"সিংহের মতো বলিষ্ঠ এবং শৃগালের মতো ধূর্ত হও। তোমার যারা সত্যিকারের শত্রু, তাদের তো বটেই, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিশ্চিহ্ন করে দাও, যেন তুমি শাসন করতে পারো নির্ভাবনায়।"
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা যারা রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন তাদের কাছে ‘ম্যাকিয়াভেলিবাদ’ তত্ত্বটি পরিচিত একটা শব্দ। এ তত্ত্বের প্রবর্তক হচ্ছেন ইটালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণকারী দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। যাকে আধুনিক রাষ্ট্র দর্শন ও চিন্তার জনক নামেও অভিহিত করা হয়।
উপরের উক্তিটি ম্যাকিয়াভেলি'র একটি উক্তি। তাঁর মতাদর্শ স্থান পেয়েছে তাঁরই লেখা বিখ্যাত ও বহু ভাষায় অনূদিত 'দ্য প্রিন্স' বইয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত আর সমালোচিত এ বইটি লেখা হয়েছিল ১৫১৪ সালে কিন্তু প্রকাশ পেয়েছিল ১৫৩২ সালে, তার মৃত্যুর পর।
নৈতিক দৃষ্টিকোন এবং আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে নৈতিকতার সাথে শাসনের কর্তৃত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শাসন তিনিই করবেন যিনি নিজে সৎ। দেশ শাসন করতে গেলে নীতিবান হতে হবে, সৎ হতে হবে। প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের সাথে থাকতে হবে মিল। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি ঠিক এ বিষয়টিতেই সজোরে আঘাত করেছেন তার 'দ্য প্রিন্স' গ্রন্থের মাধ্যমে। তার মতে শাসনক্ষমতার বৈধতা কোন নৈতিকতার মাপকাঠিতে আবদ্ধ নয়; কর্তৃত্ব আর ক্ষমতাই এখানে মূল বিষয়। যার ক্ষমতা আছে সে-ই শাসন করবে, নৈতিকতা কাউকে ক্ষমতায় বসায় না। সততা ও নৈতিকতার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখে বসে ম্যাকিয়াভেলি বলছেন যে, ক্ষমতা অর্জন আর ক্ষমতা রক্ষা করাই রাজনীতির মূল নীতি। ক্ষমতার উপযুক্ত ব্যবহার দিয়েই জনগণের আনুগত্য অর্জন করতে হয়। রাজনীতি মানেই হলো ক্ষমতা 'গ্রহণ আর প্রয়োগের' নীতি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছাড়া শাসনের অধিকারের কোনই মূল্য নেই। ম্যাকিয়াভেলি তার রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে অধিকার এবং বৈধতার ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ মুছে ফেলেন। আইন এবং শক্তি তার পরিবেশনায় একাকার হয়ে যায়। ম্যাকিয়াভেলির মতে, চরম ক্ষমতাশালী শাসককে জনগণ সর্বান্তকরণে মান্য করতে বাধ্য। ব্যক্তিগত গুণের বিষয়ে একটি দামি কথা বলেছেন তিনি: গুণ থাকার চেয়ে গুণের ভাণ করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ!
প্রশ্ন হচ্ছে এতসব অনৈতিক ও সমালোচনা যোগ্য এবং প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান থাকার পরও কেন ম্যাকিয়াভেলি ও তার মতাদর্শ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করতে সক্ষম হলো? কেন অনৈতিক উপায়ে শাসন ক্ষমতা দখল করে জনগণকে 'ডান্ডা মেরে ঠান্ডা' রেখে সামগ্রিকভাবে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে শাসনকার্য পরিচালনার নীতি আজও পৃথিবীর নানা প্রান্তে চর্চা হচ্ছে।
এর কারণ খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে রেনেসাঁ যুগে, যখন ইউরোপের রাজনীতি পোপদের হাত থেকে বদল হচ্ছিল নানা কারণে। সে সময়ের আধুনিক রাজনীতিতে কূট-কৌশল, শক্তি-সাহস-নির্মমতা দিয়ে বিজয়ী হওয়ার মন্ত্র দিয়েছিলেন তিনি। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে ঔপনিবেশিক ক্ষমতাধরে পরিণত হওয়ার পেছনে ‘দ্য প্রিন্স’- এর প্রণোদনা ও অবদান অনস্বীকার্য। 'দ্য প্রিন্স' প্রকাশিত হওয়ার পর সেকালের প্রচলিত শাসনের ধারা বদলে যায়। নতুন শাসন নীতি ও রীতির প্রতি আকৃষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ হন শাসকরা। ইউরোপকে সুসংহত করে বিশ্বকে উপনিবেশের অধীনে এনে নিয়ন্ত্রণের প্রণোদনাও রয়েছে 'ম্যাকিয়াভেলিবাদ' তত্ত্বে। একই সাথে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সমৃদ্ধ ও কল্যান রাষ্ট্র নিশ্চিত করা।
ম্যাকিয়াভেলিবাদ তত্ত্বের প্রয়োগে তখনকার পৃথিবীতে যেভাবে রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে, বর্তমান পৃথিবীর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিতেও তেমন ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই আমরা। গত শতকের শেষ কয়েক দশকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে স্বৈরশাসক, একনায়ক কিংবা সামরিক শাসকদের শাসনামলে ম্যাকিয়াভেলি'র তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়েছে। সেখানে তাঁরা কতটা সফল কিংবা ব্যর্থতা সে বিষয়টি ভিন্ন আলোচনার বিষয়। তেমনিভাবে এই শতাব্দীতেও গণতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক আবরণে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বহু দেশে আমরা নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসনকার্য পরিচালনা করতে দেখেছি কিংবা দেখছি। তাতে রাশিয়ার পুতিন, চীনের শি জিনপিং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ আরো বহু রাষ্ট্রনায়কের নাম যোগ করা যায়। নিজ দেশ ও বহির্বিশ্বে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার জন্য বহু শাসকের গৃহীত নীতি ম্যাকিয়াভেলিবাদ এর সাথে মিলে যায়। এবং ম্যাকিয়াভেলি'র দৃষ্টিতে শাসকদের যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেসব বৈশিষ্ট্যের সাথে অনেক শাসকদের মিল দেখতে পাই আমরা। সাহস, ধূর্ততা, ক্রুরতা, শঠতা, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, প্রতিপক্ষ নিধন ইত্যাদি কৌশল হয়ত আগের মতো নেই। কিন্তু এখনও বহু নির্মম পদ্ধতিতে ম্যাকিয়াভেলিবাদ চর্চা হচ্ছে রাজনীতির ময়দানে, তা নিজ দেশের জনগণের উপরই হোক কিংবা বৈশ্বিক প্রভাব সৃষ্টি করতে অন্য দেশ ও জাতির উপর। অন্য দেশে প্রভাব সৃষ্টি করতে আগের মত আর উপনিবেশ সৃষ্টি না করলেও বহু দেশ নগ্ন কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এর মাধ্যমে তা সফল করেন।
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে বহু আন্দোলন, ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করার পর দুই যুগের'ও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় গণতন্ত্র আজও প্রাতিষ্ঠানিক ও শক্তিশালী রূপ লাভ করতে পারেনি। বরং সময়ের আবর্তে ক্ষমতার লোভে শাসকগণ বারবার তাকে দূষিত করেছে। গণতন্ত্রের প্রতিটি কাঠামো দূর্বল থেকে দূর্বলতর করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবি সমাজকে বিভক্ত করে দলীয় রূপ দেওয়া হয়েছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করার মত নেতৃত্ব সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন মতামত প্রকাশে নিয়ন্ত্রন আরোপ করা হয়েছে। প্রতিটি সরকার যেন শাসনকার্য পরিচালনায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধী মত দমনে নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে পূর্বেকার সরকারের চেয়ে আরো প্রকট আকারে ম্যাকিয়াভেলি'র মন্দ নীতি সমূহ অনুসরণ করে গেছেন। যেহেতু রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে 'ক্ষমতায় যাওয়া ও শাসনকার্য পরিচালনা', সেজন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলো অনৈতিক উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখতেও পিছপা হন নি। যার ছোবলে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক চেতনা ও নূর হোসেন-ডাঃ মিলনদের রক্তার্জিত গণতন্ত্র বিপজ্জনক ভঙ্গুর অবস্থানে দাড়িয়ে বারবার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
তবে ম্যাকিয়াভেলিবাদ তত্ত্বের মন্দ দিকের পাশাপাশি কিছু ভালো দিকও রয়েছে। এতে জাতিরাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহতকরণ এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয় রয়েছে। জনস্বার্থ, জনকল্যাণ ও জনতুষ্টির লক্ষ্যে যদি ম্যাকিয়াভেলিবাদ প্রয়োগ করা হয়, তবে তা শাসক ও জাতি উভয়ের জন্যই কল্যান বয়ে আনে। শত সীমাবদ্ধতার পরেও ইতিহাসের বিচারে উত্তীর্ণ হয়ে সফল হতে পারেন সেসব শাসক।
যদিও দূর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে- খুব কম শাসকই ভালো নীতিসমূহ গ্রহণ করেছেন। বরং অধিকাংশ শাসকই মন্দনীতি এবং নিজের শাসনের জন্য সুবিধাজনক নির্দেশগুলোকে প্রতিপালন করেছেন। রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নাগরিকদের উন্নতি, সংহতি ও কল্যাণের বদলে নিজেদের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থের প্রতিই তারা বেশি মনোযোগী হয়েছেন কিংবা হচ্ছেন।
তবে ইতিহাসের শিক্ষা বড় নির্মম। ইতিহাস ও সময় ঠিকই প্রতিশোধ নেয়। শাসনকার্য পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহন, সামাজিক সুরক্ষা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, নিরপেক্ষ বিচার পরিচালনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো, দুর্নীতি দমন, জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন নিশ্চিত করার পরিবর্তে যেসব শাসক স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী নীতি গ্রহণ করে থাকে ইতিহাসের পাতায় তাঁরা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। গত পাঁচশ বছরের ইতিহাসে স্বৈরশাসক, একনায়ক, অগণতান্ত্রিক কিংবা ক্ষমতামত্ত শাসকদের যারা গণমানুষের ইচ্ছা ও মতামতকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দাবিয়ে রেখেছিলেন; ইতিহাস তাদের বিরুদ্ধে নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। ঘৃণায়, লজ্জায়, ধিক্কারে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সকরুণ পরিসমাপ্তি রচিত হয়েছে তাদের। অন্যদিকে যেসব শাসক কল্যান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ইতিহাসের গৌরবময় পাতায় স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা।
ইতিহাসের পাতায় বর্তমান সময়ের পৃথিবীর নানা প্রান্তের অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক উপায়ে ক্ষমতায় থাকা শাসকগণের অবস্থান কী হয়, তাও আগামী দিনে ইতিহাস-ই নির্ধারণ করবে বলে আমরা আশা রাখতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৬