গত শতাব্দীর শেষার্ধে যারা মুক্তচিন্তা-কর্মে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের অন্যতম আহমদ ছফা।
আজ ২৮ জুলাই, ২০০১ইং সালের আজকের এ দিনে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সময়ের সাহসী সন্তান আহমদ ছফা'র মৃত্যু হয়। প্রয়াণ দিবসে উনাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়। একই সাথে উনার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসের অন্যতম প্রতিবাদী এবং প্রগতিশীল এই মানুষটি ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
ষাটের দশকে সাহিত্য জগতে পা রাখেন আহমদ ছফা। সমসাময়িক উপন্যাস লেখকগণের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই আলাদা। তার লেখাগুলোর দিকে তাকালে একটি বিষয় নজরে পড়বে। প্রায় প্রতিটি লেখাই সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমসাময়িক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে। তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবীমহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাঁকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। বক্তব্যের স্পষ্টতা আর তীব্রতার জন্য খুব দ্রুত পাঠকদের মাঝে সাড়া ফেলে দেন তিনি। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে স্বাধীনতার পথে হাঁটতে থাকা বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলী হলো- মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘অলাতচক্র’ (১৯৯৩), বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), ‘ওঙ্কার’ (১৯৭৫), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮), অলাতচক্র (১৯৯৩), গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্পবৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬), ফাউস্ট (১৯৮৬), যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮) ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ সংযোজন। তার বেশ কিছু বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
বাংলাদেশের মনন ও সৃজনীশক্তির এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের কাছে অনন্য হয়ে আছেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফার তুলনা কেবলমাত্র আহমদ ছফা নিজেই। তাঁর লেখা যেমন অনন্য, বলাও তেমন অতুলনীয়। নানা লেখায় ও আলাপনে একটা জাতির নানা সংকটের ছবি অনিন্দ্যসত্য ভাষায় তুলে ধরেছেন তিনি । তিনি আমাদের সংকটের একেবারে মর্মমূলে গিয়ে হাজির হতে পারতেন।
তাঁর এই প্রথা বিরোধীতা ও স্পষ্টবাদীতা ৭০- দশকে অনেককে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর সান্নিধ্যে এসে পরবর্তীতে কীর্তির সাক্ষর যারা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রয়াত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক সলিমুল্লাহ খান অন্যতম।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।
একজন প্রতিবাদী লেখক, একজন প্রগতিপন্থি সাহিত্যকর্মী ও সংগঠক আহমদ ছফা, আমাদের সেই আলোকিত নক্ষত্র, যে নক্ষত্রের মৃত্যু নেই, আলো ছড়িয়ে যায় অনন্ত কাল। আলো ছড়িয়ে যাবে অনন্ত কাল।
সবশেষে, একটা কথাই বলতে চাই- আমাদের তরুন সমাজে আজ খুব বেশি আহমদ ছফা পাঠ প্রয়োজন। আহমদ ছফা'র সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ তাঁর আখ্যানমূলক রচনায় রূপায়িত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, মুক্তিকামনা ও স্বাধীনতাস্পৃহা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:২৮