বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নিয়ে অনিয়মের অভিযোগের অন্ত নেই। সময়মতন দায়িত্ব পালন করেন না, দায়িত্বশীলভাবে চিকিৎসা সেবা দেন না, রোগীদের সঙ্গে ভাল আচরণ করেন না, অবৈধভাবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন ইত্যাদি রকমের হাজারটা অনিয়মের অভিযোগ।
গণমাধ্যমকর্মীদের খাতায় নিজ নাম থাকায় এ বাক্য নিসঙ্কোচে লিখতে পারছি।
তবে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ততা ডাক্তারদের পেশাদারিত্বকে খুইয়েছে বহুলাংশে। রাজনীতি খারাপ, তা বলছি না। বলতে চাই, কোনো চিকিৎসক কাজে কর্মে যদি দেখিয়ে ফেলেন, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি আওয়ামীলীগার কিংবা বিএনপির মাননীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি মাত্রায় বিএনপি প্রেমী- এমন রাজনীতি নিয়ে। আমার মাঝে এমন মত জন্ম নিয়েছে চিকিৎসক রাজনীতিকদের সঙ্গে মিশে, প্রশ্ন করে ও নিজ পর্যবেক্ষণে।
প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। আসলেই কী চিকিৎসকরা রোগীদের সঙ্গে ভাল আচরণ করেন না, রোগীদের সেবা দেন না?
দিন তিনেক আগে এমন বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙণে একজন বন্ধু সুলভ চিকিৎসকের সঙ্গে ভদ্রোচিতভাবে মাতি। আমাদের সঙ্গে আচমকা যোগ দেন একজন রোগীর স্বজন, নাম সোহাগ। তিনি বুঝতেই পারেননি আমি গণমাধ্যম কর্মী আর আমার সঙ্গে নির্ধারিত পোশাক ছাড়া গল্পরত ব্যক্তিটি এখানকারই চিকিৎসক।
সরকারি চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে আমাদের কথার মাঝে বেসরকারি চাকুরিজীবি সোহাগ অর্ধবজ্র কণ্ঠে বলে উঠেন, সরকারি হাসপাতালে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যায় না, ডাক্তাররা রোগীদের গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না, রোগীর সঙ্গে ভাল আচরণ করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর বেসকারি হাসপাতালে গেলে একগাদা টেস্টটুস্ট দিয়ে দেন। চিকিৎসা করাবো কী, টেস্টের খরচা দিতে দিতেই পকেট ফুটা হয়ে যায়। সরকারি সেবা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, আসলে সরকারি হাসপাতালে সরকার যে বরাদ্দ দেয়, সেটা ঠিকভাবে রোগীদের দেয়া হয় না, মেরে খেয়ে ফেলে সব, কোটি কোটি টাকা......
শুনে আমি ভেতর ভেতর হাসতে লাগলাম। শেষ বাক্য আমার হাসিকে বিস্ফোরিত করেই ফেলে, সঙ্গে রাগান্বিতও হই। আমার সঙ্গে থাকা ডাক্তার বন্ধুটিও কিছুটা ক্ষেপে যান। তাকে শান্ত করে সোহাগ ভাইর কাছে প্রশ্ন করি- ভাই, কোটি কোটি টাকা কীভাবে মারে, দেখেছেন হিসাব করে, আপনি সরকারি হাসপাতালে কী এই হিসাব-নিকাশ মেলানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন নাকি সেবা পাবার উদ্দেশে আসেন?
সোহাগ ভাইর ভ্রু কুঁচকে যায় সঙ্গে সঙ্গে। কাঁচুমাচুঁ করে বলেই ফেলেন, না মানে, ওটা তো বোঝাই যায়। আমিও বলি, কীভাবে বোঝা যায়, আপনার বোঝকে কে বা কারা মূল্যায়িত করে সত্যায়িত করেছেন, গ্রহণযোগ্য করেছেন? আচ্ছা, কাক্সিক্ষত সেবা বলতে কী বোঝেন, কী কী হলে আপনার সেবা কাক্সিক্ষত রূপ পাবে বলে মনে করেন?
এরপর সোহাগ ভাই আরও বিব্রত হয়ে অন্য দিকে মোড় নেন। বলেন, শুধুশুধু টেস্ট দিয়ে তো তারা অনেক টাকা কামান।
এবার আমার ডাক্তার বন্ধু মুখ খুলেন। তিনি বলেন, কোন হাসপাতালে গিয়ে গাদা গাদা টেস্ট করেছিলেন।
সোহাগ বলেন, স্কয়ারে।
ডাক্তার বন্ধু প্রচণ্ড- ক্ষেপে বলেন, ওখানে গেলে যে অঢেল টাকা ঢালতে হয়, জানেন নিশ্চই। জেনে শুনে গিয়ে যদি ধরা খান, দোষ কী ডাক্তারের? শোনেন, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক কখনও অযথা টেস্ট করতে দেন না। আচ্ছা, আপনি কীভাবে বুঝেন অযথা টেস্ট? আপনি কী ডাক্তার?
উত্তর আসে না সোহাগ সাহেবের মুখ থেকে। ডাক্তার বন্ধু একচেটিয়াভাবে বলতে থাকেন, শোনেন, সরকারি হাসপাতাল আছে বলেই, এখানকার ডাক্তাররা ঠিক আছেন বলেই বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের গরিব মানুষ বেঁচে আছেন, রোগাক্রান্ত থেকে রোগমুক্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারি হাসপাতালের অবদান জানেন?
এক পর্যায়ে বন্ধুটি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলে আমি দুজনকেই সম্ভবত চিরবিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হই।
আমি বুঝিনি, সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসে রোগী যদি হিসাব করেন, এতো এতো বরাদ্দ কই যায়, কে মারে- সে রোগী বা সে রোগীর স্বজনের মাথা ঠিক থাকবে কীভাবে? সে রোগী বা রোগীর স্বজনকে সরকারি কোন ডাক্তার সন্তুষ্ট করতে পারবেন, আমার জানা নেই।
সরকারি চিকিৎসকরা যে একদম ধোয়া তুলসি পাতা, সেটা বলা যাচ্ছে না। অনিয়ম তারা করেন, জেনে শুনে করেন, খামখেয়ালি থেকে পেশার প্রতি কমিটমেন্ট বেমালুম যান ভুলে। এই ভুলের পেছনে যা কাজ করে, তার মধ্যে অন্যতম ওই অতিমাত্রিক রাজনীতি বলেই মনে হয় আমার পর্যবেক্ষণে। আমার পর্যবেক্ষণ ভুলও হতে পারে, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখাবেন।
আমি বলতে চাচ্ছি- শুধু সোহাগ ভাই-ই নন, তার মতো এমন হাজারটা রোগীর স্বজন, রোগী আছেন, যারা কিছু অযথা বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন সরকারি হাসপাতালে এসে। এতো কোটি টাকার হিসাব মিলাতে না পেরে মাথা আউলে যায় তাৎক্ষণিকভাবে, সেবা পেলেও হয়তো ভাবতে শুরু করেন, কী আর পাব, সবই তো মেরে খাই। কোটি টাকার হিসাব না মিলাতে পারায় মাথা আউলে এমন মন্তব্য করাই স্বাভাবিক। সেবা নিতে এসে কোটি টাকার হিসাব মেলানোর দরকার কী, আমি বুঝিই না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৬ রাত ১০:১৯