ছবি-prothomalo.com
যুক্তরাষ্ট্রের মতো এমন সুনির্দিষ্ট নিয়ম পৃথিবীর আর কোনো দেশেই নেই। কেবল শপথ গ্রহণই নয়, আমেরিকার সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণসহ প্রতিটি ধাপই সুনির্দিষ্ট। এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে, আগামী ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন। মূলত এই ২০ জানুয়ারি তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছে মার্কিন সংবিধানে।
সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী, ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পরের বছরের ২০ জানুয়ারি দুপুরে নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন। আর এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসেবে অভিষিক্ত হবেন তিনি। অর্থাৎ, ঐদিন বেলা ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন বিদায়ি প্রেসিডেন্ট।
ছবি-time.com
সময়ের হিসাব করলে এই রেওয়াজের বয়স শত বছরও ছোঁয়নি। সুস্পষ্টভাবে বললে, ১৯৩৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ওটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ। প্রথম মেয়াদে তিনি শপথ নিয়েছিলেন সংবিধানে উল্লিখিত ৪ মার্চ ।
গবেষণা বিষয়ক পত্রিকা লাইভ সায়েন্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৩৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। সেটা ছিল রুজভেল্টের দ্বিতীয় মেয়াদ। প্রথম মেয়াদে রুজভেল্ট শপথ নিয়েছিলেন সংবিধানে উল্লিখিত ৪ মার্চ। তার আগের সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই ঐ তারিখেই শপথ নিয়েছেন ১৭৮৯ সালের সংবিধানের ধারাবাহিকতা মেনে।
ছবি-channelionline.com
নির্বাচনের পর নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার পর্যন্ত সোয়া দুই মাসের বিরতির কারণ সম্পর্কে জানা যায়, মূলত দুটি কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রথম কারণ - প্রথম কারণটি এই সময়ে শুনতে একটু কেমন লাগলেও তা সত্য। নির্বাচিত নতুন প্রেসিডেন্টের ওয়াশিংটনে এসে ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ছিল।কারণ, আগে আমেরিকার যোগাযোগব্যবস্থা বেশ খারাপ ছিল।আর আমেরিকা বিশাল দেশ। ফলে, দেশের দূরের প্রান্ত থেকে কেউ এসে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য একটা লম্বা সময় এই ভ্রমণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।
দ্বিতীয় কারণ - দ্বিতীয় কারণটিই মুখ্য আর তা হলো ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বিদায়ী প্রশাসনের কাছ থেকে নানা তথ্য নতুন প্রশাসনকে দেওয়া, নতুন প্রশাসনের মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্য একটা সময় প্রয়োজন। আগে প্রযুক্তি উন্নত ছিল না। ফলে নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শপথ গ্রহণের জন্য মোটাদাগে চার মাসের একটা সময় রাখা হতো। কিন্তু সমস্যা হয় ১৮৬১ সালে। সে বছর মার্চে আব্রাহাম লিঙ্কন ক্ষমতা গ্রহণ করতে করতে চলমান গৃহযুদ্ধে মার্কিন পক্ষের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। এই একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সাত দশক পর ১৯৩৩ সালেও। মহামন্দার সেই সময়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারের কাছ থেকে ক্ষমতা নেন রুজভেল্ট। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, মানুষ উদগ্রীব হয়ে শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষা করছিল। সেই বছরই প্রথম এই দীর্ঘ বিরতি একটা বড় সমস্যা হিসেবে সামনে হাজির হয়। আনা হয় সংবিধানের ২০তম সংশোধনী, যেখানে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেকের দিন হিসেবে ২০ জানুয়ারির কথা বলা হয়।
ছবি- americanprogress.org
ট্রাম্পের আগে শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন ৫ বিদায়ি প্রেসিডেন্ট
যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী একটি প্রথা হলো নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে বিদায়ি প্রেসিডেন্টের উপস্থিত থাকা। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজয় না মেনে সেই প্রথা রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন । এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তবে ট্রাম্পই প্রথম নয়, এর আগে অন্তত পাঁচ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন কাজ করেছেন। উত্তরসূরির শপথ অনুষ্ঠানে তারা উপস্থিত থাকেননি। এরা হলেন - জন অ্যাডামস, জন কুইন্সি অ্যাডামস, মার্টিন ফন ব্যুঁরে, অ্যান্ড্রু জনসন এবং রিচার্ড নিক্সন।
নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে ভীষণ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গত শে ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। নিয়ম অনুযায়ী ২০ জানুয়ারি দুপুরে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি। চার বছর আগে ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি অভিষিক্ত হয়েছিলেন এবার বিদায় নিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর আগের বারাক ওবামাসহ সাম্প্রতিক সব মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিষেকই এই জানুয়ারীর ২০ তারিখে হয়েছে। কথা হলো কেন ও কবে থেকে এই বিশেষ দিনে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেকের এই রেওয়াজ পালন করা হচ্ছে?
