১-
রাত দশটা।
রায়হান শীলার দু গাল দু হাতে চেপে কাছে টেনে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “দরজাটা লাগিয়ে দাও। ফোনটা যেন সাইলেন্ট করে রেখো না। কোন সমস্যা হলে ফোন দিও। দরজাটা লাগিয়ে দাও”।- বলে রায়হান বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। শীলা দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর ড্রয়িং রুমে ফ্যানের নিচে একটু খানি বসলো। তার মনের ভেতরে একটা চিন্তার আশান্ত ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো সে, রায়হান কোন কারনে ফেরত আসে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু আসলো না সে। নিশ্চয়ই এতোক্ষনে তার উবারের গাড়ি নিয়ে রায়হান রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।
রায়হান প্রতিদিন নিয়ম করে দুপুর দুটায় গাড়ি নিয়ে বের হয়, সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত প্রথম শিফটের কাজ শেষ করে। তারপর ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে রাতের খাবার খেয়ে রাত দশটায় বের হয়ে একদম সকালে ফজরের নামাজের একটু আগে বাসায় ফেরে। ঢাকার রাস্তার জ্যাম এড়ানোর জন্য এমন সময় বেছে নিয়েছে সে। গাড়িটা রায়হানের নিজস্ব, তাই কাউকে জমা খরচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অনেক বিত্ত বৈভব না থাকলেও দুজনের সংসার আহ্লাদে আয়েশে চলে যায়।
যখন শীলা নিশ্চিত হলো রায়হান সকালের আগে আর ফেরত আসবে না, তখন সে উঠে তাঁদের বেড রুমে গেলো। আলমারী খুলে রায়হানের ছোট কেবিন ট্রলিটা বের করলো। এর আগে কখনো শীলা এই ব্যাগটি খুলে দেখেনি। কখনো আগ্রহ বোধও করেনি। রায়হান বলেছে, এর ভেতর তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, নদীতে ভেসে যাওয়া তার পৈত্রিক বাড়ির দলিল দস্তাবেজ আছে। সন্দেহ করার কোন কারনও ছিলো না শীলার।
কিন্তু এক রাতে রায়হান কাজে যায়নি, দুজন রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। গভীর রাতে শীলার হটাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় মৃদু কান্নার শব্দে, ড্রয়িং রুম থেকে আসা মৃদু আলো দেখে বুঝে নিয়েছিলো রায়হান ড্রয়িং রুমে বসে কাঁদছে। বুকের সব আবেগ বাঁধ ভেঙ্গে গেলে যেমন কান্না আসে বুকে মোচড় দিয়ে ঠিক সেরকম কান্না। বিড়ালের মতো চুপিচুপি গিয়ে দেখে রায়হান ফ্লোরে বসে ফোনের মৃদু আলোয় কালো ছোট ট্রলিটা খুলে কি যেন দেখছে আর আস্তে আস্তে কাঁদছে!
রায়হান বুঝতে পারেনি তাঁকে শীলা দেখছে পেছন থেকে। শীলাও কোন শব্দ না করে খাটে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে, রায়হানের এই গোপন আবেগে ভাগ বসাতে চায়নি শীলা। সবারই কিছু নিজস্ব দুঃখ থাকে, শীলারও আছে। সেগুলো কারও সাথে বলা যায় না, ভাগাভাগি করা যায় না। জীবন সঙ্গির সাথেও না। কিন্তু তবুও ঘটনাটা কি জানার একটা তীব্র কৌতুহল ছিলো শীলার। আজ সুযোগ পেয়ে গেছে সে। গোপনে দেখে আবার রেখে দেবে, জেনে নেবে স্বামীর গোপন দুঃখের কথা। তারপর হয়তো আরও ভালোবাসতে পারবে রায়হানকে!
ট্রলিটিতে একটা ছোট তালা লাগানো, তালার চাবিটি রায়হান কোথায় রাখে শীলা এতো দিনে জেনে গেছে। সে জুতা রাখার সেলফ খুলে অনেক জুতা থেকে রায়হানের কালো এক জোড়া চামড়ার জুতা বের করে নিলো। তারপর উল্টিয়ে দেখলো জুতার তলায় সাদা স্কচটেপ দিয়ে ছোট চাবিটা লাগানো। টেপ খুলে চাবিটা নিয়ে বেড রুমে ফেরত আসলো সে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। হটাৎ তার মনে হলো কাজটা ঠিক হবে না। তার মন বললো, ‘সব গোপন জিনিস না জানাই ভালো, দেখিস না তুই! দেখিস না তুই!’
চাবিটা হাতে নিয়ে কতক্ষন বসে রইলো শীলা। তারপর নারী কৌতুহলেরই জয় হলো! আস্তে করে তালাটা খুলে ফেললো। ব্যাগের চেন খুলে দেখলো অনেক গুলো বড় ব্রাউন খাম। তখনো তার মন বলে চললো, “দেখিস না দেখিস না, রেখে দে যেমন আছে তেমন!” শীলা ততক্ষনে স্থির হয়ে গেলো সংকল্পে! প্রিয় স্বামীর গোপন আবেগের কথা দেখতেই হবে! হয়তো রায়হানের মৃত বাবা মায়ের ছবি লুকানো আছে খামগুলোর মধ্যে! নয়তো অতীতের প্রেমিকার ছবি! শীলাকে জানতেই হবে কি এমন জিনিস যা দেখে রায়হান স্থির থাকতে পারে না!
খামগুলো একে একে খুললো, গাড়ির কাগজপত্র, নদীতে ভেসে যাওয়া গ্রামের বাড়ির দলিল, রায়হানের বিভিন্ন সার্টিফিকেট, আরও নানান জিনিস। সবগুলো খাম দেখা হয়ে গেছে। তবুও তেমন কিছু পেলো না সে। খামগুলো সব বের করে ফ্লোরে রাখলো। ট্রলিটাকে আরও ভালো করে গোপন যায়গা আছে কিনা চেক করতে লাগলো। তখন হটাৎ হাতে শক্ত কি যেন লাগলো! ট্রলির নিচে যে সাঁটানো কাপড় থাকে তার ভেতর, একটা চেন আছে সেটা খুলতেই বেরিয়ে পড়লো এতোক্ষন শীলা যা খুজছে তা! একটা চ্যাপ্টা মাঝারী সাইজের কাঠের বাক্স। উপরে সুন্দর চিকন কাজ করা, যেন একটা জ্যামিতি বক্স!
শীলা বাক্সটা বের করলো। তার হাত কাঁপছে। ফ্যানের বাতাসে তার চুলগুলো চোখের সামনে দুলছে, বেয়াড়া মনটা তখনো বলছে, “খুলিশ না বাক্সটা, খুলিশ না, এখনো সময় আছে!” কিন্তু শীলা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে পাত্তা দিলোনা, দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বাক্সটা খুলে ফেললো শীলা!
২-
রায়হান এবং শীলার ছোট সুখের সংসার। প্রায় চার বছরের বিবাহিত জীবন তাঁদের। সব সুখেরই কিছু অসুখ থাকে, রায়হান শীলার অসুখ হলো তাঁদের কখনো বাবু হবে না। খুবই ভয়ংকর একটা ব্যাপার। এই অসুখের কারনেই দেশে কত সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রতিদিন, কিন্তু তাঁদের সংসার এখনো টিকে আছে এবং সেটা সম্ভবত সমস্যাটা রায়হানের বলেই! এমনিতে রায়হান সুস্থ সবল মানুষ, স্ত্রীকে তৃপ্ত করতে পারে, কিন্তু বিয়ের দু বছরের মধ্যেও যখন বাচ্চা হচ্ছে না দেখে ডাক্তারের কাছে চেক করালো দুজন, তখন ধরা পড়লো সমস্যাটা রায়হানের।
রায়হান বিষন্ন স্বরে বলেছিলো, “তুমি চাইলে আমাকে ছেড়ে যেতে পারো! আমার সাথে থাকলে তুমি কখনো মা হতে পারবে না”।
শীলা একেবারেই যে বিষয়টা নিয়ে ভাবেনি তা নয়, তবে শুধু মাত্র বাচ্চা দিতে পারছে না তাই রায়হানকে ছেড়ে গেলে ব্যপারটা শীলার জন্য ভালো হবে না! রায়হান তাঁকে জীবনের সব দিয়েছে, একটা ঘর দিয়েছে, সংসার দিয়েছে, স্বামীর ভালোবাসা দিয়েছে। জীবনে একটু নিশ্চিন্তে মাথা রাখার একটা প্রশস্ত বুক দিয়েছে!
শীলা যখন জীবনের ঘুর্নিঝড়ে দিশেহারা হয়ে এ দিকে সে দিকে ঠোক্কর খাচ্ছিলো তখনই রায়হানের সাথে পরিচয়। গ্রামের সহজ সরল মেয়ে ঢাকায় পড়াশোনা করতে এসে একজনের সাথে প্রেম এবং লিভ টুগেদারে ছিলো প্রায় দু বছরের। এক সময় সে গর্ভবতী হয়ে পড়লে যখন তার প্রেমিককে বিয়ের জন্য বলেছিলো তখন প্রেমিক পালিয়ে গেলো। লিভ টুগেদারের ব্যাপারটা ঘনিষ্ট কজন বন্ধু বান্ধবীই জানতো, প্রেমিক যখন পালিয়ে গেলো সে দিশেহারা হয়ে পড়লো। তার প্রেগনেন্সির খবর পৌঁছে গেলো বাড়িতে! তারপর যা হয়, বাবা মা খরচ বন্ধ করে দিলো, যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো! শীলার পাশে তখন কেউ ছিলো না!
শীলা যেদিন একা একা হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চাটা নষ্ট করিয়ে উবারে ফিরছিলো তার বাসায়, সেদিন সে তীব্র ব্যাথা এবং রক্ত ক্ষরণে উবারেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো। উবার ড্রাইভার তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো, সেই ড্রাইভারটাই হলো রায়হান। সেখান থেকেই পরিচিয়, জানা শোনা, প্রেম এবং সব শেষে শীলা চোখ বন্ধ করে নিজেকে শপে দিলো রায়হানের কাছে। সেই উবার চালক রায়হানই তার স্বামী! শীলার সব অতীত জেনে শুনেই তাঁকে আপন করে নিয়েছে, ভালোবেসেছে। রায়হান নিজেও বাউন্ডুলে মানুষ, আগে পেছনে কেউ নেই। দুজন শিকড়হীন মানুষের কষ্ট এবং ভালোবাসার বোঝাপড়া হতে বেশি সময় নেয়নি। শীলার বাবা মার সাথেও আর কখনো যোগাযোগ হয়নি। বাবা মা এখনো তাঁকে মাফ করতে পারে নি।
শীলা তখন ফোর্থ ইয়ারে। রায়হান অনেক বলেছিলো পড়াশোনা শেষ করতে কিন্তু শীলাই আর ভার্সিটিমুখো হয় নাই। জীবনের কষাঘাতে আর নিজের ভুলের মাসুল দিয়ে তার আর পরাশোনার মন রইলো না, তার মনে রইলো শুধু রায়হান। যে মানুষটা তাঁকে দুনিয়ার সব চেয়ে কঠিন মুহূর্তে আশ্রয় দিয়েছে, একটু সুখের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সে মানুষটাই তার ধ্যান জ্ঞান জুড়ে রইলো, তাঁকে আশ্রয় করেই বাকি জীবন কাটানোর প্রতিজ্ঞা করলো মনে মনে। পৃথিবীর জাগতিক সব লোভ, চাওয়া পাওয়া, চাহিদা সব বিসর্জন দিয়ে নিভৃতচারী একজন গৃহবধু হিসেবেই জীবন কাটনোর পণ করে বসলো।
রায়হানের তিন কুলে কেউ নেই। গ্রামের বাড়ি নদীতে ভেসে গেছে, সে সাথে তার স্থায়ী ঠিকানাও। তবে তার ব্যাংকে ভালো রকমের একটা এমাউন্ট আছে। মোটামুটি কিছু না করলেও সে টাকা নেড়ে চেড়ে খেলে জীবন চলে যেতো, তবে পুরুষ মাত্রই কর্মে পরিচয় তাই একটা গাড়ি কিনে ড্রাইভিঙের স্বাধীন পেশাটাই সে বেছে নিলো! দুটো মানুষের পিছুটানহীন পাখির মতো জীবন, সেটা বেশ সুখেই কেটে যাবে।
৩-
শীলা বাক্সটা খুলে ফেলে। ভেতরে একটা প্লায়ার্স (Pliers), লোকজন যাকে প্লাস বলে। সেটার সাথে টিস্যুতে মোড়ানো কিছু একটা। টিস্যুটা পুরনো, লাল হয়ে আছে, সম্ভবত ছোপ ছোপ রক্তে। আস্তে করে কাঁপা কাঁপা হাতে টিস্যুটা সরাতে শীলা দেখতে পেলো, অনেক গুলো দাঁত, মানুষের দাঁত!
