বাংলা ভাষায় ব্লগিং আন্দোলন এখন একটি পাকাপোক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। ‘কাজকর্মহীন ছেলেপুলেদের কান্ড’ থেকে ব্লগিং এখন হয়ে উঠেছে তারুণ্যের জয়গান ও শক্তির স্ফুরণ। শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অনেকেই হয়তো সেই সমালোচনার বাক্যগুলো প্রকাশ করতে পারছেন না। কিন্তু ঘড়োয়া আলোচনায় সমালোচনার প্রচন্ডতা উপলব্ধি করা যায় খুব সহজেই। যারা আওয়ামী লীগ ঘরাণার নন, তারা বেশ জোড়ে-সোরেই শাহবাগে তরুণ ব্লগারদের জাগরণকে আখ্যা দিচ্ছেন আওয়ামীপন্থিদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জমায়েত হিসেবে। তারা দৃঢ় চিত্তেই দাবি করছেন, এ আন্দোলনের কোন সফলতা নেই এবং খুব দ্রুতই এ আন্দোলন পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে এই অভিযোগ এই মুহুর্তে আমি খন্ডন করবো না কারণ এটা বিভাজনের রাজনীতির একটি অংশ। তাছাড়া একজন ব্লগার হিসেবে আমারো কিছু মতদ্বৈধতা আছে। তাই ব্যাপারটি পরের কোন পোস্টের জন্য রেখে দিলাম। আর নিহত ব্লগার রাজীবের ধর্মবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরে দৈনিক ইনকিলাব ও আমার দেশ পত্রিকায় যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তা নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন এক বিতর্ক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পত্রিকায় ছাপা হওয়া রাজীবের বক্তব্য সুস্থ্যচিন্তাপ্রসূত নয়। কিন্তু তারপরও এ বক্তব্য রাজীবের ছিল কিনা তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
তবে এই সব সমালোচনা থেকে শাহবাগ আন্দোলন সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি ইতিবাচক দিক আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। যারা তরুণ ব্লগারদের সমালোচনায় মুখর তাদের বড় অংশের বয়স পঞ্চাশ এর উপর। অর্থাৎ বয়সে তারা প্রবীন। ব্লগারদের চলমান এই আন্দোলনের আগে তারা জানতেনই না ব্লগ বা ব্লগার কী। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে তারা এই শব্দ দুটির সাথে পরিচিত হয়েছেন এবং আমার মত অনেকের কাছেই ব্লগিং সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। গত কয়েক দিনে বিশেষ করে ব্লগার রাজীবের হত্যাকান্ডের পর এ বিষয়ে তারা আরো আগ্রহী হয়েছেন। অর্থাৎ প্রবীনদের কাছে অজানা ও অবহেলিত একটি বিষয় এখন অনেকটা বিপ্লবের রঙে আবির্ভুত হয়েছে। তারা বুঝতে পারছেন, ব্লগার নামে আধুনিকতা মনস্ক সচেতন একটি শ্রেণি আমাদের সমাজে গড়ে উঠেছে এবং হালে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাদের সরব আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। তাদের দৃষ্টিতে ব্লগারদের এই উত্থান আজ হয়তো অনেকটা আওয়ামী ঘেষা তবে আমি মনে করি ভবিষ্যতে এই আন্দোলন যে কোন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে আবারো দানা বেধে উঠবে। হতে পারে সেই উত্থান সময়ের প্রেক্ষিতে বিএনপিরও পক্ষে যাবে। হতে পারে ওয়ান এলিভেনের মত কোন ভবিষ্যত জাতীয় সংকটে ব্লগাররা গণতন্ত্রের স্বার্থে আবারো মাঠে নামবে এবং তখন সেই জাগরণ শুধু আওয়ামী লীগ নয় বিএনপিরও আকাক্সিক্ষত হবে।
আমি যে সমালোচদের কথা বলছি, তারা আরো একটি বিষয়কে বড় করে দেখছেন। সেটা ব্লগারদের সংখ্যা। তাদের ধারণা এত অল্প সংখ্যক ব্লগার ভোটের রাজনীতিতে বড় কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। আমার দৃষ্টিতে তাদের এমন ধারণার পেছনেও সেই একই অজ্ঞতা কাজ করছে। তারা আসলে জানেন না ব্লগের শক্তিটা কোথায় এবং ব্লগিং এর প্রভাব কতদূর বিস্তৃত হতে পারে। শাহবাগে যারা জমায়েত হয়েছেন তাদের মধ্যে ব্লগারের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয় কিন্তু এই অল্পসংখ্যক ব্লগারই হাজার হাজার সচেতন দেশপ্রেমিক জনতাকে যেমন একত্রিত করতে পেরেছে তেমনি সারা দেশেও উদ্দিপনা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ভোটের রাজনীতির প্রসঙ্গটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো সচেতনতার বিস্তৃতি। একজন আন্না হাজারে বা মালালা যা পারেন তার সাথে মেকি ভোটের হিসেবের কোন সম্পর্ক নয়। ব্লগাররা ভোটযুদ্ধে নামেননি নেমেছেন একটি সার্বজনীন দাবিকে জোড়ালো করার আন্দোলনে।
সুতরাং আমার দৃষ্টিতে ব্লগারদের এই অভূতপূর্ব আন্দোলন শুধু একটি আন্দোলনই নয়, এটি ব্লগার নামক একটি শক্তির আত্মপ্রকাশ। এই আত্মপ্রকাশ এখন যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ থাকবে। জাতির বুড়ো প্রজন্ম এখন সেই গুরুত্ব টের পেলেই হলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৩৬