পৃথিবীর সব দেশেই সরকার বদলের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ রেওয়াজ রয়েছে। একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম বিষয়টি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত সুনির্দিষ্ট কোনো দেশেই সম্ভবত নেই। এই যেমন এই ২০২১ সালে দাঁড়িয়েই বলে দেওয়া যাচ্ছে, আগামী ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন। দেশটির সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণসহ প্রতিটি ধাপ খুবই সুনির্দিষ্ট করা আছে।
কথা হলো, কেন ২০ জানুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টরা শপথ নেন? উত্তর হলো মার্কিন সংবিধান। মার্কিন সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী, নভেম্বরের নির্বাচনের পরের বছরের ২০ জানুয়ারি দুপুরে নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসেবে অভিষিক্ত হবেন। ওই দিন বেলা ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন আগের প্রেসিডেন্ট। এই সময়ের পর আর তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। এবার যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে ২০ জানুয়ারি ঠিক দুপুরে।
ছবি-alochitobangladesh.com.bd
এ বছর করোনা মহামারির কারণে এবং গত ৬ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল হামলার জেরে অভিষেক অনুষ্ঠানের পরিসর অনেক ছেঁটে ফেলা হলেও সাধারণত ক্যাপিটল হিলের ওয়েস্ট ফ্রন্টের সামনের লনে উন্মুক্ত মঞ্চে এই অনুষ্ঠান হয়। গত ১৫ ডিসেম্বরই এবারের অনুষ্ঠানের নতুন ধরন সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হয়। সে সময়ই জানানো হয়, সাধারণ মানুষের জন্য এবার আর আগের মতো অনুষ্ঠান উন্মুক্ত থাকছে না। এমনিতে অভিষেকে যোগ দিতে নিবন্ধন করতে হয়, যার নিয়ন্ত্রণটি থাকে কংগ্রেসের হাতে। যে কেউ নিজের এলাকার কংগ্রেস সদস্যদের মাধ্যমে বিনা মূল্যে টিকিট সংগ্রহ করতে পারে। অভিষেক অনুষ্ঠানবিষয়ক কংগ্রেস কমিটি নির্ধারণ করে, কতজন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে। সেই হিসাবের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকার বিপরীতে টিকিট বরাদ্দ করা হয়, যা বিলি করেন সংশ্লিষ্ট কংগ্রেস সদস্যরা। এবার আগে থেকেই সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে ঘরে থাকার মানে অভিষেক অনুষ্ঠান না দেখা নয়। ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানটি দেখা গিয়েছে। আর সিএনএন, এবিসি, এনবিসি, সিবিএস, এমসএনবিসি ও ফক্স-এর মতো সম্প্রচারমাধ্যমগুলো তো রয়েছিল, যারা সরাসরি অভিষেক অনুষ্ঠান দেখিয়েছে। এবার এই সরাসরি অনুষ্ঠান দেখেই আশ মিটিয়েছে মানুষ। করোনা এমন অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। অভিষেকের সময় আগের নানা জমকালো অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। বিশিষ্টজনদের নিয়ে নৈশভোজ, অভিষেকের পূর্ণাঙ্গ মহড়াসহ অনেক কিছুই বাতিল করা হয়েছিল এবার। প্রেসিডেনশিয়াল প্যারেডের পরিসরও ছোট করে আনা হয়েছিল। প্যারেডের সময় রাস্তার দুপাশে ছিলনা মানুষের ভিড়। তারপরও অনুষ্ঠানস্থলে যাদের থাকার সৌভাগ্য হয়েছে, তাঁদের মুখে ছিল মাস্ক। আর শারীরিক দূরত্ব হিসেবে ছয় ফুট দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টি তো ছিলই।
এখানে মনে একটি প্রশ্ন জাগে - জমকালো এই অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করে কারা ? স্বাভাবিকভাবেই এর একটি অংশ আসে করদাতাদের কাছ থেকে। বাকিটা আসে আলাদাভাবে সংগৃহীত অনুদান থেকে। এ ক্ষেত্রে অভিষেক সম্পর্কিত কংগ্রেস কমিটি, প্রেসিডেনশিয়াল অভিষেক কমিটি, ফেডারেল সরকার এবং অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় সরকারগুলো যৌথভাবে ব্যয় বহন করে। পরিসর ছোট হওয়ায় এবার নিঃসন্দেহে এই ব্যয় অনেক কম হয়েছে। তবে মূল অনুষ্ঠান ছোট হলেও আতশবাজি বা নাগরিকদের আনন্দ উল্লাসে খুব একটা বাধা ছিল না। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল নিশ্চিদ্র। নতুন পরিস্থিতিতে এবারের অভিষেক অনুষ্ঠান ইতিহাসে নানাভাবেই উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। কারণ, এবার ফার্স্ট লেডিসহ সদ্যসাবেক হওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সসম্মানে ও সগৌরব বিদায় দেখেনি বিশ্ববাসী যা মার্কিন প্রেসিডেন্সি বদলের ক্ষেত্রে একটি আইকনিক দৃশ্য হিসেবে বরাবর বিবেচিত হয়ে আসছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:৫৪