প্রস্রাবে সেলিমের তলপেট টনটন করছে, প্রায় দুই মাইল পথ পাড়ি দিয়েও খালাস হবার কোনও পতিত জায়গা, কোনা-কাঞ্চি না পেয়ে বেজির মত আতিপাতি তাকিতুকি করছে। সে কিছুক্ষণ শাস বন্ধ করে কষ্ট চুরির চেষ্টা করে।
রাস্তায় মজনুর সাথে দেখা হতেই সে বলে, আরে সেলিম ভাই যে, বিদেশ থেকে কবে এলেন, শরীর খারাপ মনে হচ্ছে, আপনের এই দশা কেন?
আর বলো না, প্রেশার, ডায়াবেটিকস, হার্ট ব্লগ, কিডনির সমস্যা, নানান অসুখ একেবারে ব্যাড় দিয়ে ধরেছে। এখন সামান্য ল্যাঙেই কাত।
ঐ তো সামনেই আমার বাড়ি, আসেন একটু জিরিয়ে যান।
মজনুর বাড়িতে ঢুকেই সেলিম ইশারা করলে মজনু আঙ্গুল দিয়ে উঠানের ওপাড়ে উদ্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে দেয়।
ঘরে এসে সোফায় গতর এলিয়ে গোপাল ভাঁড়ের গল্পের রাজার বাহ্যে সুখের মত সুখের আমেজে সেলিম চোখ বুজে রইল।
চা খেতে খেতে সেলিম মজনুকে বলে, এ তল্লাটে কত দিন?
-দশ বছর।
জমি কত টুকু?
-চার কাঠা।
কত করে কিনে ছিলে?
-পাঁচ হাজার টাকা কাঠা।
এখন কত?
ঢেঁড়! পাঁচ লাখ টাকা কাঠা।
বল কি! এতো!
গত পাঁচ বছরে সোনা-চাঁদি, লেখা-পড়া, খাওয়া-দাওয়া, দেখা-শুনা, চলা-ফেরা নেশার মাল থেকে শুরু করে খোল-ভুষি পর্যন্ত সব জিনিষের দাম প্যাল প্যাল করে বাড়ছে। সব চে বেড়েছে জমির দাম। বর্ষার পানির সোহাগে যেমন প্রহরে প্রহরে আমন ধান বাড়ে, জমির দাম তার চেয়েও কয়েক নল বাড়। যাকে বলে, টাকায় শতেক বাড়।
এই বৃদ্ধির কারণ কি?
কারণ আবার কি, ভারত বর্ষ এক থাকলে বাঙ্গালী ছাই গুষ্টি নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে পারত। বসতি অনেক পাতলা পাতলাই থাকত। আর এখন ভারত ভাগ হয়ে বাংলাদেশের লোক মাছের মত ব্যাড় জালে আটকা পড়ে গিজ গিজ করছে। এত মানুষ মিলে অক্তে অক্তে যে হারে বিয়ানর বাইচ লাগিয়েছে, তাতে জমি কমতে কমতে চাঁদিত ঠ্যাকার জো। এখনি মুতার জাগার আকাল পড়ে গিয়েছে, কয় দিন পর ছ্যাপ ফ্যালানর জাগা মিলাই দায় হবে। জাগা অসম্ভবে বাপ ব্যাটার জন্য, ভাই ভাইর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাথায় বাড়ি মারছে।
তা ঠিক। তোমরা তো নিজের বাড়ি বানাতে পেরেছ, আমি তো পনের বছর বিদেশ খাটার পরেও ভাড়া বাড়ির খোয়ারেই আটকে আছি।
এই এলাকার এখন ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছ। দাদার কাছে শুনেছি নূরপুরে কবি বন্দে আলীর বাড়ীর মোড়ে দাঁড়ালে বাজিতপুর ঘাটের জাহাজ দেখা যেত। গোয়ালন্দ, নাজিরগঞ্জ, কুস্টিয়া, সারা/পাকশি, বিহারের পাটনা রুটে এই বাজিতপুর ঘাট হয়ে জাহাজ যাতায়াত করত। এই ঘাটে যাত্রা বিরতির সময় রবীন্দ্রনাথ আর বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু আড্ডা দিয়েছিলেন। কবি বন্দে আলী রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে পড়াকালীন সময়ে এবং ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কোলকাতায় আর্ট স্কুলে পড়ার সময় ছুটিতে যখন পাবনায় আসতেন, তখন আমার দাদার সাথে ও তাঁর বয়সী ছেলেদের সাথে নয়না মতির ফাঁকা চরে ঘুরে বেড়াতেন। এই চরে তখন জায়গায় জায়গায় বন ছিল, সবে দুই এক ঘর বসতি শুরু হয়েছে। তেমন ফসল হত না। কিছু জমিতে আউশ ধান হত, আর শীতের সময় খেসারী চাষ করত গোরুকে খাওয়ানর জন্য। তিনি এই চর, চরের কলমি ফুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার একটা বই আছে ‘ময়নামতির চর’। এই নয়না মতি নিয়েই সেই বই লেখা হয়েছে। প্রকাশক তাঁর অনুমতি নিয়েই নয়না মতির বদলে ময়নামতি করেছিলেন। কেন যে উনি এই পরিবর্তনে রাজি হয়েছিলেন?
