির স্বত্বাধিকারী খান বাহাদুর মোবারক আলীকে প্রদান করেন। আর এভাবেই বাংলাসাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয়, জীবনবোধ সম্পন্ন এবং সামাজিক ও পারিবারিক চিত্র সম্বলিত 'আনোয়ারা' উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
‘আনোয়ারা’ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলেছেন- "জনপ্রিয়তা দিয়ে যদি কোন বইয়ের বিচার করতে হয়, তাহলে মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত ‘আনোয়ারা’র দাবিই সর্বাগ্রে বিবেচ্য।"
'আনোয়ারা' একটি স্নিগ্ধ সরল এবং জীবনমুখী উপন্যাস। এর কাহিনির মধ্যে কোথাও গোঁজামিল নেই, জটিল আবর্ত নেই, সূক্ষ্ম কারুকাজের ছলনাও নেই। যেন বহতা নদীর স্রোতের মত অবলীলায় চলেছে এ উপন্যাস। তবে এটি কেবল সরল শোভন রচনার জন্যই পাঠকপ্রিয়তা পায় নি, বরং এ উপন্যাসের শরীর ও হৃদয়ের মধ্যে যে চিরন্তন ও শাশ্বত সাধুতা যুক্ত হয়ে আছে তার জন্যও এটি পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
উপন্যাসের প্রধানতম চরিত্র হচ্ছে আনোয়ারা। যার শৈশবকাল থেকে যৌবনোত্তরকাল পর্যন্ত এ উপন্যাসের পরিধি। আনোয়ারা মাত্র বারো বছর বয়সে মা হারিয়ে বিমাতার ঘরে লালিত হয়েছে। বিমাতার নির্যাতনে প্রতিনিয়ত দেহ-মন রক্তাক্ত হয়েছে। তবে এতকিছুর পরও স্নেহশীলা দাদীমার ভরসার হাত রক্ষা করেছে তাঁকে।
বিবাহিত জীবনেও ভাগ্য বারবার আঘাত হেনেছে আনোয়ারা'র উপর। নিজের সংগে নিজেকে সর্বক্ষণ যুদ্ধ করতে হয়েছে। যেখানে তার একমাত্র অবলম্বন ছিল পরম করুনাময়ের করুণা। সরল বিশ্বাসে আনোয়ারা সৃষ্টিকর্তার কাছে অবনত হয়েছে, আর সেই নিবেদনের মধ্যেই অশেষ করুণার আলো দেখতে পেয়েছে।
উপন্যাসটিতে আনোয়ারা ছাড়াও আরো প্রায় অর্ধশত চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। এবং প্রত্যেকটি চরিত্র এসেছে নিজ নিজ অধিকার ও প্রয়োজনানুসারে। কেউ জোর করে এসে জায়গা দখল করেনি। যেন সহজ স্রোতের মত অবারিত হয়ে ওঠেছে প্রতিটি চরিত্র। ভাদ্র মাসের ভোরবেলায় মধুপুর গ্রামে ওজুরত চতুর্দশবর্ষীয়া আনোয়ারা কিংবা নৌকার ছই এর মধ্যে কুরআন পাঠরত নুরল এসলাম থেকে শুরু করে রাতিস বাবু, লোভী নবা, অতিচালাক ফরমান, বিমাতা গোলাপজান, সখী হামিদা সহ প্রতিটি চরিত্রই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে প্রতিভাত হয়েছে।
উপন্যাসটির আরো একটি বৈশিষ্ট্য হল- পারিবারিক জীবনের ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম বোধগুলোকে তুলে ধরা। এছাড়াও বাঙালি রমনীর পরিচয়কে বিশেষভাবে আলোকিত করা হয়েছে। বিশেষভাবে দৃষ্টিদান করা হয়েছে ধর্মের পবিত্র ও মাধুর্যময় দিকের প্রতি। প্রেম ভালোবাসা, সৌন্দর্য ও জীবনবোধের অনির্বচনীয় চিত্র পুরো উপন্যাসটিতে লেখক দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন।
পড়তে পারেন বাংলাসাহিত্যের জনপ্রিয় এই সুখপাঠ্যটি।
সবশেষে, একটা কথা বলতে চাই- ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হক সাহেব বলেছিলেন- "সব সত্য সুন্দর নয়।" তেমনি আমি মনে করি- বই আমাদের আলোকিত করে ঠিকই, কিন্তু সব বই নয়। তাই, বই পড়ুন এবং ভালো বই পড়ুন।
হ্যাপি রিডিং!
~
বই : আনোয়ারা
লেখক : নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন
প্রকাশন : বিশ্বসাহিত্য ভবন
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১০৪
মুদ্রিত মূল্য : ১৫০ টাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:০৮