'নেমেসিস' বাংলা নাট্যসাহিত্যের অন্যতম স্থপতি নুরুল মোমেন এর দ্বিতীয় নাটক ও ট্রাজেডি নাটক।
'নেমেসিস' কী বা কে? নেমেসিস হচ্ছে প্রাচীন এক গ্রীক দেবীর নাম। নামের সাথে মিশে থাকা অভিধা ‘প্রাপ্য প্রদান’। গ্রীকদের কাছে সে ছিল ঐশী প্রতিশোধের আত্মা। তার আরেক নাম ছিল—এডরেসটিয়া; অর্থ ‘যার কাছ থেকে পালানো অসম্ভব।’ নেমেসিস মানে এখন অমোঘ নিয়তি। হেলেনীয় জীবনবীক্ষার, গ্রীক ট্র্যাজেডির মূল থিম এই নেমেসিস।
এরপর, সাহিত্যে ট্রাজেডি বলতে আমরা কী বুঝি? Tragedy র বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বিয়োগান্তক রচনা। ট্রাজেডি হচ্ছে জীবনের স্বরূপ উদঘাটনে সাহিত্যের সবচে সাড়ম্বর সাহসী অভিযানের নাম । যেখানে মানবিক অস্তিত্বের মৌল প্রকৃতি প্রতিফলিত হয়। আদর্শগত সংজ্ঞা হিসেবে বলতে পারি, আদি-মধ্য-অন্ত সমন্বিত যে গুরুগম্ভীর নাট্য কাহিনীতে কোন অসাধারণ গুণসম্পন্ন নায়কের নিয়তির প্রভাবে বা চরিত্রের অন্তর্নিহিত ক্রুটির জন্য পরাজয় ঘটে, যা দর্শকচিত্তে উদ্রেক করে করুনা ও ভীতি এবং পরিশেষে ক্যথারসিস বা ভাব মোক্ষণ ঘটায় তাকেই ট্রাজেডি বলে।
সাহিত্যে ট্র্যাজেডির আবির্ভাব প্রাচীন গ্রীক সংস্কৃতিতে নাটক আকারে। আমাদের বাংলা নাট্যসাহিত্যেও রচিত হয়েছে বেশ কিছু মূল্যবান Tragedy । এক্ষেত্রে মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী', রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন', 'মালিনী', 'রাজা ও রানী', দ্বিজেন্দ্র লাল এর 'নুরজাহান', 'সাজাহান', 'চন্দ্রগুপ্ত' প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
যে বইটি নিয়ে আলোচনা করছি, অর্থাৎ নুরুল মোমেন এর 'নেমেসিস' এটিও একটি ট্রাজেডি ধর্মী নাটক। যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলা সংঘটিত মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত। নাটকটি সর্বপ্রথম ১৯৪৪ সালে নাটকটি "শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । প্রকাশের পরপরই এটি ব্যাপক আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়। এবং পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে এটি গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হয় । নুরুল মোমেন একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, নাট্যকার ও নির্দেশক ও প্রাবন্ধিক। আধুনিক বাংলা নাটকে অগ্রনী ভূমিকা রাখার জন্য তাকে 'নাট্যগুরু' হিসেবে সম্বোধন করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সে সময়ে যখন ইউরোপে যুদ্ধের দামামা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তার রেশ প্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়ছিল। এবং তখন উপমহাদেশে চলছে ব্রিটিশদের শাসন। উপমহাদেশে অবস্থানরত ইংরেজ সৈন্যদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারী ক্রয় নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে খাদ্য মজুদ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্ভিক্ষের সময় যেমন বহু মানুষ না খেয়ে মরেছে, তেমনি কিছু মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছও হয়েছে। এ নাটকটিতে সেই দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষ কেন্দ্রিক মজুতদারদের পিশাচবৃত্তি ও নিরন্নদের হাহাকারের বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
নাটকের একটি মাত্র চরিত্র। যতটুকু জানি বাংলা সাহিত্যে একক চরিত্রের নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কেউ লিখেনি। নুরুল মোমেন এই একটি মাত্র চরিত্রের মাধ্যমে দীর্ঘ সংলাপের ভিতর দিয়ে পুরো নাট্যকাহিনী বিবৃত করেছেন এবং একটি পরিপূর্ণ ছবি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
