অলৌকিক-লৌকিক জুলফিকার
মেঙ্গে খেতে গিয়ে এক বোতল জমজমের পানি পাওয়ার পর থেকে হালিমন ফকিরনির মনে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি অঙ্কুরিত হয়। জমজম কূপের নাম তার জানা ছিল, সে জানত এর পানি পবিত্র। এর ঢের ঢের ফজিলত। কিন্তু কার কার নাম পেঁচিয়ে এর কাহিনী বৃক্ষ খাড়া হয়েছে, তা সে জানত না।
হজ্জ থেকে ফিরে ইয়াছিন হাজী জমজমের পানি বিলানোর সময় জমজমের জন্মের শাস্ত্র বয়ান করছিলেন। পেয়ারা গাছের নিচে বসে সেই পবিত্র পরেস্তা চাতকের তৃষায় শ্রবণেন্দ্রিয়ের গণ্ডূষ ভরে পান করতে করতে তন্ময়তার এভারেস্ট ছুঁলে তা পুণ্যতোয়া হয়ে হালিমনের দু’চোখ বেয়ে ঝড়তে লাগল। ঈদে পাওয়া জালের মত পাতলা নতুন শাড়ির রং চোখের জলের ধোপে টিকতে না পেরে তার ছেঁড়া-ময়লা ব্লাউজ, রোদে পোড়া লোলচর্ম জায়গায় জায়গায় রাঙ্গিয়ে তুলল। মাহফিল শেষে চোখ মুছতে মুছতে তিনটি খেজুর আর জমজম কূপের এক বোতল তোবারক নিয়ে প্রশান্ত মনে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে হালিমন বাড়ি ফিরল।
তার খুপরি ঘড়ের কোনে একই রকমের দুটি বোতল আছে। দিন কয়েক আগে বিনা দাওয়াতে বিয়ে খেয়ে উপঢৌকন হিসেবে দুইটি পানির বোতল কুড়িয়ে এনেছে। একটাতে কেরোসিন তেল রেখেছে, আর একটাতে জমজমের পানি। বোতল দু’টি তার কাছে যমজ যমজ ঠেকে। এরা যাতে মিশে না যায় সে জন্য কেরোসিনের বোতলের গলায় পাটের পৈতা ঝুলিয়ে একটা বামন চিহ্ন এঁটে দেয়।
বস্তির কারো চোখ উঠেছে, কারো পেট নেমেছে, কোনও পোয়াতির সাধারণ পেট ব্যথা বা প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে হালিমন পরম বিশ্বাসে বোতল থেকে এক কাক পানি তাদের আনা পানিতে মিশিয়ে দিয়ে খাবার নিয়ম বাতলে দেয়, যার যার সেমেস্যার আসান পাওয়ার নিয়েতে আঁজলায় করে এ পানি তিন ঢোকে খাতি হবি, খাবার আগে আল্লা শাফি, আল্লা কাফি, আল্লা মাফি কওয়া লাগবি। আরও নিয়ম মানতি হবি, এ পানি বসে খাওয়া যাবি লা, খাড়া হয়ে পশ্চিম তোরে মুখ করে তাজিমের সাথে খাতি হবি। খুব খেয়াল! এ পানি যিনি কারুর পায়ে না পড়ে। এ যেম্বা সেম্বা পানি লা। হুঁ! তারাও ভক্তিভরে সে পানি পান করে। এ ব্যাপারে অনেকে তাকে শ্রদ্ধা করে, কেউ কেউ তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে।
জবাবে সে বলে, এ হচ্চে গে আল্লার কুদরতি পানি, আল্লার কুদরতের সুরমান আল্লাই রককে করবি; ইয়ে লিয়ে মশকরা করা, কিদুরকি মারার কিচ্ছু নেই।
পানি নিতে আসা লোকেরা বলে আল্লার কুদরতি পানি লিয়ে ইয়েরকি মারলি আল্লা গোসা হতি পারে।
হয় আল্লার আর কোন কাম নেই এই বোতলের পানির হিসাব কিতাব খুলে বসে থাকপিনি।
এত কথার মাঝেও সে বোতলটা ভক্তি ভরে চুমু খেয়ে বুকের কাছে আগলে রাখে। ওযু গোসল পাক-পবিত্রতা ছাড়া সে বোতলে হাত লাগায় না।
বস্তিতে আগুন ধরে আগুন আগুন বলে চেঁচামেচি শুরু হলে চার দিক থেকে লোকজন ছুটে এসে উৎসুকের চাক বসিয়ে ঘিনঘিন করতে লাগল।
পাশের চারতলা বাড়ির খোকনের স্কুল পড়ুয়া ছেলে রাজু তার বাবাকে বলল, বাবা পানির পাম্পটা চালু করে ছাদ থেকে পাইপ দিয়ে পানি মারি তাহলে সহজেই আগুন নিভে যাবে।
ছোট লোকদের ময়লার আবর্জনার গাদা পুড়লে কিছু হবে না, বরং; পরিবেশ সুন্দর হবে।
বাবা আবর্জনা হোক আর যাই হোক ওটাই তো ওদের শেষ আশ্রয়।
