ইদানিং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তমনা, ব্লগার ইত্যাদি শ্রেণীর বাঙালি লোকজন, নারী-পুরুষ, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যেভাবে হোয়াইট ওয়াশ করছেন, তা দেখে-পড়ে নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। ভাবলাম সবাই না হয় শামসুজ্জামানকে হোয়াইট ওয়াশ করছেন, আমি না হয় একটু দালালিই করি।
বাংলা একাডেমি শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুবছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে থেকেই শামসুজ্জামানকে হোয়াইট ওয়াশ পর্বের উত্থান। তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তার কিছু কথা উপস্থাপন করেছেন। সেখান থেকে হোয়াইট ওয়াশ পর্বের গায়ে চর্বিযুক্ত হতে থাকে। তিনি বানান ভুল করেছেন। অভিধান ঘেঁটে বা মানুষের মুখ শুনে নকল করে বের করা হলো- তার স্ট্যাটাসে ৩২টি বানান ভুল। বিশাল ব্যাপার। যে বাংলা একাডেমি শুদ্ধ বানান-উচ্চারণ নিয়ে কাজ করা দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান, সে প্রতিষ্ঠান কর্তার কাছ থেকে এমন কাণ্ড? না না হতেই পারে না। এজন্য স্বাস্থ্যবান হতে থাকে হোয়াইট ওয়াশ পর্ব।
''৩২ ভুল''- ঠিক রেখে যে যার মতন করে শামসুজ্জামানকে ধুয়ে তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। উগ্র সমালোচকরা শুধু পারছেন না, সমালোচনার ঝাল দিয়ে শামসুজ্জামানের মৃত আত্মীয়-স্বজনদের জীবিত করতে।
আমার কথা অন্য জায়গায়। শামসুজ্জামান তার স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। যে ফ্রন্টে লেখা, সেটা ইউনিকোড। বহুত বড় বড় ডিগ্রিধারী থেকে শুরু করে পথ বাসকারী মানুষকে আমি নিজ হাতে ইউনিকোডে লিখা শিখিয়েছি, বিশেষ করে স্মার্টফোনে কীভাবে লিখতে হয় ইউনিকোডে শিখিয়েছি। আমার গায়ে পড়ে বহুত বড় বড়, মোটা মোটা পুস্তক পড়ে পাশ করা, দেশি-বিদেশি নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করারা ইউনিকোডে বাংলা লিখা শিখেছেন, দিন নেই রাত নেই, ফোন দিত, পরামর্শ নিত, কীভাবে কাঙ্ক্ষিত বানানটি লিখবেন। এসবে কোনো দোষ নেই। মানুষ সব জানে না। একজন অপরজনের সহযোগিতা নিয়েই নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। আমি কিন্তু অহঙ্কার করে এসব কথা বলিনি। গর্ব করে বলেছি মাত্র। গর্বের কারণ একটিই মানুষ তো বাংলায় লেখা শিখছে, শিখতে চাচ্ছে। কথা হচ্ছে- শামসুজ্জামান বাংলা বানান ভুল করতে পারেন না, তা নয়। করতে পারেন, কিন্তু চোখ কান খোলা রেখে জোর দিয়ে ভাবা জরুরি, যারা আজকে শামসুজ্জামানের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন, তারা ইউনিকোডে ফেসবুকে শতভাগ নির্ভূল বানান লিখতে কতটুকু সক্ষম।
নূন্যতম অসম্মান প্রদর্শন করে বলছি না, বহুত ধাড়ি জ্ঞানীকে খুব কাছ থেকে দেখছি কলম দিয়ে প্যাঁচগোঁচ করে যুক্ত বর্ণ চট করে লিখে ফেলেন, কিন্তু কম্পিউটারে সেই বর্ণ টাইপ করতে পারেন না। কেননা, সেই ধাড়ি জ্ঞানী বানান সম্পর্কে অজ্ঞান। আমি জানি না, শামসুজ্জামান নিজ হাতে স্ট্যাটাসটি লিখেছেন কি-না। বানানের দিকে তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল কি-না। এটা নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি- তিনি সতর্ক ছিলেন না। তার কথা ছিল একটাই- মনের ভাব উপস্থাপন। সেটা তিনি করতে পেরেছেন।
দুটো প্রশ্ন জাগে। প্রথমত; ধরে নিলাম- শামসুজ্জামান নিজ হাতে স্ট্যাটাস লিখেছেন, তার স্মার্টফোনে বা কম্পিউটারে। এখানে বলতে হয়- বৃদ্ধ বয়সে ইউনিকোডে বাংলা লিখার দক্ষতা তার আছে কি-না? যেখানে একাডেমিকভাবে উচ্চশিক্ষিত সমাজের মধ্যেই দেখেছি- ইউনিকোডে বাংলা বানান লিখার চরম মূর্খতা, যাকে টোটালি বেমানান বলা ছাড়া আর কিছুই দেখছি না।
দ্বিতীয়ত; ধরে নিলাম স্ট্যাটাসটি তিনি নিজ হাতে কাগজে লিখে দিয়েছেন তার কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছে। তাকে নির্দেশ বা অনুরোধ করেছেন, এটি ফেসবুকে তার আইডিতে পোস্ট করতে। ধরে নিলাম সেভাবেই তার আইডিতে পোস্ট হয়েছে। তার মানে ইউনিকোডে টাইপিং তিনি নিজহাতে করেননি। করেছেন তার বিশ্বস্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা। ইউনিকোড ব্যবহার করে বাংলা লিখতে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা কতটুকু দক্ষ ছিলেন? তাদের দক্ষতা নিয়ে আমি ভীষণ সন্দিহান। এই সন্দেহ মোটেও জাগত না, যদি একাডেমিকভাবে উচ্চশিক্ষিত সমাজের মধ্যে ইউনিকোডে বাংলা বানান লিখার চরম মূর্খতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ না করতাম।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বলে শামসুজ্জামান খান বাংলা বানান ভুল করতে পারেন না, এমন সাফাই গাইব না। তিনি ভুল করতে পারেন। তবে স্ট্যাটাসে যে ৩২টি ভুল দেখানো হচ্ছে, যে হারে ভুলের সংখ্যা, সে হারে ভুল করার ব্যক্তি তিনি নন, এটা বেশ জোর দিয়েই দাবি করতে পারি।
শামসুজ্জামান খান মনের ভাব প্রকাশ করেছেন মাত্র। শুদ্ধ বানান চর্চা বা শুদ্ধ বানানের পরীক্ষা দিতে ওই স্ট্যাটাস পোস্ট করেননি, এটা ধ্রুব সত্যই বলব। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়, সমস্যা শ্রাবণ প্রকাশনীকে ঘিরে। এজন্য তার মনের ভাবের কোনো মূল্য নেই, মূল্য শুধুই বানানের। কট্টর সমালোচকদের একমাত্র স্বাস্থ্যবান খোরাক এখন এইটাই আছে। আরও কিছু খোরাক ছিল, কিন্তু সেসব ভীষণ জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে এবং আরও কিছু যাচ্ছে।
স্ট্যাটাস নিয়ে আমার দৃষ্টিতে শামসুজ্জামানের সমস্যাগুলো হচ্ছে- বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে তিনি কেন বাংলা বানানের কথা ভাবেননি, কেন তিনি আরও সতর্ক হননি, কেন তিনি ফেসবুকের ওয়ালকে পরীক্ষার খাতা মনে করেননি। যদি করতেন ৩২ ভুল হতো না। শ্রাবণ প্রেমিকদের কণ্ঠ এতো শক্তিশালী হতো না। সব দোষ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানেরই!!
সামনে আসছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। কী জানি হয় তখন!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ২:১০