ময়নামতি কাব্যগ্রন্থে চৈত্র সংক্রান্তির যে মেলার কথা বলা হয়েছে সেটা হত চক পৈলানপুর (নয়না মতি) প্রাইমারী স্কুলের পূব দিকের আইল ঘেঁষে সোজা উত্তরের বাসের দোকানদারের বট তলার মসজিদ পর্যন্ত। বাসের দোকানদারের বট গাছের সাথে এবং আক্কেলের সাঁকোর পূর্ব-দক্ষিণ কোনের ঐ জায়গায় যে বট গাছ ছিল সে দুটিকে এই অনুষ্ঠানে তেল সিঁদুর দিয়ে বিয়ে দেয়া হত।
স্বাধীনের পরেও জিন্নাহ পার্ক, যেটা এখন পাবনা আমিন উদ্দিন স্টেডিয়াম, সেখান থেকে চাঁদমারির মাটির যে ঢিবি ছিল তার পূব দিয়ে তাকালে বালিয়া হালটের ব্রিজ দেখা যেত। এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এই মাঠ সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল। সেই মাঠে আস্তে আস্তে বসত গাড়তে গাড়তে কলমি ঝাড়ের অবস্থা হয়ে গেছে।
আমার বাপ দাদারা এই এলাকায় বাঘ, বাগডাসা, ফেউ, শুয়োর, শজারু,খরগোশ দেখেছে। ইংরেজরা স্থানীয় জমিদারদের সাথে করে এই নয়না মতির চরে, আফরি, পাটকে বাড়ির ঝোড়, জাতায় ঘোড়ায় চড়ে শূয়র শিকার করত। শিকারের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সেই সব শিকারের ছবিও আঁকত।
এই মাঠের বুক চিরে পদ্মার একটা খাল ছিল। এটা কুটি পাড়ার ভেতর দিয়ে আটুয়ার রউফ খাঁর সাঁকো হয়ে চক ছাতিয়ানীর কাসেম মালতের সাঁকোর নিচ দিয়ে চাঁদমারির সাকো হয়ে তোমার এই বাড়ির জমির উপর দিয়ে আক্কেলের সাঁকো হয়ে বালিয়া হালটের ব্রিজের তল ছুঁয়ে ঝপঝপের বিল, চিকনাই নদী, আরো জলাশয়ে মিশে এ গাঁও সে গাঁও মেরে নানা খানাখন্দ জলা পাড়ি দিয়ে যমুনায় গিয়ে মিশে সুজানগরের ঢালার চরের দক্ষিণে গিয়ে আবার তার মা পদ্মার সাথে মিশে পুনর্জন্ম লাভ করত। দুই নদীর সেই সঙ্গম স্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান আছে, “ডাকব না ডাকব না/ অমন করে বাইরে থেকে ডাকব না/.... গঙ্গা ধারা মিশবে নাকি কালো যমুনাতে”। সেই খালের পানিতে আমি ৪ বছর বয়সে সাঁতার শিখেছি, সকাল থেকে সন্ধে ইস্তক যতবার সুযোগ পেয়েছি ততবারই ঝাপাঝাপি করেছি, কত মাছ মেরেছি, কলা গাছের ভুর চালিয়েছি। বর্ষার পানির তোর সামলাতে না পেরে সেই খাল ভেসে যেত। বান ডাকলে বানের পানি এই তল্লাটের পুরা মাঠ ইজারা নিয়ে বিলের রূপ নিত, আর চোত, বোশেখে সারা মাঠ-ঘাট, খাল বাংগি ফাটা হয়ে আসমান মুখি হয়ে চাতক তৃষায় পড়ে থাকত। ১৯৭৯সালে সার্কিট হাউসের উত্তরে এই খালের উপর পানি-উন্নয়ন বোর্ডের অফিস করে খালের গলায় ফাঁস লাগায়, ১৯৮৪ সালে পানি-উন্নয়ন বোর্ড পানির উন্নতির নামে পদ্মার কোল ঘেঁষে বাঁধের ফাঁদ পেতে পদ্মার আর আর সব শাখা নদী ও খালের সাথে সেই খালটাকেও খালের ভাগাড়ে গোর দেয়। আমার শৈশব কৈশোরের স্মৃতির গোরও ঐ ভাগাড়ে।
