গত শতকের সত্তরের দশক ঠিক আর দশটা দশকের মতো ছিল না। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। রাইফেল, রেডবুক দিকে দিকে মুক্তি আনছে— এই ছিল আহ্বান। তবে পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়ি গ্রামে যা শুরু হয়েছিল, তার তুলনা মেলা ভার! ১৯৬৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ি জেলায় কৃষকরা সংগঠিত হয়ে ভূস্বামী আর তাদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বারুদ যেন দিয়াশলাইয়ের আগুন পেল,দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে এ কমিউনিস্ট আন্দোলন।
নকশালদের আহ্বান ছিল ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন’। এ আহ্বান সফল হয়নি, দেয়ালে লেখাও মুছে গেছে বহু আগেই কিন্তু নকশাল আন্দোলনের স্মৃতি, রাজনীতি কিংবা ইতিহাস কোনোটাই এতটুকু বিস্মৃত হয়নি।
নকশাল আন্দোলন কারো কাছে ছিল বিপ্লবের যাত্রা, কারো কাছে সন্ত্রাস। যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুন না কেন, সে সময়কে মুছে দেয়া অসম্ভব। হাজার হাজার তরুণ নিজের সার্টিফিকেট পুড়িয়ে দিয়ে, নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমে পড়েছিল।
নকশাল আন্দোলন একদিকে যেমন ভারতের রাজনৈতিক জীবনকে আলোড়িত করেছিল, তেমনি নাড়া দিয়েছিল সংস্কৃতি, সাহিত্যের জগতকেও। এ আন্দোলন কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অনেক কালজয়ী উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, গান।
এ আন্দোলনের সংগে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলার বেশ কয়েকজন কবি, লেখক। কবিরা একদিকে যেমন শব্দে আগুন জ্বালিয়েছেন, তেমনি মাঠের লড়াইয়েও শামিল হয়েছিলেন। কবিরা খুন হয়েছেন, কারাগারে গিয়েছেন, নির্যাতন সয়েছেন। নকশাল আন্দোলনে যুক্ত চারজন তরুণ কবি খুন হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে, জেলখানায় বন্দি অবস্থায়।
জেলখানায় খুন হওয়া সেই কবিদের একজন হলেন কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়। কবিতা কি চিঠি— সবখানেই মুরারি ছিলেন সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষায় অস্থির। যুগের ক্রোধ যেন মুরারির কলমে ভাষা পেল। শহরের বাবুদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার। জেল থেকে মাকে লেখা মুরারির চিঠি যুগযুগান্তের বিপ্লবী তরুণের স্মারক। শ্রেণীবৈষম্য ভরা সমাজ যত দিন থাকবে, মুরারির চিঠিও তত দিন প্রাসঙ্গিক।
মুরারি জেল থেকে মাকে লিখছেন, ‘যে সমাজে বড়লোক আরও বড়লোক হয় আর গরীবের কুঁড়ে ঘরে মাঝরাতে বৃষ্টির জলে ঘুম ভেঙে যায়, দেয়ালের মাটি ধসে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের বুকে, সত্যি করে বলতো মা, সে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার কোন অর্থ আছে?’ অন্য একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘ওরা আমাদের জেলে পুরেছে, হত্যা করছে, আরও অনেক কিছু করার কুমতলব আঁটছে, কিন্তু মূর্খ ওরা। তুমিও বলো হাত দিয়ে সূর্যের আলো ঠেকানো যায়?’ জেলে বসেও মুরারির তেজ আর পার্টি আর বিপ্লবের ওপর আস্থা এতটুকু কমেনি, চিঠিতে আরো লিখেছেন— ‘আমরা জিতেছি, আমরা জিতবো, আমরা শত্রুর ঘুম কেড়ে নিতে পেরেছি। হত্যা করার একচেটিয়ে অধিকার আমরা ওদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। এতদিন জোতদাররা কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করেছে, আজ আমাদের পার্টির পরিচালনায় কৃষকরাই ওদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে, ওরা পালিয়ে যাচ্ছে, শহরে।'
কবি ১৯৬৭ সাল নাগাদ, এম.এ. ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে, নকশালবাড়ী আন্দোলনে যোগ দেন। আড়িয়াদহ দক্ষিণেশ্বর অঞ্চলের বিভিন্ন গণসঙ্গঠন ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এলাকার যুবছাত্রদের বিপ্লবী রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করার জন্য তিনি প্রাথমিক পর্যায়ের ফ্রী কোচিং সেন্টার, সাংস্কৃতিক পত্রপত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। এর পরে তিনি আড়িয়াদহ-দক্ষিণশ্বরের আঞ্চলিক পার্টির দায়িত্ব পরবর্তী তরুণ নেতৃত্বের উপর দিয়ে, বাংলা বিহার উড়িষ্যা সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির কৃষক সংঘটনের কাজে যোগ দিতে চলে যান। ব্যক্তিগত জীবনে মুরারি ছিলে সৎ নির্ভিক কর্তব্য-সচেতন এক মানুষ। পরিবারের প্রতি কর্তব্য, পার্টির প্রতি কর্তব্য এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে কোন ত্রুটি ছিলনা। গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকশনের মুহূর্তেও তিনি সংযত ধীর ও দৃঢ়সংকল্প থাকতেন। তিনি নাকি বোমার মশলাশুদ্ধ ব্যাগও রবীন্দ্ররচনাবলী বহন করার মত করে নিয়ে যেতেন!
একটি কবিতা পাঠের আসরে মুরারির আলাপ হয়েছিল শ্রীমতী ভদ্রা চক্রবর্তীর সঙ্গে। ক্রমে তাঁরা প্রণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন। কিন্তু সংসার পাতার স্বপ্ন আর সফল হয়নি। মুরারি মারা যাবার পর আরও বছর দশেক তিনি বেঁচেছিলেন। অন্য এক উদারচেতা কমরেড তাঁকে বিবাহ করেন এবং তাঁদের দুটি সন্তানও হয়। ভগ্নহৃদয় এই নারী, সকলের অগোচরে দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যে কবে যে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন কেউ তা ভাবেনি।
১৯৬৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ মুরারি ওরফে আনন্দকে বহড়াগোড়া-চাকুলিয়া অঞ্চল থেকে গ্রেফতার করা হয়। সেই সূত্রে তাঁর কারাবাস হয় বিহারের হাজারিবাগ জেলে। ১৯৭১ সালের ২৪শে জুলাই তারিখে দুপুর আড়াইটায়,বিহারের হাজারিবাগ জেলে কারারক্ষীদের গুলি চলে যাতে শতাধিত আহতের সঙ্গে ১৬জন বন্দী নিহত হন। কবি মুরারি মুখোপাধ্যায় সেই ঘটনার নিহতদের মধ্যে ছিলেন। যাঁরা সেই গণহত্যায় মারা গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন মুরারি মুখার্জী,বিজন, মিশ্র, ডি.কে, ডাম্বেল, বাবি, চিরম্,প্রদীপ, বেণু, অলক, সুনীল, গণেশ, গুরুচরণ, রবীন অধিকারী, মাধবানন্দ এবং সমীর। মুরারির মৃতদেহ তাঁর পরিবারের হাতে দেওয়া হয়নি।
মুরারি স্মৃতিরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে “মৃত্যু নেই” নামে একটি কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।
কবির লেখায় ফুটে উঠেছিল আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, বিপ্লবের আহ্বান, রাজনৈতিক স্লোগান, পরিস্থিতির সরল বিবরণ।
কবির লেখা কয়েকটি কবিতা পাঠকের জন্য পেশ করলাম-
পড়েশুনে ভালো হওয়া---সে আমার ন
~
পড়েশুনে ভালো হওয়া---সে আমার নয়,
লভিব আনন্দকণা আড্ডার আসরে
যদি বাধা দাও মোরে ; যুক্তির সুতীক্ষ্ণবাণে
খণ্ডন করিব তাহা---পড়িবে ফাঁপরে।
ধীরে ধীরে কাঁটা ঘুরে যায়,
এই মাঠে এই ঘাসে কারা যেন
গানেতে মাতায়---শুনেছ কি? যদি
নাহি শুনে থাকো---এসো বলি,
না, না, নামগোত্রে নাহি প্রয়োজন
নির্বিবাদে লইব তোমায়,
এখানে প্রাণের কথা বলি---
এসো চলি।
➖➖➖➖➖➖
কিবা লাভ পড়াশুনা কো’রে?
