সেই ২০০৪ সালের কথা। ২৭ বছরের যুবকটি এমআইটি থেকে মাত্র পড়াশোনা শেষ করে চাকুরীতে ঢুকেছেন। সারাদিন অফিস করেন- গবেষণা করেন। কিন্তু কেমন যেন একঘেয়েমি জীবন। বিয়ে করে বোস্টন শহরে ঘর বাঁধলেন। কিছুতেই পরিপূর্ণ স্বস্তি পাচ্ছেন না। সৃজনশীল মন শুধু ভেবেই চলে - নতুন কি করা যায়।
একদিন মামার মুখে শুনলেন মামাতো বোন নাদিয়া গণিতে নাকি খুব কাঁচা। গণিতপ্রেমী এই যুবক বোনের গণিতের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই নিয়ে নিলেন। নাদিয়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলেন, অঙ্ক কষে সময় নষ্ট করার চেয়ে অন্য কাজে সময় ব্যয় করতেই ভালো লাগে নাদিয়ার। গণিতের প্রতি অনাগ্রহের আরেকটা কারণ পাঠদান প্রক্রিয়া। অনেক ভেবে ভেবে গণিত শেখানোর নতুন নতুন কৌশল বের করলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে ফল দেখতে পেলেন । নাদিয়া গণিতে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠেছে। দেখা গেল অন্য কাজ ফেলে সারাদিন গণিতেই নিবিষ্ট নাদিয়া। এরই মধ্যে মামা সপরিবারে অন্য শহরে চলে গেলেন। কিন্তু নাদিয়ার গণিত শিক্ষা থামল না। যুবকটি টেলিফোনে - ইয়াহু ডুডল সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাঠদান চালাতে থাকলেন। বিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করা শুরু করল নাদিয়া। নাদিয়ার সঙ্গে তাঁর দুই ভাই আরমান ও আলীকেও পড়ানো শুরু করলেন। পুরো ব্যাপারটা করে যাচ্ছিলেন নেশার মত। কিন্তু হঠাত করে দেখলেন টাইম মিলছে না। তিনি হয়তো চাকুরী থেকে ফিরলেন, ভাইবোন সব ব্যস্ত অন্য কাজে। আবার একই পাঠ অনেক সময় একবারের বেশী দিতে হচ্ছে। ভেবে ভেবে নতুন সমাধান বের করলেন। ভিডিও তৈরি করলেন। আপলোড দিলেন ইউটিউবে। এর মাধ্যমে সহজেই নাদিয়া ও তার দুই ভাই বাড়ীতে বসেই গণিতের লেসন গুলো পেয়ে যাবে। কিছুদিন পর লক্ষ্য করলেন, শুধু তার ভাইবোন না অনেকেই তার ভিডিও দেখা শুরু করেছে। অল্পদিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে গেলেন তিনি। এই জনপ্রিয়তা এতই বাড়ল যে, এক পর্যায়ে তিনি এক দুঃসাহসীক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। নটা-পাঁচটার নিয়মিত চাকরী ছেড়ে দিয়ে অনলাইন ফ্রি টিউটোরিয়াল বানানোকেই ফুলটাইম কাজ হিসেবে নিয়ে নিলেন। নিয়মিত কিছুকিছু করে তৈরি করতে করতে আজ পর্যন্ত ১৮০০+ টিউটোরিয়াল একদম একাএকাই তৈরি করে ফেললেন। প্রতিষ্ঠা করলেন "খান একাডেমী"।
সালমান আমির খান
সালমান আমির খান
হ্যাঁ আমি খান একাডেমী এর প্রতিষ্ঠাতা সালমান আমির খানের কথাই বলছিলাম। ৩ ভাইবোনের জন্য তৈরি পাঠদানের পদ্ধতি আজ কেবল ইউটিউবেই ১৩ লক্ষ মানুষ সাবস্ক্রাইব করে নিয়মিত দেখছে। ২০১৩ এর মে মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী খান একাডেমীর ভিডিওগুলো ইউটিউবে মোট ৩০ কোটিবার দেখা হয়ে গেছে। শুধু গণিত নয়,ইতিহাস, স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা, জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, অর্থনীতি, ফিন্যান্স, ইত্যাদি বিষয়ের উপর ৪৫০০ এর বেশী মাইক্রো লেকচার বিনামূল্যে ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে।
ভিডিওগুলির ব্যাপারে বলতে গেলে, প্রথমত কোন ঝকমকা এনিমেশন নাই, গ্রাফিক্সের বলিহারি নাই, দিব্যি কালো একটা স্ক্রীন তার মাঝে কিছুক্ষণ পরে পরে কাঁচা হাতে আঁকিবুকি হচ্ছে আর কেউ একজন ঘ্যানঘ্যান করে অডিওতে কথা বলছে। প্রশ্ন হল এইখানে ম্যাজিকটা কোথায়? একটু ফিরে যান আপনার ছোটবেলায় স্কুলের দিনগুলিতে। আমার বিশ্বাস প্রত্যেকেরই অভিজ্ঞতা আছে নিজের বড়ভাই, পাড়ার বড়ভাই বা পাশের বিল্ডিং এর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া যিনি আপনার পড়াশোনার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো ও সমস্যা সমাধানের মৌলিক আগ্রহ জাগানোর জন্য অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ভিডিওর ধরণটাও অনেকটা তেমনই। শুনলে মনেই হবেনা যে ক্লাস করছেন, মনে হবে এই সাধারণ একটা জিনিষ কেউ একজন আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। যিনি বোঝাচ্ছেন, তিনি নিজেও আপনার চেয়ে মহা আঁতেল কেউ না, বরং ভাবখানা যেন আমিও গত সপ্তাহেই শিখেছি ব্যাপারটা, ভূলে যাবার আগেই তোমারে একটু শিখায়ে দেই। খুব সীমিত দৈর্ঘের (৩-৭ মিনিট) এই ভিডিওগুলোতে যেকোন বয়সের শিক্ষার্থীর জন্য একদম ডুবে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই টের পাবার আগেই দেখা যাচ্ছে উল্লেখিত ক্লাসের বিষয়টি শিক্ষার্থী শিখে ফেলছে। আর এই অদ্ভূত অভিজ্ঞতা একজন, দুইজন না বরং আমেরিকা ও সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর এখন। উঁচু বেতনের অফিস ফেলে গোঁয়ারের মত লেগে থাকার ফলে সালমান খান বর্তমানে আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে একজন প্লাস রীতিমত সেলিব্রিটি
