যৌক্তিক-অযৌক্তিক যা-ই বলা হোক বা দাবি করা হোক না কেন, বাংলা একাডেমি কী শুধুমাত্র একক ইচ্ছা শক্তির বলেই শ্রাবণ প্রকাশনীকে আগামী দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে? এটা কী হয়? বই মেলার ইতিহাসের পাতায় বাংলা একাডেমি কখনও কী এমন কাজ লেখে দিয়েছে?
কেউ জানে কি-না জানি না, বইমেলা ২০১৭-তে যত প্রকাশনা সংস্থা অংশ নেবেন, তারা যত ধরণের বই স্টলে বিক্রির উদ্দেশে তুলবেন বা প্রদর্শন করবেন- তত ধরণের বই এর নূন্যতম একটি কপি স্টলে তোলার আগে বাংলা একাডেমিকে জমা দিতে হবে। বাংলা একাডেমি এসব বই পোস্ট মর্টেম করবে, তারপর অনুমোদন দেবে বিক্রি বা প্রদর্শনীর।
কিন্তু এমন নিয়ম কেন? উগ্র সমালোচকরা বলবেন- বাংলা একাডেমি চেতনা হারিয়ে ফেলেছে, নষ্ট হয়ে গেছে, মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে ইত্যাদি ঝাল ঝাল বাক্য বা কথা। সে যাক গে। বাংলা একাডেমির কী স্বার্থ আছে ওইসব নিয়মকানুন পালনের তা-ই দেখার বা বোঝার বিষয়।
জানা গিয়েছে- গত বই মেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীকে নিয়ে ধর্ম অবমাননা সম্পর্কিত যে ঘটনা ঘটেছে, সে ধরণের বা তার চেয়ে কম মাত্রা বা বেশি মাত্রার কোনো ঘটনা যেন আবার না ঘটে আইনশৃঙ্খলার উপর সরিষা সম নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার না করতে পারে, সেজন্য বাংলা একাডেমি বরাবর সুপারিশ আছে পুলিশের।
সুপারিশটা হচ্ছে- আসন্ন বই মেলায় যাতে এমন কোনো বই বা এমন কোনো লেখকের বই বা প্রকাশনা সংস্থা স্থান না পায়, যে বা যারা বিতর্কিত পূর্ব থেকেই বা বিতর্কিত হবার আশঙ্কা আছে। বিতর্কিত বলতে মূলত ধর্ম অবমাননা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার আশঙ্কার কথাই পুলিশের মূল কথা। কেননা, এদেশের মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-- যার কথাই বলা হোক না কেন- প্রত্যেকেই অন্ধের মতন ধর্মে বিশ্বাসী। সামান্য ছুঁতা পেলেই কী যে করবে, কাকে করবে- তা তারা নিজেরাও মালুম করতে পারে না। এজন্যই পুলিশের এই সুপারিশ। শুধুমাত্র সুপারিশ। নির্দেশ নয়। পুলিশের সুপারিশে কোনো লেখক, প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশনা সংস্থার মালিকের নামধাম, কোনো বইয়ের নামধাম উল্লেখ করা হয়নি।
বদ্বীপ না হয় ধর্ম নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করে এবং তা মেলার স্টলে স্থান দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিল। যার জন্যে তাদের স্টল সিলগালা করা হলো, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা হলো, যাতে বদ্বীপের তিনজনকে আসামি করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- শ্রাবণের দিকে বাংলা একাডেমির নজর পড়ল কেন। অবশ্য কেন নজর পড়েছে, সেটার ব্যাখ্যা বাংলা একাডেমি দিয়ে দিয়েছে। তারপরও মনে প্রশ্ন জাগছে- শ্রাবণ তো বদ্বীপের মতন রোল প্লে করেনি, তারপরও কেন শ্রাবণকে দু' বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো?
এবার আসি আসল কথায়। বদ্বীপ প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে যখন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তখন এর প্রতিবাদে গড়ে উঠা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ ছিল- শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবীন আহসান। তিনি বিভিন্ন টেলিভিশনে টক শোতেও তাদের পক্ষ হয়ে জোরালো বক্তব্য দেন। এটা তিনি নিজ মুখেই গত সোমবার সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন।
প্যাঁচটা তো লেগেছে এ জায়গাতেই। গত বছর বদ্বীপকে সিলগালা করার পর বাংলা একাডেমি তো বলেই দিয়েছিল- বদ্বীপ যে কাজ করেছে, তা বই মেলার স্বার্থ বিরোধী, সেজন্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আর এই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই আন্দোলনে অংশ নিলেন- শ্রাবণের কর্ণধার। সে বার শ্রাবণেরও স্টল ছিল মেলায়।
বাংলা একাডেমির যুক্তিটা হচ্ছে- বই মেলার স্বার্থ বিরোধী কাজ করা বদ্বীপকে হঠিয়ে দিলাম, আর বদ্বীপের পক্ষ নিয়ে সক্রিয় আন্দোলন করল শ্রাবণ। তাহলে শ্রাবণের আচরণও বই মেলার স্বার্থবিরোধী। সুতরাং তাদের বই মেলার ত্রি-সীমানার মধ্যে আসতে দেয়াই যাবে না। যদি দেয়া হয়, তাহলে এই জেরে ধরে যদি উগ্রপন্থীরা কোনো অঘটন ঘটায়? তখন কই যাব? বাটে পড়ব নাকি? না তা হয় না। শ্রাবণকে রাখবই না, যা হবার হবে। শ্রাবণের মালিক যদি টক শোতে কথা না বলতেন একটা পয়েন্ট ছিল, এটা তো সবাই দেখছে, শ্রাবণের মালিক তো চিহ্নিত হয়ে গেছে। আবার পুলিশও সুপারিশ করছে, যাতে আমরা এমন কোনো প্রকাশনা সংস্থা বা বই বা লেখকের বই মেলায় না তুলি, যা কেন্দ্র করে কোনো ঝামেলা হয়। থাক বাবা, এতো ঝামেলা কিনে এনে লাভ নাই। কী থেকে কী হয়। থাক, শ্রাবণ বাদ।
কাজেই বাংলা একাডেমিকে দোষ দেয়ার আগে জোরালোভাবে, সুচিন্তিতভাবে ভাবা উচিৎ। বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামান্য একটা প্রভাব আছে। এটা দোষ বলে মনে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ তার রোল প্লে করবে, তার কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। উগ্রসমালোচকরা কিন্তু পুলিশকেও ছাড়তে ভুল করবেন না।
যদি এমন হতো পুলিশ শ্রাবণের বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে কিছু বলেছে, তবে একটা কথা ছিল। আর বললেইবা কী? শ্রাবণ প্রকাশনীর রোল তো কারও অজানা বা গুপ্ত নয়। এমন ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ যদি শ্রাবণের বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে কিছু বলেও থাকত, সেটা অযৌক্তিক হত বলে মনে হয় না। একইভাবে বলব- বাংলা একাডেমি শ্রাবণকে যে বা যেসব যুক্তির মাধ্যমে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে- তা অযৌক্তিক নয়।
বিতর্কের বিষয়টা ছিল ধর্ম। আবারও বলি ধর্ম। আবারও বলি ধর্ম। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কতজন হত্যার শিকার হয়েছেন, কত জেলা, উপজেলা, গ্রাম, পাড়া, শহরে ধর্মকেন্দ্রীক হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে, তা কারও অজানা নয়। এসব প্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমির গৃহিত সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক বলার সাহস পাচ্ছি না।
আবার দেখা যায়, বাংলা একাডেমি সেদিন একটু নরম হয়েছে শ্রাবণের বিষয়ে। বলেছে, লিখিত অঙ্গীকার সাপেক্ষে তারা শ্রাবণকে বই মেলায় স্টল করার অনুমতি দেবে। যদিও এটি এখনও সুরাহা হয়নি। যদি ধর্মীয় বিষয়টির গন্ধ না থাকত, হয়তো বাংলা একাডেমি এক্ষেত্রে লিখিত অঙ্গীকারের বিষয়টি সৃষ্টি করতই না।
আবেগ দিয়ে তো আইন চলে না। আইনের কাছে আবেগ অনেকটাই মূল্যহীন। আবারও বলতে হচ্ছে- বাংলা একাডেমির একটি আশঙ্কা আছে- যদি শ্রাবণকে মেলায় সুযোগ দেয়া হয়, তবে একটি গোলযোগ সৃষ্টি হতে পারে, তার উপর বিষয়টি আবার ধর্ম। যদি শ্রাবণকে মেলায় সুযোগ দেয়ার পর সে ধরণের কিছু ঘটে, তখন সেই বিপদ কে সামলাবে, কে গালাগাল খাবে, কে জবাবদিহিতা করবে। উত্তর আছে- গালাগাল খাবে প্রথমে পুলিশ, পরে বাংলা একাডেমি।
আজকে যেসব চেতনাধারীরা শ্রাবণের হয়ে বাংলা একাডেমিকে গালাগাল করছেন, প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন, সমালোচনার ঝাল দিয়ে তার মৃত স্বজনদের জীবিত করার চেষ্টা করছেন, তারাই তখন অশালীন শব্দ-বাক্য দিয়ে বাংলা একাডেমি ও পুলিশের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে ফেলবেন। এক সেকেন্ডও দেরি করবেন না।
বুঝতে পারছি না, কোনদিকে যাবে বাংলা একাডেমি, কোনদিকে পুলিশ!
রাতে রিকশাচালককে ভাড়া করলে তারা যদি ভাড়া বেশি চান, তার যুক্তি থাকে- রাত হইয়া গেছে, যাইতে তো পারুমই, আইতে হইব খাইল্লা। যদি সেদিন রোদ থাকে, রিকশা চালক বলবে, ম্যালা রোইদ। বৃষ্টি হলে বলবে, দেখছেন, কিরম বৃষ্টি। শীত হলে বলবে- দেখছেন, কেমন শীত, আপনার মইদ্যে কী মানবতা নাই? ঈদ বা কোনো উৎসবের দিন হলে প্যাসেঞ্জারের কাছে বিক্রি করবে সেদিনটি। আসলে যত ঠেকা প্যাসেঞ্জারেরই। রিকশায় চড়লে পকেট কাটে, না উঠলে বিপদ বাড়ে।
সাম্প্রতিক সময়কার প্রতিবাদী চেতনাধারীদের আচরণও তেমনই দেখা যাচ্ছে। সব ঠেকা বাংলা একডেমি, সব ঠেকা পুলিশের।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৪৬