মজনুর বাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে বাড়ির পিছে একটা শিমুল গাছের দিকে চোখ যেতেই সেলিম কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
কি হয়েছে জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেলিম খাদে নামানো কণ্ঠে একটু ভূমিকা করে বলা শুরু করল-
বাড়ির পিছে যে শিমুল গাছ ওর একটা স্মৃতি আছে। সেই কথা মনে পড়তেই শরীর মন কেমন যেন হয়ে গেল।
নয়না মতি গাঁয়ে শাল গাড়িয়া থেকে দুলাল নামে একটা ছেলে আসত। একাত্তরের যুদ্ধে তার বাবা শহীদ হন। ছয় পেটের হেঁসেলে আকাল নিত্য হানা দিতে লাগল। তার পরিবারের সদস্যরা খিধের জ্বালায় নিজের পেটের কাছেই পরাধীন হয়ে গেল- সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে। খিধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে দুলাল মাঝে মাঝে নয়না মতিতে পাড়ি জমায়। এখানে তার নানীর বাড়ি। ছোট মেয়েকে নিয়ে নানী একটা কুঁড়েয় কোন রকমে মাথা গুঁজে থাকে।
দিন মজুরের বাঁধা কাজ দুলালকে দিয়ে কেও করায় না। তার কাজ হল ব্যাগার খাটা। নারকেল-সুপারি, আম-জাম পারতে হবে দুলালকে ডাক, ধান-গম-ঘান ভাঙ্গাতে হবে দুলালকে খোঁজ, চকে পাইট-পোরেতের পান্তা পাঠাতে হবে দুলাল আছে। নানা রকম ফুট ফরমায়েশ, ছুটা কামে দুলালকেই সবার আগ পছন্দ, কারণ; বিনিময়ে এক পেটা, আধ পেটা খাবার, দুই একটা ফল-মূল, ক্ষেত্র-বিশেষে দুই একটা টাকা হাতে গুঁজে দাও, দুলাল তাতেই সই।
তার চলন বলন গৃহস্থ বাড়িতে পোষ মানা লেজ দোলানে পশুর মত বিশ্বস্ত, সে কখনো চুরি করে না, অকাম করে না। তাই গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে মহলে বেগার খাটার ব্যাপারে তার ঢের কদর।
দিন রাত হুক্কা মেরে বেড়ানো ছেলেপেলের কাছে, ফাজলামি আর ত্যাঁদড়ামি করার পাত্র হিসেবেও দুলালের বাড়তি দর। এক জন মানুষ চেয়ারে বসলে যতটুকু দেখায়, দুলাল প্রায় ততটুকু লম্বা। মহিষ কাল ত্বক, কটা রঙের চুল, বেটে গোছের ছেলেটাকে খচ্চর ছেলেরা ‘খেকশিয়েল’ বলে ডাকে। ওদের দলের পালের গোদা পল্টু। তারা ওর লুঙ্গি খুলে গাছে ঝুলিয়ে রাখে, জোর করে মাথার খানিক অংশ বিনে খরচায় টাক করে দেয়, হাগার-পাগারের নোদ-কাদা তার আস্ত উদোম গা-গতরে লেপে শিব ঠাকুর বানিয়ে রোদে দাঁড় করে রাখে, দুই জন দুই দিক থেকে হাত-পা ধরে চ্যাং দোলা করে দোলাতে দোলাতে পচা মাঠেলের পানিতে ছুঁড়ে দেয়, এ খেকশিয়েল গেলরে, খেকশিয়েল, ধর ধর বলে কুকুর লেলিয়ে দেয়।
