প্রথম পর্ব
গণ-হত্যা বন্ধ কর
অনেক বিবেচনা করেই শেষ পর্যন্ত ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার রবি-বাসরীয় ক্রোড়পত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অপর নিবন্ধ লেখার এক অনন্য পদক্ষেপ গ্রহন করা হল। এর সমর্থনে প্রথমতঃ বলা চলে এই প্রতিবেদন, পাকিস্থানের পূর্বাঞ্চল প্রদেশের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শাসক বর্গের অন্তর্নিহিত অভিপ্রায় ও গৃহীত ব্যাবস্থার প্রামান্য দলিল এবং বিশ্বস্ত-সুত্র সমর্থিত। দ্বিতীয়তঃ পূর্ব পাকিস্থানের ঘটনাপ্রবাহ খুবই ভয়াবহ আকার ধারন করেছে এবং লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্ত নিজেদের ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করছে, যাতে শেষ পর্যন্ত এসমস্ত ঘটনা প্রকাশের অপেক্ষা রাখে। বিশ্ব বিবেকের কাছে এ সমস্ত তথ্য তুলে ধরতে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা মারাত্বক ঝুঁকি নিয়েছেন। এমন কি পরিনামে তাঁকে পাকিস্তানে তার ঘরবাড়ি ও চাকুরির মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে। সংবাদবাতার ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা বর্তমান থাকলেও আমরা তার প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাই করতে কার্পণ্য করিনি।
সামরিক একনায়কত্বের বিলোপ সাধনের প্রশংসনীয় অভিপ্রায় নিয়ে গত সত্তরের শরৎকালে ইয়াহিয়া খান সারা পাকিস্তানে সাধারন নির্বাচন ঘোষনা করলেও মুলতঃ সাধারন নির্বাচনই সর্বনাশ ডেকে আনল। নির্বাচন বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী প্রেরনার স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত করলেও পরে বর্বর পশুশক্তি তা নির্বাপিত করে দিয়েছে। এরও বহু আগে ১৯৪৭ সালে দুই অসম জাতির সমন্বয় সাধন করে যে পাকিস্থানের জন্ম হল-তার জন্মলগ্নেই অনৈক্য ও বিবাদের বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছিলো। সেই তখন থেকেই আজ পর্যন্ত যুক্তিযুক্ত ভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে আসছে। পাকিস্তানের সার্বিক অর্থনৈতিক পুষ্টিসাধনে তাদের দান বেশী হলেও তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সমপর্যায়ভুক্ত নয় বলে মনে করে। ঘটনা প্রবাহের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বর্তমানের এই রক্তক্ষয়ী বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের মূলে অন্য কারন যা-ই থাকুক না কেন পূর্বাঞ্চলের অবাঙ্গালীদের প্রতি বাঙ্গালীরা যে প্রতিশোধ্মূলক আচরন প্রদর্শন করেছে তাতে করে বাঙ্গালীদেরও খানিকটা দ্বায়িত্ব আছে বৈকি।
অন্যদিকে, বিবেচনাপ্রসুত ও পূর্ব পরিকল্পনা নিয়েই যে কেন্দ্রীয় সরকার বাঙ্গালী নিধন যজ্ঞে মেতে উঠেছে- এ অমোঘ অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। অবস্থা আয়ত্বে এনে গণসরকার কায়েমের সুমহান অভিলাষ হয়ত ইয়াহিয়া খানের ছিলো-কিন্তু পূর্বাঞ্চলে যা ঘটে গেলো তাতে করে এর পরেও কি কেন্দ্রীয় সরকার দাবী করতে পারবে বাঙ্গালীরা তাদের ভাই এবং অভিন্ন পাকিস্থানের সমপর্যায়ভুক্ত অংশীদার। এখন পর্যন্ত সেখানে অবাধে গণহত্যা চলছে এবং কেন্দ্রের নির্দেশে সামরিক উৎপীড়নের মাধ্যমে বাঙ্গালীদেরকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নতি স্বীকার করার অপচেষ্টা চলছে। এদিকে আবার পাকিস্তান পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়েছে। আবেদন গ্রাহ্য কলে এ সাহায্যই পাকিস্তানের ঘৃণিত কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ-ভাবে সমর্থন যোগাবে। আবেদন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য হলেও দেখা যাবে লক্ষপ্রানের কল্পনাতীত দুর্গতি ছাড়াও পাকিস্তানের আর্থিক কাঠামো একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে।
যদিওবা অর্থ সাহায্য দিতেই হয় তবে সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক উপায় হলো বৃটেনসহ সমস্ত পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলিকে দেখতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে একটা নতুন কার্যকরী সমঝোতায় আসার জন্য ইয়াহিয়া খান কতটুকু আগ্রহী এবং তিনি তার সৈন্যাবাহিনীকে অত্যাচারের সীমা লঙ্ঘন করতে বিরত রাখার ব্যাপারে কতটুকু নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেন।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে সাহায্য বিতরনের কার্য প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলেও একথা অনস্বীকার্য পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং সে ইচ্ছা না করলে তাকে দিয়ে কোনো কিছু করতে বাধ্য করানো যাবে না। সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিমুহুর্তে পাকিস্থানের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের পুংখানুপুংখ প্রতিবেদন বিশ্ব বিবেকের কাছে যথাযাধ্য তুলে ধরতে পারলে ভালো হয়। বিশ্ব জনমতের চাপ পাকিস্তানের উপর প্রভাব বিস্তার করলেও করতে পারে।
বস্তুতঃ পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সমঝোতার মুল সূত্র কি হবে তা বলা দুস্কর হলেও এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে সীমান্ত অতিক্রান্ত উদ্বাস্তদের অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং হয়ত তারা আর স্বদেশে ফিরতে চাইবে না।
বর্তমানের এই নৃশংস যুদ্ধের কুয়াশার অন্তরালে একটা সত্য দিবালোকের মতই ভাস্বর-তা হল ইয়াহিয়া খা্নের ক্ষমাহীন ভ্রান্তি। আর সেই ভ্রান্তিই এশিয়া তথা সারা পৃ্থিবীতে হতাশা ও নৈরাজ্যের দুয়ার খুলে দিয়েছে। এশিয়া এখন মধ্যপ্রাচ্যের বর্ণবৈষম্য ও সীমান্তবিবাদীদের মতই নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। হয়ত অদুর ভবিষ্যতে এর জের টানতে গিয়ে এশিয়াবাসীদের দুর্বিপাক ডেকে আনবে এবং সারা পৃ্থিবীর উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়াবে।
১৩ই জুন, ১৯৭১ ‘সানডে টাইমস’
লন্ডন
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১১:৫৯