ওদের সম্পদ বাঁচানোর চিন্তা মাথায় রাখলে তোমার সম্পদ ধরে রাখতে পারবে না। ওসব সস্তা আবেগ মাথায় থাকলে আমার আজ চারতলা হত না, হত খরের চালা। আরে মাষ্টার সাব আপনিও টেবিল ছেড়ে জানালায় দাঁড়িয়ে! যান ওকে নিয়ে পড়ার টেবিলে যান।
রাজু পড়ার টেবিলে গিয়ে বাবার এই অমানবিক আচরণে ফুলতে থাকে।
পর্দা টেনে দিয়ে খোকন নিবিষ্ট চিত্তে খবরের কাগজের শিরনামে চোখ রাখল-
লিবিয়ায় মানবতা লঙ্ঘনের জন্য গাদ্দাফী বাহিনীর বিরুদ্ধে ন্যাটোর এক যোগে চুয়াত্তর শত বিমান হামলায় ত্রিপলি ধ্বংসস্তূপে রূপান্তর।
ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার নৈতিকতা বিরোধী কাজ হবে।
-ওবামা
নিরপরাধ স্কুল ছাত্র লিমনের পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে RAB – এর গুলি চালানর ফলে তার পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে।
জ্বালানী তেলের মূল্য এক বছরে ৩ বার বৃদ্ধি - জন মনে অসন্তোষ।
খোকন সরকারী দল করার ফজিলতে মাদক থেকে শুরু করে নানা রকম চোরা কারবারি ও অসামাজিক কর্ম কাণ্ড করে সম্পদের এবং অত্যাচারের ঢিবি গড়েছে। বস্তি দখলের জন্য বস্তির দিকে সে চৌপর বছর ভর শকুন দৃষ্টি হানে, কিন্তু; স্থানীয় এক পাণ্ডার প্রতাপের আবেশে তার চুম্বক ক্ষেত্র বস্তির দিকে পরিধি বিস্তারে যুত করতে পারছে না। খোকনের জাহেরি, বাতেনি অত্যাচারের ঠেলায় এলাকার জনগণ অতিষ্ঠ, খোঁয়াড়ে পুরা গরুর মত অসহায়।
রাজনৈতিক দলের মিটিং-এর জন্য রাস্তার উপর মঞ্চ করায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্চ অতিক্রম করার অক্ষমতায় পেঁপুঁ, পেঁপুঁ, পেঁপুঁ করে কাঁদছে। দমকল বাহিনীর লোক আগুন নেভানোর সুযোগ না পেয়ে, দর্শকের সাথে মিশে দর্শকের সংখ্যাধিক্য ঘটাল।
প্রায় ৪০ ঘরের বস্তিতে একটাই মাত্র নলকূপ। নলকূপের আশপাশের ঘরগুলিতে আগুন যেন পরিকল্পিত ভাবে আগেভাগেই তার আধিপত্য বিস্তার করে গণ্ডি দিয়ে দিয়েছে, ফলে; কেউ নলকূপের পানি দিয়ে তার এই বস্তি-যজ্ঞে বাঁধা দিতে পারছে না । যার যার বালতি, কলস, জগে এমন কি গ্লাসে যতটুকু পানি ছিল তা তারা নিংড়বিয়ে আগুনের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছে। আগুনের অদম্য পিপাসার সময় অতি সামান্য জল সিঞ্চনের ফলে আগুন কিছুক্ষণ রাগে গোসায় ঝিম মেরে থেকে সে তার অগ্নিমূর্তিকে আরও দগদগে করে আশেপাশের অক্ষত ঘরগুলিকেও আক্রমণ করে তার রোষানলের বহি:প্রকাশ ঘটিয়ে গণ্ডি বিস্তার করতে লাগলো।
আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র চলে গেল তবুও এবার বৃষ্টির দেখা নেই। আশেপাশের খানা-খন্দ-পুকুর সব শুকিয়ে বাংগি ভাটা হয়ে গেছে। বস্তির আশপাশের বাড়িতে যে দু’একটি নলকূপ আছে সেগুলি আগেই নি:স্ব হয়ে বকের মত এক ঠ্যাং-এ ধ্যানস্থ হয়ে আল্লা মেঘ দে-পানি দে জিকির করছে।
হার না মানা পণ নিয়ে কিছু লোক অনেক দূর থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সময় এবং পানির অপ্রতুলতার সুযোগে আগুন তার যজ্ঞ-কর্মে ক্ষান্তি দেবার ব্যাপারে খুব একটা তোয়াক্কা করছে না।
আল্লার কুদরতে হালিমনের যে ফুটাহিন বিশ্বাস, সেই অনুপাতে আল্লা যে ওয়াক্তে ওয়াক্তে যেখানে সেখানে তাঁর অলৌকিকতা ফলান না; সে জ্ঞান হালিমনের নেই।