মাঠে মাঠে যখন ধান, গম, ছোলা, মসুর, কলাই কাটা হয়, তখন দুলাল পড়ে থাকা ফসল কুড়ায়, গর্ত খুঁড়ে ইঁদুরের গোলা ঘরে হানা দিয়ে, হাংটে হাংটে ফসল বের করে জায়গায় জায়গায় হালা করে রাখে। দিন শেষে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেরা, তার উঞ্ছবৃত্তির আধার কেড়ে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ঝলসান দানা খুঁটে খুঁটে খেয়ে, চোখে-মুখে গা-গতরে কালি-ঝুলি মাখিয়ে হোরা উৎসব করে।
তারা যে দিন খোশমেজাজে থাকে সে দিন উৎপাতের তোড় একটুখানি লঘু হয়। সেদিন তারা ওকে দিয়ে খ্যাকশিয়ালের প্রচলিত ছড়া-
খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাখ খ্যাঁক
জার লাগেছে খ্যাতা কিনে দে
কাল কেনবো খ্যাতা আজকে প্যাঁচা যাতা ।।।
তিন বার কওয়ায়ে ছেড়ে দেয়।
এরকম নানান বাহানায় তারা দুলালের জানটা জলোবলো করে, নিত্যি নিত্যি নতুন নতুন তামাশা চেখে বেড়ায়। দশজনের সাথে মিলমিশ করে কোনও অমোদ ভাগ বাটরা করার ফাঁক ফুঁকোট তো তার নেইই, বরং; সে হলো বারোয়ারী তামাশার গুলডাং। কোনও জটলা ওকে ঘিরে জট পাকানের আগেই ও সটকে পড়ে। হাচড়পাচড় করে জান বাঁচানের চেষ্টা চালায়। কখনো কখনো বিপদের আগাম গন্ধ পেয়ে ঝোপ-ঝাড়ে ঢুকে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। এত সাবধানের পরেও তারা সুযোগ পেলে তাকে ঠিকই ট্যাংলায়।
পল্টু দলে-বলে পাখী, সাপ, বেজি, শিয়াল মেরে, রস চুরি, ফল চুরি করে মাঠে-ঘাটে হুক্কা মেরে বেড়ায়। লোক জনের আনাগোনা কম থাকায় দিন দুপুরে মাঝে মধ্যেই দুই একটা শিয়াল গাওয়ালে বের হয়। এক দিন এক মা শিয়াল তার একটা কালচে বাচ্চা মুখে করে বসত পাল্টানর সময় পল্টু বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে বেতের ঝোপে পালিয়ে রক্ষা পায়। কিছুক্ষণ বাদে আর এক রিফুজি শিয়াল চক ছাতিয়ানী গোরস্থান থেকে বের হয়ে মাঠ পাড়ি দিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখে পল্টুর চেকপোস্টের সামনে পড়ে। ধাওয়া শুরু করলে শিয়াল বাঁশঝাড়ে পালায়, কুকুরের আর মানুষের আক্রমণের ঠ্যালায় সে বাঁশঝাড় থেকে বের হয়ে আবার দৌড় লাগায়।
বয়সের তাড়নায় শিয়াল ধাওয়ানর লোভ সামলাতে না পেরে আমিও কলেজে যাওয়া বাদ দিয়ে পথের মধ্যে তাদের সাথে ভিড়ে যাই। একটা কুকুর লেজ কামড়ে কয়েক হাত ছ্যাঁচড়ায়ে গিয়ে জুত করতে না পেরে ছেড়ে দেয়। সবাই চিল্লায়ে ওঠে, এহ্ পাদে দেছেরে পাদে দেছে, শিয়েল পাদলে কুত্তে গন্দো সহ্য করবের পারে না, পলায়।
এই ভাবে ইট-পাটকেল-ঢিল খেয়ে, আর কুকুরের কুত্তামোর চোটে পলান টুকটুক খেলতে খেলতে বাঁশ ঝাড়, কলার ঝাড়, বিষ কাটালি, পাতেল, ভাঁটের ঝোপ, গম ক্ষেত, বাড়ির উঠোন, কোনা-কাঞ্চি খচে নয়না মতি পাড়ি দিয়ে, রাধানগর বাগান পাড়ায় গিয়ে শিয়াল হারিয়ে গেল।
কান্নার শব্দে তাকিয়ে দেখি একটি ছেলে আর দুইটি মেয়ে বাড়ি যাব, বাড়ি যাব বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। তাদের সাথে আরও কিছু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে এসেছে। কয়েক জনের হাটার শক্তি নেই, পা ছড়ে রক্ত পড়ছে। আমাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে দায়িত্ব দেয়া হল তাদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার।
এলাকা বদলের সাথে সাথে লোকও বদল হচ্ছে, কুকুরও বদল হচ্ছে, কিন্তু; পল্টু বাহিনী যমদূতের মত হন্যে হয়ে শিয়ালের পিছে লেগেই আছে। আপন আপন এলাকার বাসিন্দাদের ছোপ-ঝাড় তোলপাড়ের ঠ্যালায় ও কুকুরের গোয়েন্দাগিরির চোটে শিয়ালের পালিয়ে থাকা বেশিক্ষণ থৈ পেল না। আবার ছুট। শেষ তক শিয়াল হয়রাণ হয়ে নূরপুর বি.এ.ডি.শি অফিসের দেয়ালের কোল ঘেঁষে একাই টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। যমদূতদের অবস্থা তখন চালু হাপরের মত।
শিয়ালের পায়ে শুকনা কলার ফাঁতর বেঁধে টানতে টানতে এলাকার দিকে রওনা দিলাম।
কৌতূহলী নানা বয়সী ছেলে মেয়ে কোলাহল করতে করতে শিয়ালের পিছু পিছু আসছে। তারা নানা মন্তব্য করছে। কেউ বা একটু ছুঁয়ে দেখছে। কেউ বা এডভেঞ্চারের স্মারক হিসেবে লোম ছিঁড়ে নিচ্ছে। কেউ আবার বন্দী শিয়ালের উপর ঢিল ছুঁড়ে বন্য আনন্দ পাচ্ছে।
জ্যান্ত শিয়াল পাকড়াও করার কৃতিত্বের জেল্লা সকলের চোখে মুখে খেলা করছে। আমাদের অভিযানের কাহিনীর স্বরলিপি শুনতে শুনতে, পিছু নেয়া ছেলে মেয়েরা আমদের ছুঁয়াচ লেগে খুশিতে টগবগ করতে করতে এগুতে লাগল।
দেশে তখন সবে ইরি ধানের আবাদ শুরু হয়ছে। এই মাঠে তখন সেচের জন্য ডিপ টিউবওয়েল বসেছে। এই মাঠে এসে পৌঁছানের পর শিয়ালের যখন দশমী দশা উপস্থিত, তখন আমাদের নবমী দশা।
শিয়াল রেখে সবাই ডিপ টিউবওয়েলের নালা দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা পানিতে গা ভাসিয়ে দিল। চৈত্রের রোদে তেতে উঠা অল্প পানিতে আটকা পড়া মাছের মত সবাই খাবি খেতে লাগল।
আমি পানিতে না নেমে একটা বাবলা গাছের ছায়ায় কোন মত শুয়ে পড়ে অবসন্ন দেহে হাপর চালাতে লাগলাম।
চৈত্রের খরায় আসমান জমিন যেন নেশায় ঝিম মেরে আছে। একটা মেঠো গন্ধ মাঝে মাঝে নাকে এসে লাগছে। সূর্যের গৃহিণীপনায় মাটির বুকের লুকান পানি বাষ্প হয়ে ধু ধু ঢেউ তুলে- আবার পানি হয়ে মাটির বুকে ফিরে আসার বাসনায় নভোচারী হচ্ছে। আকাশে এক চিমটি মেঘও নেই; দেনা পাওনার হিসেব মেলাতে হয়তো তারা হিমালয়ে গেছে। মেঘমুক্ত আকাশের কোলে কিছুক্ষণ আগে চলে যাওয়া আকাশ যানের ছেড়ে যাওয়া সাদা লেজের মত ধোঁয়ার অবশেষ লেগে আছে; আস্তে আস্তে তা ফিকে হয়ে আসছে। মাঠের