প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব
'দি সানডে টাইমস' এর বক্তব্য
মার্চের শেষ দিক। পশ্চীম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী হাজার হাজার পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিককে সুপরিকল্পিত উপায়ে হত্যা করে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার যে এই সময় থেকেই সব খবর পরিবেশনের উপর সম্পূর্নভাবে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন তার পেছনে রয়েছে এই বীভৎস হত্যাকান্ডের প্রকৃত বাস্তবতা। এই একটি মাত্র কারনেই কলেরা আর দূর্ভিক্ষের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশী মানুষ দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে কারো জানার উপায় ছিল না। পাকিস্তানে অবস্থানকারী সানডে টাইমস - এর সংবাদদাতা এন্থনি ম্যাসকারেনহাস আজ সর্বপ্রথম এই ঘটনার ওপর আরোপিত কালো যবনিকা উন্মোচন করলেন। বিশ্ববাসী যথার্থ ঘটনা অবহিত হওয়ার সুযোগ পেলেন এইবার। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেখানে কি করছে, সবই সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে। দুনিয়াকে সেই অভিজ্ঞতা শোনানোর জন্য তিনি পাকিস্তান থেকে চলে এসেছেন চিরতরে।
সৈন্যবাহিনী শুধু মাত্র বাংলাদেশ অর্থাৎ স্বাধীন পূর্ব বাংলার ধ্যানধারনার অনুসারী ও সমর্থকদের খুন করে ক্ষান্ত হচ্ছে না। একই সংগে তারা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংগালীদের হত্যা করছে পাইকারীভাবে। হিন্দুদের ধরে গুলি করে ও রাইফেলের কুঁদো দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের একমাত্র অপরাধ তারা হিন্দু। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন থেকে বাস্তুত্যাগী, মিশনারী, এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিবর্গের কাছ থেকে পাওয়া পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর নৃশংসতার খন্ড খন্ড ছবি বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছুচ্ছে। তবে এসব তথ্য অসমর্থিত। আজকের দ্বাদশ থেকে চথুর্দশ পৃষ্ঠাব্যাপী "এন্থনি ম্যাসকারেনহাস" এর যে রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, সেটি তারই নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতার বর্ননা। এতে অতিশয়োক্তি নেই। নেই কোন প্রকার অসমর্থিত তথ্য। সত্যের আবরনে এই বিবরন অনবদ্য, অতূলনীয়। বাংলাদেশে যে করুন বিয়োগান্ত ঘটনা প্রবাহিত হচ্ছে তাই তিনি তুলে ধরেছেন। ভারতে পালিয়ে গিয়ে শরনার্থীদের আশ্রয় গ্রহনের পশ্চাতে যে রহস্য তা কারো জানার সুযোগ হয়নি, এই বিবরন সেই রহস্যও উদঘাটন করবে।
এন্থনি ম্যাসকারেনহাসের এই রিপোর্টের পেছনেও রয়েছে এক অভিনব ঘটনার সমারোহ।
মার্চ মাসের শেষ নাগাদ বাংগালী বিদ্রোহীদের সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য দুই ডিভিশন সৈন্য বিমান পথে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়। পাকিস্তানীরা এই তথ্য বেমালুম চেপে রেখেছিল। তবে এই ঘটনার প্রায় দু'সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার আটজন পাকিস্তানী সাংবাদিককে বিমান পথে পূর্ব পাকিস্তান সফরের জন্য আমন্ত্রন জানান। দেশের পূর্বের অর্ধাংশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বলে একটি অভয় চিত্র তুলে ধরে পশ্চীম পাকিস্তানীদের আশ্বস্ত করানোর দায়িত্ব এই সাংবাদিককের উপর ন্যাস্ত। সরকারী কর্মচারীরা ওদেরকে এই ধারনাই দিয়েছিলেন। সাত জন সাংবাদিক, তাদেরকে যেমনটি বলা হয়েছিল তেমনিভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন। একজনই ছিলেন ব্যাতিক্রম। তিনি করাচীর 'মর্নিং নিউজ' এর সহযোগী সম্পাদক এবং পাকিস্তানের 'সানডে টাইমস' এর সংবাদদাতা ম্যাসকারেনহাস।
মে মাসের ১৮ তারিখে তিনি অপ্রত্যাশীতভাবে লন্ডনে 'সানডে টাইমস' এর অফিসে এসে হাজির। আমাদের বললেন, একটি কাহিনী তিনি লিখতে চান। পঞ্চাশ লক্ষ লোক কেন পালিয়ে গেল? কি তাদেরকে স্বদেশের মাটি থেকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল তারই সত্যিকার ঘটনা সম্বলিত এ কাহিনী।
