বৃহস্পতিবার হতভাগ্য আবুল কাশেমের (৪০) দেখা পাওয়া যায় মহাখালী সিদ্দিক টাওয়ারের পেছনে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গলিতে অবস্থিত একটি চা দোকানে।
মেরুদণ্ডে ভর করার ক্ষমতা না থাকায় চা দোকানের লোহার বেঞ্চ ঘেঁষা মেহগনি গাছ দিয়ে নির্মিত খুঁটির সহযোগিতায় বেঞ্চটিতে বসেছিলেন তিনি। দুধ চা পানের ফাঁকে ফাঁকে দোকানে আসা ক্রেতাদের কাছে আর্থিক সহযোগিতা পাবার আকুতি জানাচ্ছিলেন তিনি। মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হবার জেরে তার কণ্ঠ থেকে বেরুনো ভাষাও অস্পষ্ট।
চা পানের ফাঁকে ফাঁকে কথা হচ্ছিল তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে।
অতীতের কথা জানতে চাইলেই আবুলের চোখ-মুখে ভেসে উঠে শোকের ছাপ, ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হবার জেরে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে থাকা আবুল আবছা স্বরে বলেন, ধানের বস্তা আমারে মাইরালচে (মেরে ফেলেছে)।
কীভাবে- কী হলো- প্রশ্নে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার জাউয়ার গ্রামের আবুলের কাছ থেকে জানা গেল- স্ত্রী-চার সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবেই গ্রামে বাস করতেন তিনি। দিন এনে দিন খাওয়া ব্যক্তি ছিলেন তিনি। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া তিন শতক মাটিতে বাস করত তার পরিবারসহ তার আরও এক ভাই ও তিন বোনের সংসার। দুই বছর আগে বৈশাখ মাসে আমন ধানের মৌসুমে চুক্তিতে কাজ করার জন্য আবুলের ডাক পড়ে প্রতিবেশি একজন চাচার বাড়িতে। প্রচুর পরিমাণে বস্তাবন্দি ধান রাখাছিল চাচার ঘরে। চাচার প্রস্তাবে রাতে পাহারা দিতে আবুল একা থাকেন সে ঘরে।
আবুলের ভাষ্যমতে- আড়াইমন ধান ধারণক্ষমতা সম্পন্ন অন্ততঃ ৩০ বস্তা ধান একটির উপর আরেকটি করে ৫-৬টি ভাগে রাখা ছিল। রাতে ঘুমের ঘোরে থাকাবস্থাতেই একটি স্তুপ ধ্বসে পড়ে আবুলের জ্বলজ্যান্ত দেহে। তার চিৎকারে সবাই এগিয়ে আসেন, উদ্ধার করে নেন- কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে, ধরা পড়ে তার মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লেগেছে। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা প্রাপ্তির উপযুক্ত স্থান সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার পাশাপাশি আর্থিক দুর্বলতার দরুণ সঠিকপন্থায় চিকিৎসা করাতে পারেননি তিনি। তারপরও এর তার কাছে হাত পেতে ছুটে বেড়িয়েছেন- কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও কুমিল্লায়। শেষ পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকায়।
কিন্তু কীভাবে, কার ভরসায় হবে আবুলের চিকিৎসা, কেইবা আছেন তার পাশে?
আবুল বলেন, মাইনষের আশা কইরা ঢাকা আইছি, ভিক্ষা করুম আর ডাক্তার দেখামু।
উন্নত চিকিৎসার আশা নিয়ে আখাউড়ার একজন চিকিৎসকের পরামর্শে দুই মাস আগে আবুল ঢাকায় আসেন স্ত্রী জুনুরা বেগম ও ছোট সন্তান মোজাম্মিল (৮) কে নিয়ে। অভাবের সংসারের সদস্য বড় মেয়ে নাসরিনের বিয়ে হয়েছে ৫ বছর আগে। দ্বিতীয় সন্তান কিশোরী তানজিনাকে সিলেটে একজনের বাসায় দেয়া হয়েছে- গৃহকর্মী হিসেবে। তৃতীয় সন্তান ইয়াসিন (১১)কে আখাউড়ার নাইন স্টার নামক খাবারের হোটেলে দিয়েছেন কাজ করে খেতে-পরতে।
বর্তমানে কড়াইল আনসার ক্যাম্পের কাছে অতি সস্তায় ভাড়া বাড়িতে থেকে আবুল এর-ওর কাছে হাতপাতে ও স্ত্রী জুনুরা খাতুন দুটো বাসায় কাজ করে মাসে ৩ হাজার টাকা রোজগার করে। দিনান্তে আবুল পায় দুশো টাকার মতন। তিনি বলেন, ঘুরতেই তো পারি না, ঘুরতে না পারলে মাইষের কাছে যাওন যায় না, চাওন যায় না, টেকাও পাওন যায় না।
গ্রামে পয়সাওয়ালা কারও কাছে যাওয়া হয়েছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, গেছিলাম, কইছিলাম। কেউ তো আসে না। আসলেই তো খাটনি বাড়ব তাগো, দায়িত্ব বাড়ব, টেকা খরচ হইব- এজন্যই মনে হয় আসে না। আমার গেরামের একজন অনেক বড় সচিব আছে। উনার নাম আবু কালাম। নাম শুনছি, কখনও দেখি নাই। ঢাকায় আসার সময় উনার নাম স্মরণ কইরা ভাবতাছিলাম, উনারে কই পাই, কেমনে পাই, এতো বড় শহরে কত মানুষের গ্যাঞ্জাম, কেমনে পামু, উনার ফোন নম্বর-বাসা- কিছুই তো চিনি-জানি না।
আবু কালাম কোন মন্ত্রণালয়ে আছেন প্রশ্নে বলেন, এতো কিছু তো জানি না।
আবুল চিকিৎসা গ্রহণ করছেন বনানীতে অবস্থিত সেরাজেম নামক চিকিৎসা কেন্দ্রে। সেখানে আকুপ্রেশার পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রদান করা হয় বলে জানা গেছে আবুলের কাছে থাকা অর্ধছেঁড়া একটি লিফলেট দেখে। এখানে চিকিৎসা করাতে গিয়ে এ পর্যন্ত আবুলের খরচ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকার মতন।
চিকিৎসায় কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যথাটা কমছে। কিন্তু খারাইতেই তো পারি না। কী কাজকাম করুম-খামু।
এতো কিছুর পরও আবুলের ভরসা মানুষ। শেষ আলাপেও আবুল বলেন, মানুষের উপর ভরসা কইরাই ঢাকায় আইছি।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : আবুল ব্যক্তিগতভাবে কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। তার স্ত্রীর আছে। কিন্তু আবুল সেই নম্বর বলতে পারেননি। যদি কেউ আবুলকে সহযোগিতা করতে চান, তবে ইমেইল ঠিকানায় [email protected] যোগাযোগ করতে পারেন আমাদের সময় ডটকম প্রতিবেদকের সঙ্গে)।
কর্মক্ষমতা হারানো আবুলের চিকিৎসা মানুষের উপর নির্ভরশীল
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:১৬