হালিমন এক হাতে লাঠি ভর দিয়ে আরেক হাতে জমজমের পানির বোতল নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে হাতের তালুতে পানি নিয়ে আগুনের দিকে ছিটাতে লাগল, কিন্তু; আগুনের তাপ এত তীব্র যে সে বেশি কাছে ঘেষতে পারল না। শেষমেশ পানির বোতলটাই আগুনের মাঝে চ্যাঙা দিয়ে চোখেমুখে একটা অলৌকিক বিশ্বাসের আভা ফুটিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। কিছুক্ষণ পরে অলৌকিক কিছু ঘটার আশায় চোখ খুলে দেখে আগুন না নিভে প্লাস্টিকের বোতলকে ঘিরে বিপুল উত্সাহে হল্লা করছে। জমজম পানির অলৌকিকতার নিষ্ক্রিয়তা দেখে হালিমনের মনে সাফা-মারওয়া শুরু হয়ে গেল। তার শাস-প্রশ্বাসের গতি মন্থর হয়ে গেল। তার অন্ধ বিশ্বাস আগুনের ওমে টোপে টোপে গলে পড়তে লাগল।
যারা আশেপাশে কাজে গিয়েছিল, তারা আগুন দেখে হন্যে হয়ে বস্তিতে হাজির হল। বস্তিবাসীরা তাদের শেষ সম্বল এবং ভরসাস্থল আগুনে পুড়ে নি:স্ব হবার চলচ্ছবি চাক্ষুষ করতে করতে বুক ফাটা কষ্টের যে কোরাস শুরু করল; তার ধ্বনি আগুনের ঊর্ধ্বমুখী ধোঁয়াকে পিছে ফেলে যখন আরশগামী হচ্ছে, তখন একটি শিশুর তীব্র-তীক্ষ্ণ চীৎকার রোল তাতে যতি চিহ্ন সেটে দিয়ে সকল কোলাহল ছাপিয়ে আকাশ চিঁড়ে ফেলার যো করল। রাজুর মা রাজুকে রেখে বাসাবাড়িতে কাজে গেছে, আগুনের তাপে ঘুম ভেঙ্গে সে চীৎকার করছে। তার জন্মের পর পরই বাবা আর একটি বিয়ে করে কোথায় বা চলে গেছে। রাজুর বয়স পাঁচ বছর।
আতঙ্কে ও আগুনের তাপে ঘরে বাইরে ছুটাছুটি করতে করতে রাজুর গায়ে আগুন লেগে গেল। অনেকেই মরিয়া হয়ে তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে গেল, কিন্তু আগুনের তাপে কেও তার কাছেই ঘেঁষতে পারল না।
হালিমন রাজুকে খুব ভালোবাসে। সে তাকে নানী ডাকে। হালিমনকে দেখে রাজু কাতর স্বরে চীৎকার করতে লাগল, এ নানী আমাক বাঁচা, এ নানী আমাক বাঁচা, এ নানী আমাক বাঁচা …। হালিমন কচি কণ্ঠের এই আকুতি উপেক্ষা করতে না পেরে তার বুড়ো নড়বড়ে শরীর নিয়ে বেপরোয়া ভাবে ছুটতে ছুটতে আগুনের বিপদ সীমার কাছে চলে গেল। অনেক কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করা হল। রাজু আগুনে পুড়ে কয়লা হবার আগেই বুড়ি অজ্ঞান হয়ে গেল।
খবর রটে গেল যে খোকনের কারসাজিতে বস্তিতে আগুন দেয়া হয়েছে। রাগে ক্ষোভে সবাই ফুঁসছে, কিন্তু সাহস ও দাহ্য-বস্তুর অভাবে তারা জ্বলে উঠতে পারছে না বলে শেষতক, অসহায় আক্রোশে ছোটাছুটি করতে লাগল।
যে জাহান্নামের আগুনকে ৭০ বার ধোয়ার পরে অনেকটা সহনীয় করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, হালিমনের মনের মধ্যে সেই জাহান্নামের আগুনের লকলকে উষ্মার তীব্রতা। তার মাথার মধ্যে পাগলা ঘণ্টার মত বেজে চলছে, এ নানী আমাক বাঁচা, এ নানী আমাক বাঁচা, এ নানী আমাক বাঁচা.....।
সে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে এক হাতে ঝাঁটার মত করে পাট খড়ি মুঠো করে ধরে আরেক হাতে দড়ি বাঁধা বোতল নিয়ে উড়িয়া ময়ূরক (ময়ূর) নৃত্যের মত থপ থপ করে এগতে লাগল। আবার তাকে আসতে দেখে ছেলেরা টিটকারি মারে, বুড়ি কী এবার ঝাঁটা পেটা করে আগুনের ভুত ছাড়াবে।
খোকনের বাড়ির নিচ তলায় গার্মেন্টসের ঝুটের গেঞ্জির কারখানা। কেরোসিন ছিটিয়ে ঝুটের গাদিতে আগুন দেয়ার সাথে সাথে আগুন ছড়িয়ে পড়লো। কেরোসিনের কার্যকারিতা দেখে হালিমন ফকিরনীর চোখ, মুখ আগুনের আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ..