আমার তরুণ বয়স কেটেছে অসামান্য মানুষদের সাহচার্যে। জাহানারা ইমাম, শাহাদত চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, শাহরিয়ার কবির এমন মানুষরা অপ্রিয় কথা বলতে দ্বিধা করতেন না। তাঁদের কাছ থেকে আর কিছু না হোক, অপ্রিয় কথা বলতে শিখেছি। এখনো যা মনে হয় বলে ফেলি। টিভি টক শোতে এসব দেখে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ বিরক্ত হয়। তবে কিছু মানুষ খুশিও হয়।
ঠোঁটকাটা মানুষদের মনের ভেতরটা আরও নির্মম। সে জন্য হয়তো খুব অস্বস্তিকর একটি কথা মনে হয় আজকাল। মনে হয়, মানুষ হিসেবে আমাদের প্রায় সবার মাপ খুব ক্ষুদ্র। আমি সমাজের সুবিধাভোগী মানুষদের কথা বলছি। আমরা সুবিধাভোগী মানুষরা সামষ্টিকভাবে বড় মাপের নই। এ জন্যই হয়তো সত্যিকারের বড় মানুষদের ধরে রাখতে পারিনি আমরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছি, হত্যা করেছি চারনেতাকে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের, খালেদ মোশাররফ সবাইকে। আমাদের মাপের যে জেনারেল, তিনি একসময়ের সামরিক শাসক হলেও জীবিত আছেন, বহাল তবিয়তে আছেন। বারবার নির্বাচিত হচ্ছেন, এবারের নির্বাচনে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় মিত্রও হয়েছেন তিনি।
সবচেয়ে যা ভয়ংকর, সত্যিকার বড় মানুষদের খুন করেই ক্ষান্ত হই না আমরা। তাদের নানাভাবে কাটাছেঁড়া করি, বারবার তাদের সুনাম, অবদান আর চরিত্রকে হত্যা করি। বিএনপির আমলে এর শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু, এখন হচ্ছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপির আমলে স্বাধীনতার সংগ্রাম নির্মাণ, বিকাশ এবং পরিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাঁর শাসনামলের অন্য সবার সমস্ত দোষ চরম অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁর ওপর। তাঁর নাম উপড়ে ফেলা হয়েছে ইতিহাস থেকে, বিভিন্ন স্থাপনা থেকে।
সময় বদলেছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। এখন জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে! অথচ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেষ্ঠ সম্মান বীর-উত্তম খেতাব পেয়েছেন। জিয়ার অবদান শুধু নয়, এই আওয়ামী লীগের আমলে তাঁর মৃতদেহের অস্তিত্ব নিয়ে নিষ্ঠুর প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বাজারে এমন গুজবও রয়েছে যে তাঁর মাজার গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বা ইচ্ছে রয়েছে সরকারের কোনো কোনো মাথাগরম মহলের!
২.
উন্নত রাষ্ট্রে ঐতিহাসিক মানুষের শ্রদ্ধেয় ইমেজ গড়ে তোলা হয় নিরন্তরভাবে। দ্য গল বা শিরাক ফরাসিদের কাছে, চার্চিল বা উইলসন ব্রিটিশদের কাছে, আইসেনহাওয়ার বা কেনেডি আমেরিকানদের কাছে নিকট অতীতের আইডল রাষ্ট্রনায়ক। সাইমন বলিভার বা চে গুয়েভারা স্বপ্নপুরুষ দক্ষিণ আমেরিকায়, গান্ধী বা নেহরু প্রাতঃস্মরণীয় ভারতীয়দের কাছে। তাঁদের দোষত্রুটি, সীমাবদ্ধতা নিয়ে একাডেমিক গবেষণা হয়, আমেরিকা-ইউরোপে কে সবচেয়ে বড় ছিলেন তা নিয়ে র্যাংকিং পর্যন্ত হয়। কিন্তু তাই বলে জীবিত রাজনীতিবিদেরা তাঁদের নিয়ে কুিসত হানাহানিতে মেতে ওঠেন না। তরুণ প্রজন্ম তাঁদের বিশালত্বের গল্প শুনে বড় হয়, বুক ভরা গর্ব নিয়ে বেড়ে ওঠে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে গড়ে তোলে নিজেকে এবং দেশকে।
আমাদের কোনো মহত্ মানুষ নেই অখণ্ডিতভাবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বঙ্গবন্ধু দেবতা, জিয়া দানব। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ঠিক তার উল্টো প্রচারণা চলে রাষ্ট্রীয়ভাবে। পাঁচ বছর পরপর দেবতা আর দানবের আসন বদলায়। কোথাও শ্রদ্ধাময় অথচ নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ নেই।
বঙ্গবন্ধু আর শহীদ জিয়া আমাদের ছেড়ে গেছেন কয়েক দশক আগে। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে স্নেহ করতেন, জিয়া বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি বাজে শব্দ উচ্চারণ করেনি জিয়া সম্পর্কে। জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর কোনো দিন কখনো খারাপ মন্তব্য করেননি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। অথচ তাঁদের উত্তরাধিকারীরা এই দুই নেতাকে নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ির এক নিরন্তর যুদ্ধে মেতে আছে। জিয়ারই স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর শোকাবহ দিনে ঘটা করে পালন করেন কথিত জন্মদিন। বঙ্গবন্ধুরই কন্যা মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা নিয়ে মেতে ওঠেন অবিশ্বাস্য রটনায়।
আমরা জি-হুজুরের দল। তাদের সঙ্গে কেউ কণ্ঠ মেলাই অর্থ-ক্ষমতা-পদকের লোভে; কেউ নিজের ক্ষুদ্রতা থেকে, কেউ বাধ্য হয়ে। হাসপাতালের ঝাড়ুদার থেকে উচ্চ আদালতের বিচারক কেউ পিছিয়ে নেই এই বিভাজনে।
৩.
বঙ্গবন্ধু আর শহীদ জিয়াকে নিয়ে সবচেয়ে বড় বিরোধ স্বাধীনতার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। ২৬ মার্চ এলে এটি প্রকট আকার ধারণ করে। অথচ এই বিরোধও অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়। ২৬ মার্চের পরিপ্রেক্ষিতকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে তাই মনে হবে।
২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার জন্মক্ষণ মাত্র। এই জন্মপ্রক্রিয়া নিশ্চিত রূপ পেতে শুরু করে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয় দফা ঘোষণার মাধ্যমে। ছয় দফার আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরে অবিসংবাদিত নেতৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর। ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচার গণহত্যা শুরু করার সময়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে আটকে রাখা হয়। কিন্তু একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয় তাঁরই নামে, যুদ্ধকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধুই।
তিনি ছিলেন স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের রচয়িতা। তিনি আনুষ্ঠানিক এবং খুব স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা যদি না-ও দিয়ে থাকেন, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের আগে তিনি যা করেছেন তাতেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং প্রধানতম নেতা। এই সত্যের সঙ্গে অন্যদের অবদানের কোনো বিরোধ নেই। এই সত্য উচ্চারণের স্বার্থে অন্য কারও অবদান দখল করার বা অন্য কাউকে খাটো করারও কোনো যুক্তি নেই। যুক্তি নেই জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার প্রভাব ও তাৎপর্যকে তাচ্ছিল্য করার।
একাত্তরের ২৭ মার্চ এই ঘোষণা প্রদান করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মরত মেজর। তাঁর ঘোষণাই বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের মানুষ শুনেছিল এবং সত্যিকারের যুদ্ধযাত্রার আহ্বান হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান ও বর্তমান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের ভাষায়, আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও জানি যে, মেজর জিয়ার এ ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারা দেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, হ্যাঁ, এবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামল। (তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, প্রথমা প্রকাশনী)
জিয়াউর রহমান না জেনে-বুঝে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেননি। সামরিক অফিসার হিসেবে তাঁর জানার কথা ছিল যে স্বাধীনতা-সংগ্রাম ব্যর্থ হলে তাঁর অবধারিত পরিণতি হতো ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু। তবু দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন। কিন্তু এটিও মনে রাখতে হবে যে, তিনি তা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে, এই প্রেরণাও তিনি অবশ্যই পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর রচিত স্বাধিকার ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিত থেকে। মরহুম তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্যরা মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করেছিলেন একই পরিপ্রেক্ষিত থেকে।
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সকল প্রেরণার উৎস, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। তাই বলে এই স্থপতির নির্দেশ, চেতনা, রূপকল্পকে যাঁরা চরম ঝুঁকি নিয়ে একাত্তরের নয় মাসে বিভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁদের খাটো করার কোনো অবকাশ নেই, এর কোনো প্রয়োজনও নেই।
জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হয় আজকাল। কিন্তু এর পক্ষে কোনো রকম অকাট্য প্রমাণ নেই। জিয়া যদি আগে থেকে এ ব্যাপারে কিছু জেনেও থাকেন, সেটুকু জানার সম্ভাবনা আরও বেশি তখনকার সামরিক, বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানদের এবং অবশ্যই আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতার। বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগীও তিনি ঘটনাচক্রে এবং কিছুটা সৌভাগ্যক্রমে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড জিয়াকে রাষ্ট্রপতি বানানোর চিন্তা থেকে অন্তত সংঘটিত হয়নি। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বরের পর কর্নেল তাহের তাঁকে রক্ষা না করলে তিনি পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা রাষ্ট্রপতিও হতে পারতেন না।
বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েও তাই জিয়াকে সম্মান করা অসম্ভব নয়। স্বাধীনতা-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় ও অবিনশ্বর নেতৃত্বের কথা বলতে গিয়ে জিয়া বা অন্য কারও অবদান কেড়ে নেওয়ার বা তাঁকে ধামাচাপা দেওয়ারও আবশ্যকতা নেই। তাঁদের অবদানভিত্তিক বিতর্কে পুরো জাতিকে নিয়োজিত করার প্রচেষ্টারও কোনো ন্যায়সংগত যুক্তি নেই।
৪.
ঐতিহাসিক নেতাদের অবদানকেন্দ্রিক উত্তপ্ত বিরোধ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অনাবশ্যক। এই বিরোধ বরং বর্তমান নেতাদের সীমাবদ্ধতাকে প্রতিফলিত করে। বর্তমান নেতারা হয়তো সত্যিই নিজেদের উজ্জ্বলতা নিয়ে নিজেরাই আত্মবিশ্বাসী নন। এ কারণে একজনকে দেবতা বানিয়ে সেই আলোয় আলোকিত থাকতে চান তাঁরা, অন্যজনকে দানব বানিয়ে তার অন্ধকারে ঢেকে দিতে চান প্রতিপক্ষকে।
অথচ সাধারণ মানুষ হাসিনা-খালেদাকে পছন্দ-অপছন্দ করে মূলত তাঁদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে। খালেদা জিয়ার আগের আমলে দুর্নীতি আর বিদ্যুৎসংকটে অতিষ্ঠ মানুষ তিনি জিয়ার স্ত্রী ছিলেন বলে হাসিমুখে মেনে নেয়নি। হাসিনার বর্তমান আমলে ভেঙে পড়ছে আইন-শৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য আর জ্বালানিসংকট বাড়ছে অসহনীয়ভাবে। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলে কোনো মানুষ নিহত হতে বা অর্ধাহারে থাকতে রাজি নয়, রাজি হওয়ার কথা নয়।
নেতারা ইতিহাসে বেঁচে থাকেন তাঁর নিজস্ব কীর্তিতে। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত ও নির্মোহ হওয়ার কথা পরের প্রজন্মগুলোর। হাসিনার শাসনকাল মূল্যায়ন করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা ছিলেন এ জন্য তাঁর ব্যর্থতা ক্ষমা করে দেবে না তারা। শহীদ জিয়ার পত্নী বলে খালেদার ব্যর্থতাও ইতিহাসে লুকিয়ে রাখা হবে না। হাসিনা কীভাবে জিয়াকে মূল্যায়ন করেন বা খালেদা কীভাবে মুজিবকে দেখেন সেটি জেনে পরের প্রজন্ম দুই নেতাকে শ্রদ্ধা বা অশ্রদ্ধা করার সিদ্ধান্ত নেবেন না। দুই নেত্রী নিশ্চয়ই জানেন তা। জানেন কি?