শুরুতেই বইয়ের ভূমিকা থেকে জানলাম, এটি 'ডকুফিকশন' জনরার একটি বই। আধুনিক সাহিত্যে এটি 'হাইব্রিড' জনরা নামেও পরিচিত। অর্থাৎ এখানে ডকুমেন্টারি ও ফিকশন এর সম্মিলন ঘটে। বাংলা সাহিত্যে এ জনরার চর্চা খুব বেশি দেখা যায় না বললেই চলে। তবে মননশীল পাঠক মহলে সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত লেখক শাহাদুজ্জামান এর ডকুফিকশন ধারায় লেখা 'আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে' বইটি ইতোমধ্যেই বেশ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র সত্তর পৃষ্ঠার ছোট এই বইটি আপনাকে নিয়ে যাবে পৃথিবীর এক প্রান্তের এক ছোট্ট দ্বীপদেশ কিউবায়, পরিচয় করিয়ে দিবে ইতিহাসের এক মহান বিপ্লবী নায়কের সাথে।
বইয়ের শুরুতেই লেখক সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী এক বাংলাদেশী যুবকের কথা কল্পনা করেছেন। যে যুবক ক্যাস্ট্রোর ভাবনায় বিভোর হয়ে নিজেকে একদিন আবিস্কার করে ক্যাস্ট্রোর পড়ার ঘর। এরপর ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে সে যুবকের কথোপকথন এর মধ্য দিয়েই এগিয়েছে বইটি।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো ; বিপ্লবের জগতে এক অগ্নিসম অগ্রদূতের নাম। ১৯৫৯ সালে পশ্চিম গোলার্ধে কমিউনিজমের সূত্রপাত হয়েছিল যার হাত ধরে, ১১ জন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আমেরিকাকে কিউবা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন যে নেতা তিনিই ফিদেল কাস্ত্রো।
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পর তিনিই একমাত্র রাষ্ট্র নেতা যিনি এত লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপ রাষ্ট্রের প্রধানের যতটুকু বিখ্যাত হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতি ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেছিলেন তিনি।
সেই বাংলাদেশি যুবক ও ক্যাস্ট্রোর কথোপকথন এর মধ্য দিয়ে উঠে আসে এই জনবিপ্লবীর বাল্যকাল, যৌবন, প্রেম, বিপ্লব ও দেশ গড়ার গল্প। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নাকের ডগায় বসে নানা ষড়যন্ত্রের পরও কিভাবে এই ছোট্ট দ্বীপ দেশটিতে সমাজতন্ত্র টিকে রয়েছে- সেই গল্পই একটু ভিন্ন ধাচে লেখক আমাদের শুনিয়েছেন এখানে।
কিউবা ও ক্যাস্ট্রো সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য সমূহ ইতিহাস সম্মত ও বিভিন্ন প্রামান্য সূত্র থেকে নেয়া। তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বই, ডকুমেন্টারি, ফিল্ম, ফিচার ফিল্ম এবং বিবিধ ইন্টারনেট সূত্র থেকে।
বইটা যখন পড়ছিলাম, তখন লেখকের পাঠক সমাদৃত 'ক্রাচের কর্নেল' বইটির কথা মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম লেখক তো চাইলেই ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে নিয়ে তেমন একটা সাহিত্যকর্ম আমাদের উপহার দিতে পারতেন। কেন তিনি মাত্র সত্তর পৃষ্ঠায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এই মহানায়ক কে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
পরে ভাবলাম- 'ক্রাচের কর্নেল' এর জন্য লেখক যে পরিমান গবেষণা করেছেন, যত মানুষের সাক্ষাতকার নিয়েছেন, তা হয়তো ক্যাস্ট্রোর ক্ষেত্রে সম্ভবপর হতো না। ফলে কর্নেল তাহেরের ব্যক্তিত্ব যেমনভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, সেভাবে হয়তো ক্যাস্ট্রোকে কলমের কালিতে চিত্রায়িত করা সম্ভব হতো না। এসব বিষয় উপলব্ধি করার জন্য ব্যক্তিকে সামাজিক ভাবে উপস্থিত থাকতে হয়। এজন্যই হয়তো লেখক সাহিত্যের একটি আধুনিক জনরার মাধ্যমে কাজটি সেরেছেন, একই সাথে সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্য জগতকে।
যু্বকের কল্পনায় লেখক শাহাদুজ্জামান নানা বৈচিত্র্যময় বিষয় তুলে ধরেছেন। কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ঔপনিবেশিক শোষণ, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নগ্ন আগ্রাসন সহ বিপ্লবের প্রস্তুতি, গেরিলা দল গঠন, ব্যর্থ বিপ্লব, চে গুয়েভারার সান্নিধ্য, কারাজীবন এবং ভূ-রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক নানা উপাদানে সমৃদ্ধ হয়েছে বইটি। বিশ্বাস করি, বইটি পাঠকের মনে বিরক্তির ছাপ না ফেলে বরং জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিবে অনেকগুন।
-
বইঃ আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে
লেখকঃ শাহাদুজ্জামান
প্রকাশনীঃ ঐতিহ্য
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৪০ টাকা মাত্র
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৭০
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:১৫