ওপারের ঝোপে একটা ঘুঘু পাখি বিরহ রাগিণী গাইতে গাইতে কি মনে করে থেমে গেল। দূরে চাষির লাঙ্গল বাওয়ার সময় গরুকে নির্দেশ দেয়া ডানে ডানে, বায় বায় অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে। একটা ফিঙে পাখি গরুর পিঠে সওয়ার হয়ে রাজ্য রাজ্য খেলছে। বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে বিন্দুর মত কয়েকটি শকুন ভাগাড়ের খোঁজে নিচের দিকে মুখ করে পাক খাচ্ছে। আর নিচের স্তরে অত বড় শূন্য .ফাঁকা জায়গা একটা চিল একাই দখল করে আহ্লাদী মেয়ে যেমন থেমে থেমে কান্না করে, সেই রকম- ফ্যা, ফ্যা তীক্ষ্ণ চিৎকারে নিস্তব্ধতাকে চিরে ফেলছে। আকাশ কিসের যেন আভাস পেয়ে দিগন্তে স্তব্ধ হয়ে কান পেতে আছে। নিসর্গের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে চোখ যখন মুদে আসছে তখন সবার খেয়াল হতেই দেখা গেল শিয়াল নেই।
হয়রানি না কমতেই পেরেশানি বেড়ে গেল। শিয়েল গেল কই, শিয়েল গেল কই, বলতে বলতে সবাই হন্যে হয়ে খোঁজ-কাতুরি হয়ে উঠল। আমি তখনো ধকল কাটাতে না পেরে শুয়েই আছি।
মাঠের অর্ধেকের বেশী জমির ফসল কাটার পরে ইরি ধানের আবাদের জন্য কিছু জমি পানি দিয়ে পাকানো হচ্ছে, কিছু জমি চষা শেষ, কিছুতে লাঙ্গল চলছে, বাকী জমিতে গম কাটা হচ্ছে। আশপাশের গম ক্ষেতে শিয়াল খোঁজা হচ্ছে, আর মাঝে মধ্যে ঢিল মারছে।
কয়েক আইল .ফাঁকে গম নড়ে উঠতে দেখে একজন চিল্লান শুরু করল, ঐ দ্যাখ গম লড়তেছে, গম লড়তেছে। দশ পনের জন গম ক্ষেতটাকে ঘিরে, চষা জমি থেকে ছোট, বড় শুকনো মাটির চাঁই বৃষ্টির মত ছুঁড়তে লাগল। উত্তেজনার উস্কানিতে সংক্রামিত হয়ে আমিও গিয়ে ঢিল ছুঁড়তে লাগলাম।. গোঙানির শব্দ শুনে, কাম ফতে কাম ফতে বলে, হৈ হৈ করে কয়েক জন ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে গেল। হায় আল্লা! খেকশিয়েল! বলেই এক জন আতঙ্কে থমকে গেল।
আমি দৌড়ে গম ক্ষেতে ঢুকে দেখি দুলাল। তার চোক-মুখ, নাক-কান দিয়ে রক্তের বান ছুটছে; আমি তাকে খুব স্নেহ করতাম। আমাকে দেখে সে তার ঘোর বিপদের সময় আশ্বস্ত হয়ে জড়িয়ে ধরল। সে দমে দমে মা মা করে কাতরাতে লাগল। ওকে কোলে করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে দৌড় লাগালাম। পানি খেতে চাচ্ছে দেখে ওকে ঐ শিমুল গাছের ছায়ায় নামিয়ে কোলে মাথা রেখে শোয়াই। এক জন নালা থেকে গামছা ভিজিয়ে আনল, গামছা চিপে তার মুখে পানি দিলাম। দুলাল কি যেন বলতে চাচ্ছে দেখে মাথা নিচু করলাম। সলতের সর্বাঙ্গ নিংড়িয়ে জোগাড় করা শেষ বিন্দু তেলে, হাচড়পাচড় করে জ্বলবার প্রয়াসরত বাতির মত, বুকে একটু বাতাস টানার চেষ্টা করে অতি কষ্টে সে উচ্চারণ করল, সেলিম ভাই খেলা শে-এ-ষ।