ভাবতে ভালো লাগে এই মহান শিক্ষকের বাবা আমাদের দেশের বরিশালেরই মানুষ। বাবা ফখরুল আমিন খান পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। দাদা আবদুুল ওয়াহাব ছিলেন ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার। সালমানের বাবা বিয়ের পর পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই ১৯৭৭ সালে লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্স শহরে সালমান জন্মগ্রহণ করেন, সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। মেধাবী সালমান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব আইটি (এমআইটি) থেকে গণিত এবং তড়িৎকৌশল ও কম্পিউটার—এ দুই বিষয়ের ওপর স্নাতক করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎকৌশলের ওপর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন সালমান। অতঃপর এমবিএ করেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে।
খান একাডেমী প্রতিষ্ঠার সময় যখন সালমানের বন্ধুদের সামনে তিনি পুরো পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করেছিলেন, তখন প্রথম যে প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়েছিলেন তা হলো, এই সাইট থেকে তিনি কীভাবে অর্থ উপার্জন করবেন। উত্তরে দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে তিনি বলেছিলেন, এর থেকে আয় করার প্রয়োজন নেই তাঁর। সালমানের মতে, খান একাডেমির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সবাইকে বিভিন্ন বিষয়ের মৌলিক সব ধারণা পেতে সহায়তা করা। তিনি ইচ্ছে করলেই তাঁর ভিডিওগুলো কিংবা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে চড়া মূল্যে বিক্রি করে দিতে পারতেন, একাধিকবার এমন প্রস্তাবও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু না, তিনি সে পথে হাঁটেননি। জ্ঞানকে ব্যবসার পুঁজিতে পরিণত না করে তিনি বিনা মূল্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা পৃথিবীতে, শিশু থেকে বৃদ্ধ—জ্ঞানপিপাসী সব মানুষের মাঝে।
ভালো কাজের জন্য অর্থ কোন সমস্যা না। প্রথম দিকে ভিডিও গুলো নিজেই নিজের খরচে তৈরি করতেন। ২০১০ সালের মে মাস থেকে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তার এই প্রজেক্টে এগিয়ে আসে। ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান আসতে থাকল। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গুগল তাদের প্রজেক্ট টেন টু দ্য হান্ড্রেড-এ খান একাডেমীকে ৫ টি প্রজেক্টের একটি হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করে ও ২ মিলিয়ন ডলার দেয় যাতে খান একাডেমী আরো বেশি কোর্স তৈরি করে ও সারাবিশ্বে জনপ্রিয় ভাষায় সবগুলি লেসন/টিউটোরিয়ালকে অনুবাদ করে। খান একাডেমীর ভিডিও লেকচারগুলো দেখে মুগ্ধ মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা এবং শীর্ষ ধনী বিল গেটস। Aspen Ideas Festival-এ বিলগেটস বলেছিলেন, তিনি ও তার তের বছর বয়সী সন্তান ররিকে নিয়ে ইউটিউবে নিয়মিত খান একাডেমীর লেকচার দেখে গণিত শেখেন। বিল এন্ড মেলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশন থেকেও বড় অ্যামাউন্টের টাকা দেয়া হয়।
খান একাডেমীর ভিডিও ভিত্তিক এই শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত ক্লাসরুম ধারণাকে উলটে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে লস অ্যালটোসের একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাদের যেসব লেকচার পড়তে হবে, তা বাসায় বসে খান একাডেমির সাইট থেকে দেখে আসে এবং স্কুলে এসে শ্রেণীশিক্ষকের সহযোগিতায় ক্লাসওয়ার্ক (আগে যা ছিল হোমওয়ার্ক) করে। এতে ক্লাসে শিক্ষক তাঁর সম্পূর্ণ সময় ও মনোযোগ শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করতে পারেন, তাঁদের সমস্যা সমাধান করতে পারেন, যা আগে কখনো সম্ভব ছিল না।
সালমান খান একজন মহান শিক্ষক, যাঁর স্বপ্ন শিক্ষাব্যবস্থাকে বদলে দেওয়া। কোনো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়েও তিনি শেখাচ্ছেন সারা পৃথিবীকে।
তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া
লেখাটি বর্গমূল ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত।