আজ মিছিলের পথগুলি মিশেছে শাহবাগ। কাঁধে কাঁধ, কন্ঠে কন্ঠ মিলেছে ঐ শাহবাগে। সেখানে একটি মুষ্ঠিবদ্ধ হাত না হয়ে ওঠার যাতনা, প্রবাসের আরো শত যাতনার মতো হাহাকার বাড়ায় কেবল। তবে আছি, আমি, আমরা হাজার লক্ষ প্রবাসী বাঙালীও আছি সেখানে, যেমন আমার গাঁয়ের এঁদো জলাশয়ের শাপলায় থাকি, অগ্রহায়নের নতুন ধানের গন্ধে থাকি, থাকি পহেলা বসন্ত, একুশে ফেব্রুয়ারী কিংবা পহেলা বৈশাখে। আমরা সেখানে আছি, যেমন থাকি ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরে। ঐযে গীটার হাতে আমার ভাই, শ্লোগানে আমার বোনটি, ঐ রিকসা চালক, শ্রমিক, ঐ যে আলোকিত জনতা আমার আত্মার আত্মীয়। আমরা একসঙ্গে আওয়াজ করছি, দৃপ্ত কন্ঠে। আমরা মেনে নিতে পারিনি ঘৃন্য যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়, কেবল ফাঁসি চাই।
আমাদের প্রতিবাদ বজ্র হয়ে আজ বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে আওয়াজ তুলছে, দাবী একটাই ফাঁসি চাই।
এই যে শক্তি তারুন্যের, এই যে জলদ গম্ভীর দাবী, এই দাবী জাতির দাবী, ৪১ বছর ধরে কলঙ্কময় যুদ্ধাপরাধী আর এদেশের জন্মের বিরোধিতাকারী দালালদের আর বহন করতে চায় না এই জাতি। ভিন্নমতের উসিলায় সেখানে এই যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জামায়াত-শিবিরের কোন অধিকার নেই এই দালাল, খুনী, ধর্ষক এবং সর্বোপরী স্বাধীন বাংলা, জয় বাংলার চেতনা বিরোধী এইসব খুনীদের পক্ষে গলা উচু করে কথা বলার। আমরা চিৎকার করে বলছি, কসাই কাদেরের যাবজ্জীবন মানি না, ফাঁসি চাই। এ ব্যাপারে সারা বাংলা আজ এক হয়েছে, আর বিরোধীতাকারীও আছে, যেমন ছিলো ৫২, ৬৯ এবং ৭১ এ। তাদের আমরা থোরাই কেয়ার করি, কখনো করিনি আর ভবিষ্যতেও করবোনা। এখন বাস্তবতার নিরীখে, আমাদের এই আন্দোলনের গন্তব্য ঠিক করতে হবে। এই আন্দোলনের হোতা কে, নেতা কে সেই ব্যাক্তিকে খুঁজতে চাইছি না, কিন্তু অবস্থান ধর্মঘট আর প্রতিবাদ থেকে যখন মহাসমাবেশ এর ডাক আসে তখন সেই ডাক, কর্মসূচী দেবার জন্য কোন না কোন কন্ঠস্বরের প্রয়োজন পরে। প্রয়োজন পরে। আন্দোলনকারী সহযোদ্ধা, সহব্লগারদের কাছে এই আন্দোলনের গন্তব্য নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছিলো,
১) এই আন্দোলন ট্রাইব্যুনাল ও সরকারের বিরুদ্ধে নয়- এমন কথা অনেক ব্লগারকে বলতে শুনেছি, আমি নিজেও তা-ই বিশ্বাস করতে চাই। তাহলে এই আন্দোলনের টার্গেট গ্রুপ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীরা। রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল, যুদ্ধাপরাধীরা নয়, কাজেই প্রশ্ন উঠতে পারে, 'যাবজ্জীবন নয় ফাঁসি চাই' এই দাবী কার উদ্দেশ্যে? এই দাবীর প্রেক্ষিতে সরকারই একমাত্র পক্ষ যে তার বক্তব্য দিতে পারে। এখানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিশ্চয়ই এসে বলবে না, যে আমরা ফাঁসির দাবীতে একমত হলাম। আর সরকার বা সরকারের মুখপাত্র বলতে পারে যে আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবো। আমার জানা মতে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত সাজার রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপীল করতে পারবে না, আপীল করতে পারবে খালাস হয়ে যাওয়া রায়ের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে, আপীল করতে সময় লাগবে, এবং আপীলের আশ্বাস ইতিমধ্যে এটর্নী জেনারেল দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই আশ্বাসের উপর বিশ্বাস করে কিংবা না করে আমাদের আন্দোলনের গতি কি হবে?
২) 'সাজা বাতিল করতে হবে' এই জাতীয় দাবী কি যুক্তিযুক্ত? আর এই দাবী কি ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্ন কিংবা বিতর্কের মুখে ফেলবে?
৩) 'আঁতাত ত্তত্ব' কি এই উপসংহারে নিয়ে যায়না যে, আঁতাতের কারনে (আঁতাত হয়েছে কি হয়নি, সে বিতর্ক যাচ্ছি না) সরকার ট্রাইব্যুনালকে দিয়ে কসাই কাদেরের বিরুদ্ধে রায়কে কমিয়ে ফাঁসির স্থলে যাবজ্জীবন করেছে? সেক্ষেত্রে, জামায়াত এতোদিন ধরে যে দাবী করে আসছে যে, "এই ট্রাইব্যনাল আওয়ামী ট্রাইব্যুনাল, অর্থাৎ সরকার বা আওয়ামীলীগ ইচ্ছে মতোন এই ট্রাইব্যুনালকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে।" আঁতাত তত্ত্ব কি পক্ষান্তরে জামায়াতের বক্তব্যকে জোড়ালো করছে?
৪) কাদেরের ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন হওয়াতে আমরা হতাশ ও বিক্ষুব্ধ। যে জামায়াত এইসব যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় স্থল ও এদেরকে বাঁচাতে মরীয়া, সেই জামায়াতের প্রতি আমাদের ঘৃণার প্রকাশ কাদের মোল্লা বা অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের তুলনায় কম কি?
৫) নেতাদের সাজা গৃহযুদ্ধের হুমকী দিয়েছিলো জামায়াত-শিবির। মূলত এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্থ করতে এমন কোন কাজ নেই যা জামায়াত-শিবির করেনি। এখন কি সময়ের দাবী নয় যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হোক? এই দাবী কি 'বিচার বাতিল কর' দাবীর চেয়ে অধিক যৌক্তিক ও বাস্তব সম্মত?
৬) আঁতাত তত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় দাবী হতে পারে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের, আমরা কি সেই দাবী করছি?
শাহবাগের প্রতিটি হৃদয়ের আবেগ, তার শক্তিকে যেনো কেউ বিপথগামী করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজন শক্তহাতে এই আন্দোলনের লাগাম ধরে রাখা, তার গন্তব্য ঠিক রাখা। শাহবাগের এই আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় আমরা যদি কিছু হিরো পাই, আমরা গভীর আগ্রহে সেইসব হিরোদের বুকে তুলে নিতে উন্মূখ, কিন্তু তার আগে এর গন্তব্য ঠিক করা জরুরী, অতি জরুরী।