~
কিবা লাভ পড়াশুনা কো’রে?
কত কথা তুবড়ী সম লাল হয়ে ঘেরে
শোন নি কি? রাজনীতি, কুনীতি, দুর্নীতি
চা-বিড়ি সিগারেট---ধোঁয়ায় ধোঁয়াটে মূর্তি
রাম, মতিস হোরে---
কিবা লাভ পড়াশুনা করে?
চকিত চঞ্চলা কত চরণের তালে
সিটি পড়ে মাঝে মাঝে---মনে হয়
কোকিল এসেছে যেন ডালে।
বসন্ত কন্যাকে নিয়ে ক...ত সম্বোধন
কোকিলের ভালোবাসা---মন।
কিছু লাজ, কিছুবা ভর্ৎসনা
অবজ্ঞা মিশ্রিত কিছু ঘৃণা---সব পাবে হেথা ;
এই তো জীবন।
গানে গানে প্রাণে প্রাণে হাত ধরাধরি
হৃদয়ের কত আলাপন---এই তো জীবন।
কিবা লাভ পড়াশুনা কোরে---
হৃদয়েরে ফাঁকি দিয়ে গোমড়ামুখ চাহি নি সে আমি
দেখ থরে থরে---
হাসিছে হাসির মূর্তি রাম, মতি, হোরে
কিবা লাভ পড়াশুনা করে।
➖➖➖➖➖➖
ঘড়ি চলে
~
ঘড়ি চলে ঠিক্ ঠিক্ ঠিক্
সময় কে কোলে ক’রে নিয়ে
মানুষ চেয়ে থাকে ভবিষ্যতের দিকে
বাঁচার প্রত্যাশায়।
. অনন্ত জিজ্ঞাসা শুধু
. আর্তনাদ করে ওঠে বাঁচতে দাও,
. বাঁচতে দাও নূতন জীবন নিয়ে
ঘড়ির কাঁটাতে কাঁটাতে ফেরে
শুধু একটি কথা ঠিক্ ঠিক্ ঠিক্।
সমাজ ব্যঙ্গ ক’রে হাসে ফিক্ ফিক্।
➖➖➖➖➖➖
২৫শে বৈশাখ
~
আজকে আমার
স্বপ্ন দেখার দিন। শিল্পীর মূর্তিকে
সামনে রেখে আজকে আমি শিল্পী
হবার স্বপ্ন দেখলেম। এই স্বপ্নমায়ার
হাতছানিতেই পেলেম আমার কল্প লোকের
স্বর্গ পথ, আমার ভাসবাসার ঝর্ণাধারা
---সুর যেখানে ভাষা খুঁজছে, আলো
যেখানে বস্তুর প্রত্যাশায় চঞ্চল,
নূপুর যেখানে ছন্দের অন্বেষণে
দিশাহারা। এ আমারই জগৎ---নূতন
ভাবনায়, নূতন ভালোলাগায়
আর নূতন মনন চিন্তায় দোলায়িত
এ আমারই স্বর্গ।
এই স্বর্গ সাধনার আলোকে আলোকে
আলোকিত হব আমি। শিল্পীসত্তার
মধুরতম উদ্বোধনের ক্ষণে অবাক
হতে হতে মুগ্ধ হয়ে যাবো কখন।
এই চাওয়াই আমার পরম চাওয়া
আর এর সার্থকতাই হোক আমার
জীবনের পরম পাওয়া।
➖➖➖➖➖➖
প্রতিবাদ
~
যদিও মৃত্যু আছে পৃথিবীতে
লোনা জল সমুদ্রের গভীরতা নিয়ে
যদিও প্রতিটি রাত
কান্নার জোয়ারে যায় ভেসে,
তবু আমি বাঁচতে চাই।
দিনের প্রচুর আলো
ছোট হতে হতে অবলুপ্ত হয়ে যায়
কারখানার গাঢ় অন্ধকারে
তবু আমি বাঁচতে চাই।
অনেক কথার বোঝা
আটকে যায় বুকে
কোননা ঠোঁট রক্তহীন,
( ব্যথিত হৃদয় মোর
কেঁকে ওঠে চমকে চমকে )
তবু আমি বাঁচতে চাই।
হয়তো সফল হবো
. কিংবা হবো না
নিঃসাড়ে পড়ে থাকবো
অন্ধকারে, রক্তঝরা মুখে,
তবু আমি বাঁচতে চাই
এই কটা দিন
সমাজের প্রতিবাদ হয়ে
আমি বাঁচতে চাই
➖➖➖➖➖➖
শিল্পী
~
জগতের মহাশিল্পী তুমি
অজানার গর্ভে থাকি
বিশালেরে ভালবাসি
আঁকিতেছ কতশত ছবি
আরাদের বক্ষোপরি ঘন নীলিমায়
. চাঁদের জ্যোত্স্না আর
. সূর্যের সপ্তরঙে
. আঁকিতেছ ছবি।
কারে শিখাইতে কারে দেখাইতে
রাখি না অন্ধকারে
সব স্মৃতি হয়ে যায় ম্লান
তবু তুমি সৃষ্টিসুখে
অনিবার আঁকিতেছ ছবি।
মেঘে ঢাকা আকাশের কোলে
তোমারই মনের শত ছবি।
➖➖➖➖➖➖
মানুষের ছা
~
ক্লেদাক্ত পাঁকের মধ্যে কিলবিল করতে দেখে
তোমাদের বলি যদি নরকের কী----
তা’হলে বিরক্ত হবে। এবং অনুকম্পা।
হয়তো বা আলবাট চুলে আরেকটা ঢেউ দিয়ে
জামার ভাঁজের প্রতি সচেতন হয়ে, পান খাওয়া ঠোঁটে
সিগ্রেটের ধোঁয়া নিয়ে বলবে---
ওটা পাগল, হতাশ কিংবা ভণ্ড।
অথচ তোমরাই প্তিদিন দিনান্তে
ফিরে আসে একই আঁধারে।
এবং নতুন কিছু যোগের অভাবে
বিয়োগেতে হাত রপ্ত করো।
এইভাবে মশারীতে রাত্রি নেমে আসে।
এবং অল্পদিনের আগে কেনা
একজোড়া ঝুলে যাওয়া স্তনে
তোমাদের দীর্ঘশ্বাস অস্পষ্ট থাকে না।
এসব যাবে না তবু বলা, কেননা পরের দিনই
তোমরা মানুষ হবে সকালের ট্রেনে---
মুখেতে সিগ্রেট জামা ধোপায় কাচা
চুলে মাখা শালিমার মানুষের ছা!
➖➖➖➖➖➖
হিরোসীমার জিজ্ঞাসা
~
যদি অবিন্যস্ত চুল, বেদনাদ্র
মূর্তি কোন ছেলে বই খাতা হাতে
আমার কাছে এসে বলে,
আমি প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলাম জীবনে,
তোমরা কেন আমাকে মারলে? যদি জিজ্ঞাসা করে
আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নি,
তোমরা কেন আমার ক্ষতি করলে।
আমার অস্থি দিয়ে কি তোমরা জীবন-বিরোধী
দানব আর অশান্তির শয়তানগুলোকে
পরাজিত করতে পেরেছো?
তবে কেন আমায় বাঁচতে দিলে না---
তখন আমি কি উত্তর দেবো।
আমি আমেরিকান,
হিরোসীমার ঐ ছাত্রটাকে তো
আমরাই মেরেছি বোমার আঘাতে
তার বিদ্যালয়ের পথে।