আজ ৩রা মার্চ, স্বাধীনতার ইশতেহার এর মানে কি? আমাদের ইতিহাস ও রাজনৈতিক নেতারা যদি সচ্ছ হতেন তবে অকুতভয় এই ছাত্র নেতাদের প্রাপ্য সন্মানটুকু দিতেন।
৩রা মার্চ, ১৯৭১।
স্থানঃ পল্টন ময়দান,ঢাকা
জয়বাংলা ইশতেহার নং -১
স্বাধীনতার ইশতেহার।
(স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।)
গত তেইশ বছরের শোষণ, কুশাসন ও নির্যাতন এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমানিত করেছে যে, সাতকোটি বাঙালিকে গোলামে পরিনত করার জন্য নিদেশী পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের যে ঘৃন্য ষড়যন্ত্র তা থেকে বাঙালির মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীনজাতি হিসাবে স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকা। গত নির্বাচনের গণ রায়কে বাঞ্চাল করে শেষ বারের মতো বিদেশি পশ্চিমা শোষকরা সে কথার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে প্রমান করেছে।
৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসিক ভুমি হিসাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাস্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে নিন্মলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
১, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, কৃস্টি ও সংস্কৃতির পুর্ন বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
২, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনিতি চালু করে কৃষক, শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
৩, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
বাংলার স্বাধীনতা পরিচালনার জন্য নিন্মলিখিত কর্মপন্থা গ্রহন করতে হবে।
ক)বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় “স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি” গঠন করতে হবে।
খ) সকল শ্রেনীর জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ব করতে হবে।
গ) শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত কর গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় মুক্তি বাহিনী গঠন করতে হবে।
ঘ) হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি-অবাঙ্গালি সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
ঙ) স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলার সাথে এগিয়ে নিয়ে রাখার জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ করতে হবে। এবং লুটতরাজসহ সকল প্রকার সমাজবিরোধী ও হিংসাত্বক কার্যকলাপ বন্দ্ব করতে হবে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা নিন্মরূপঃ
অ. বর্তমান সরকারকে বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকার গন্য করে বিদেশি সরকারের ঘোষিত সকল আইনকে বেআইনি বিবেচনা করতে হবে।
আ. তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পীবাহী পশ্চিমা অবাঙালি মিলিটারিকে বিদেশি অ হামলাকারী শত্রু সৈন্য হিসাবে গন্য করতে হবে।
ই. বর্তমান বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকারকে স্পকপ্ল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা দেয়া বন্ধ করতে হবে।
ঈ. স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমনরত যে কোন শক্তিকে প্রতিরোধ, প্রতিহত, পালটা আক্রমন ও খতম করার সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
উ. বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
ঊ. স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’......... সঙ্গীতটি ব্যবহৃত হবে।
ঋ. শোষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানি দ্রব্য বর্জন করতে হবে এবং সর্বাত্মক অসহযোগ গড়ে তুলতে হবে।
এ. উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে।
ঐ. স্বাধীনতা সংগ্রামে রত বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিন্ম লিখিত জয়ধ্বনি হবে;
জয় বাংলা-বাংলাদেশের জাতীয় শ্লোগান হিসাবে ব্যবহৃত হবে।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ – দীর্ঘজীবী হউক।
স্বাধীন কর স্বাধীন কর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
স্বাধীন বাংলার মহান নেতা-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড় – মুক্তিবাহিনী গঠন কর।
বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর - বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
বাংলা ও বাঙ্গালীর জয় হোক।
জয় বাংলা
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ।
__________________________________________________________________________________________________
টিকাঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্ররা যদি অগ্রদুতের ভুমিকা পালন করে থাকে তবে তাদের নেতৃতের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” এই পরিষদের চার নেতা আ. স. ম. আবদূর রব(ভিপি-ঢাকসু), আবদুল কুদ্দুস মাখন( জিএস-ঢাকসু), নুরে আলম সিদ্দিকি (সভাপতি-পুর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ), শাহজাহান সিরাজ (সাধারন সম্পাদক-পুর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ)। এই “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” পরিচালিত হতো “স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের” দ্বারা। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টনের ছাত্র- জনসভায় উপস্থিত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা (ইশতেহার) ও কর্মসুচী উপস্থাপন করেন। ঘোষণা (ইশতেহার) পাঠ করেন শাহজাহান সিরাজ, এর পর ঐ সমাবেশে ছাত্র জনতা সম্মিলিতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ যুদ্বে অংশ গ্রহনের জন্য শপথ গ্রহন করেন।*
“২ রা মার্চ রাতে আমরা বেশ কিছুক্ষন সময় আনোয়ার রেস্টুরেন্টে কাটালাম সাথে মধু (ফেরদৌস রায়হান) রাত ৯টার দিকে সিরাজুল আলম খান এলেন, তিনি হাতে লেখা দিয়ে বললেন ‘একটু দেখে দাও’ অসংখ্য কাটাকুটি প্রথমেই লেখা, “ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে” দুপাতা পড়ে হোচট খেলাম ‘‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’’ আমি আর মধু মিলে বানান ঠিক করলাম দু-একটা শব্দ এদিক সেদিক করলাম। পরদিন ৩রা মার্চ এই লেখাগুলোই হ্যান্ডবিল আকারে ছাপিয়ে পল্টনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় বিলি করা হয়। জনসভায় একটা খোলা জীপে করে বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আসেন। মঞ্চে তাঁর উপস্থিতিতে শাহজাহান সিরাজ ইশতেহার পাঠ করেন, এর শিরোনাম ছিলো, জয়বাংলা ইশতেহার নং -১, ব্র্যাকেটের মধ্যে ছিলো স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। শেখ মুজিব ছিলেন একটু বিষণ্ণ, তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হল তাঁর ভাষণ ছিলো সংক্ষিপ্ত তিনি অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যেতে বললেন। বললেন ৭ই মার্চ যা বলার বলবেনঃ** মহিউদ্দিন আহম্মদ বুলবুল।"
সুত্রঃ- ১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ব, দলিল পত্র ২য় খন্ড, ২, আমাদের একাত্তর, সম্পাদনা মহিউদ্দিন আহম্মদ, প্রকাশকঃ সিডিএল, ধানমন্ডি, ঢাকা।