সেই একক চরিত্রটির নাম সুরজিত নন্দী। পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। ন্যায়-নিষ্ঠা ও স্বাভাবিক জীবন যাপনে বিশ্বাসী। কিন্তু এই বর্ণচোরার দেশে নিজ স্বার্থের জন্য বিবেকটাকে সাপের খোলসের মত ত্যাগ করা নতুন কোন বিষয় নয়। এটা বর্তমানেও আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ নিজ কৃতকর্মের জন্য বিবেকের দ্বারা দংশিত হয়। তেমনটা ঘটেছিল সুরজিত এর ক্ষেত্রেও।
সুরজিত ভালোবাসতো ধনী নৃপেন বোস এর কন্যা সুলতাকে। নৃপেন বোস লোভী ও খারাপ প্রকৃতির মানুষ। সে সুরজিতের সাথে মেয়ে বিয়ে দিলো এক শর্তে। তা হলো, তিনমাসের মধ্যে সুরজিতকে লক্ষ টাকা করতে হবে। না পারলে এই বিয়ে অস্বীকৃত হবে। একই সাথে সে শর্ত পূরণের রাস্তাও দেখিয়ে দেয়। নিজ ভালোবাসাকে ফিরে পেতে নৃপেন বোসের শর্ত এবং শর্ত পুরণের যে রাস্তা নৃপেন বাতলে দেয় তার সবটুকুই সুরজিত গ্রহন করে। এবং নিজ মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে বেছে নেয় কালোবাজারির পথ। যখন লক্ষ নিরন্ন মুখ খাবার পাচ্ছে না, তখন সেখানে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে তাদের মৃত্যুযাত্রা আরো সহজ করে দেয় সুরজিত এর কালোবাজারিরা। নাট্যকারের ভাষায়- "লক্ষ্মীর ভান্ডার বাংলাদেশ আজ নিরন্ন! বিশ্বের দোষ দেব না। আমাদের নালিশ আজ বাংলাদেশের লোকের বিরুদ্ধে, যারা দেশবাসীর উদ্যত হা’র সমুখ থেকে অন্ন সরিয়ে নিচ্ছে চারগুণ লাভের আশায়। অনাহার আর ক্ষুধায় দেশটাকে পিষ্ট করেছে। মা’র স্তনে দুধ নেই। চুষে চুষে দুধ না পেয়ে সন্তানগুলো কুকুরছানার মত কেই কেই করছে মার বুকে।"
এক সময় সুরজিত নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অনুশোচনায় ভুগতে থাকে। তাই তো সুরজিত এর বিবেক বলে উঠে- "মানুষের উপর রকমারি অত্যাচার করেছো। মৃত্যুদূতের দুহাত কাজে ভরে দিয়েছ। তাঁকে সব্যসাচী করে তুলেছো- তুমি। অন্ন থেকে বঞ্চিত করে, মরার পথে মানুষকে শুধু বসিয়ে দাও নাই, ওষুধ থেকে বঞ্চিত করে বেঁচে উঠার লড়াইয়ের হাতিয়ার থেকে বঞ্চিত করেছো- এই তুমি।"
স্বাভাবিক পথে অর্জিত অর্থ আমাদের পূর্ণ সুখ দিতে পারে। কিন্তু অবৈধ, অনৈতিক কিংবা মূলবোধ পরিপন্থী উপায়ে অর্জিত বিপুল অর্থ-বিত্ত কি সেই সুখ দিতে পারে? আমি মনে করি তা পারে না, কারণ আমরা মানুষ। আর যখন একজন মানুষের মধ্যে যতক্ষন মনুষত্ববোধ থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ তাকে সুখী করার পরিবর্তে মানসিকভাবে অসুখী ও আত্মাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। বিবেকের দংশনে বারবার তাকে দংশিত হতে হবে।
সুরজিত এর ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছিল। সেই দিকশূণ্য সময় সুরজিত এর উপর পতিত হয়েছিল প্রতিহিংসার দেবী 'নেমেসিস'। নেমেসিস কী প্রতিশোধ নিয়েছিল, তা এখানে বলছি না। বাংলা নাট্যসাহিত্যের এই অমরকীর্তিটি পড়ে নিজেই জেনে নিবেন।
শেষ করতে চাই এই নাটক সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যকর্মী সজনীকান্ত দাশ এর মন্তব্যের মাধ্যমে, তিনি বলেছিলেন -"দেড় ঘন্টা ধরে এই এক চরিত্র একাঙ্ক নাটকটি আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম একথা একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। সার্থক শিল্প সৃষ্টির মধ্যে এতোখানি গভীর অনুভূতি বাংলা সাহিত্যে দেখিনি।"
বাংলা বই পড়ুন। ভালো বই পড়ুন। হ্যাপি রিডিং!
-
বইয়ের নামঃ নেমেসিস
লেখকঃ নুরুল মোমেন
জনরাঃ নাটক
প্রকাশনীঃ স্কাই পাবলিশার্স
মুদ্রিত মূল্যঃ ৭৫ টাকা মাত্র।