তিনি সোজাসুজি আমাদের বললেন, তার বিশ্বাস যদি তিনি এই মুহুর্তে এই কাহিনী প্রকাশ করেন তাহলে তার পক্ষে আর করাচীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি বললেন, এ কথা সত্যি তিনি পাকিস্তান থেকে চিরতরে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার নিজস্ব বাড়ি, স্থাবর অস্থাবর যা কিছু আছে আর পাকিস্তানের একজন সম্মানিত সাংবাদিকের পদ ইত্যাদী সব কিছুই তিনি ত্যাগ করার মনঃস্থির করেছেন। তার সংগে আমাদের একটি মাত্র শর্ত হলো তিনি করাচীতে ফিরে যাবেন এবং সেখান থেকে তার সহধর্মিনী আর পাঁচজন ছেলেমেয়ে নিয়ে লন্ডনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা তাঁর এই কাহিনী প্রকাশ করতে পারবো না।
'সানডে টাইমস' তার এই প্রস্তাবে সম্মত হন। আর ম্যাসকারেনহাস করাচী ফিরে যান। দশদিন অপেক্ষা করার পর সানডে টাইমস এর জনৈক কর্মকর্তার ব্যাক্তিগত ঠিকানায় সাগরপাড়ের একটি তারবার্তা পৌছালো।
তারবার্তাটিতে ছিলঃ "রফতানির আনুসংগিক ব্যাবস্থাদি সম্পন্ন হয়েছে। সোমবারে জাহাজ চালান শুরু হবে"।
ম্যাসকারেনহাস, তাঁর পরিবার আর ছেলেমেয়েদের দেশত্যাগের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তাকে দেশত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়। তবে এ কথা সত্য শেষ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করার একটা পন্থা পেয়ে গেলেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার শেষ পর্যায়ে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন, তথ্য দফতরের তার অতি পরিচিত জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসার থেকে অদূরে বিমানে উপবিষ্ট অবস্থায়। তাদের মধ্যে যাত্রী চলাচলের ব্যাবধান মাত্র। সেই অফিসার বিমান বন্দর থেকে একটি টেলিফোন করলেই তাঁর গ্রেফতার হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল।
যাই হোক, টেলিফোন হয় নি। গত মংগলবার তিনি লন্ডনে পৌছে গেছেন।
ম্যাসকারেনহাস পূর্ব পাকিস্তানে যা কিছু দেখেছেন তার সবটাই অত্যন্ত সতর্কতার সংগে এবং সকল ভাবাবেগের উর্ধ্বে থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি গোয়ার অধিবাসী এবং একজন খ্রীষ্টান। হিন্দুও নন; মুসলমানও তিনি নন। ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি পাকিস্তানী পাসপোর্টের অধিকারী হয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় পাকিস্তানেই কাটিয়েছেন, তখন থেকেই পাকিস্তানী অনেক নেতার গভীর আস্থা অর্জন করেন তিনি। তাই তার এই রিপোর্টটি তিনি যথার্থ ব্যাথাহত মন নিয়ে রচনা করেছেন।
"সৈন্যবাহিনী যে মহান কাজ করছে সেটিকে দেশাত্মবোধ দৃষ্টিভংগী থেকে তুলে ধরার জন্যে তথ্য দফতর আমাদেরকে বলে দিয়েছিলেন" জানালেন তিনি আমাদের।
তিনি কি দেখলেন সেটা তার নিজের কাগজে প্রকাশ করার কোন দায়িত্ব ছিল না। মে মাসের দুই তারিখে সানডে টাইমস এ প্রকাশিত একটি বিবরন পাঠানোর জন্য তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। এই বিবরনে ২৫শে/২৬শে মার্চ এর ঘটনাবলীর উল্লেখ ছিল। এই সময় বাংগালী সৈন্যগণও বিদ্রোহ করেন এবং অবাংগালীদের প্রতি তারা যে আচরন করেন তাও এই বিবরনীতে স্থান পায়।
দূর্ভিক্ষের একটা কালোছায়া পূর্ব বাংলার দিকে এগিয়ে আসছিল। সেটা তিনি উল্লেখে করেছিলেন। তবে সেন্সর সেটা কেটে বাদ দিয়ে দেয়। এতে করে তার বিবেক ভয়ানকভাবে নাড়া দেয়।
কয়েকদিন মনের সংগে বোঝাপড়া করেন। তারপর তিনি এমনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন সে 'হয় আমাকে যা দেখেছি তার পূর্ন বিবরন প্রকাশ করতে হবে অন্যথায় আমার কিছুই লেখা চলবে না। আর যদি না লিখি তবে কোনদিনই আমি নির্ভরতা নিয়ে ভবিষ্যতে লিখতে পারবো না'। তাই তিনি এক সময় একটি বিমানে চেপে লন্ডনে এসে পৌঁছান।
পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে পরিজ্ঞাত শরনার্থীদের কাছ থেকে আমরা সবিস্তারে তাঁর এই বিবরনটির বিষয়বস্তু ও বক্তব্য যাচাই করে দেখেছি। এই সংগে নিরপেক্ষ কূটনৈতিক সূত্র থেকেওএই বিবরন পরীক্ষিত।
১৩ই জুন ১৯৭১ এর 'সানডে টাইমস' এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম তিন কলাম ব্যাপী প্রস্তাবনায় ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্ট সম্পর্কে এই কথাগুলি লিপিবদ্ধ হয়। এ চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরই সারা বিশ্বে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ে ও তার বিরুদ্ধে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।