শীলার হাত কাঁপছে, মাথা ঘুরাচ্ছে। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু শীলা নিজেকে সামলে নিলো। জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়ে মানসিকভাবে ভীষন শক্ত হয়ে যাওয় মানুষ সে। নিজেকে সামলাতে দুটা মিনিট সময় নিলো। তারপর দাঁতগুলো গুনলো, মানুষের সামনের দিকের চ্যাপ্টা দাঁতগুলো। সব মিলিয়ে একুশটা দাঁত। বুঝতে বাকি নেই এই প্লায়ার্স দিয়েই টেনে তোলা হয়েছে দাঁতগুলো! বাক্সটার তলার দিকে কিছু কাগজ প্লাসিটকের দিয়ে মোড়ানো। সেটা খুলে কিছু পেপার কাটিং পেলো শীলা।
একটা পেপার কাটিং খুলে দেখলো সে “ঢাকার এয়ার পোর্ট রোডের পাশের জংগল থেকে অজ্ঞাত তরুণীর (২৮) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ, পুলিশ ধারনা করছে তরুণীটি কোন গার্মেন্টসের কর্মী হবে। ধারনা করা হচ্ছে, রাতের আঁধারে তরুনীর লাশটি রাস্তার পাশে কেউ ফেলে যায়। পুলিশ জানিয়েছে হত্যাকারী তরুনীর সামনের দুটি দাঁত উপড়ে নিয়ে গেছে। লাশটি ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে রাখা আছে__________”
একে একে সবগুলো কাগজ সে খুলে দেখলো, প্রতিটাতেই প্রায় একই রকম খবর, ঢাকার বিভিন্ন নির্জন রাস্তায় বিভিন্ন তরুণীর লাশ পাওয়ার খবর।
শীলার পিঠ দিয়ে হিম শীতল স্রোত বয়ে গেলো, গত চারটা বছর সে তাহলে একজন সিরিয়াল কিলারের সাথে সংসার করছে!
৪-
সকালে রায়হান গাড়ি গ্যারেজে রেখে ঘরে ফিরে আসে। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার লক খোলে। এই সময় শীলা ঘুমিয়ে থাকে। রায়হান তাঁকে জাগায় না। শীলা টেবিলে রাতেই সকালের জন্য খাবার ঢেকে রেখে দেয়। রায়হান প্রতিদিনকার নিয়ম মতো ঘরে ঢুকে আস্তে আস্তে বেড রুমে ঢোকে, ভোরের আলোয় দেখতে পায় শীলা ঘুমাচ্ছে। রায়হান আস্তে করে শীলার কপালে চুমু খায়।
ঠোঁট দিয়ে শীলার কপাল স্পর্শ করতেই রায়হানের শরীর শক্ত হয়ে যায়! “শীলা ঘুমাচ্ছে না, ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছে!”- রায়হানের সহজাত ইন্দ্রিয় রায়হানকে সতর্ক করে দেয়, সাধারণত এই সময় শীলার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। গত চার বছর ধরেই দেখছে সে। কিন্তু আজ কপালের গরমটা রায়হানের ঠোঁটে লাগতেই রায়হান সতর্ক হয়ে পড়ে। আড়চোখে শীলার বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে, তারপর তার ডান হাতটা শীলার বুকের বাঁ পাশে আলতো করে রাখে, শীলার হৃদপিন্ডটা যেন ফেটে যাবে, এতো দ্রুতলয়ে উঠানামা করছে।
রায়হান কিছু না বলে বেরিয়ে আসে। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নেয়। ডাইনিং এ বসে এক মনে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া খাবার খায়। তারপর আস্তে করে জুতার সেলফটা খুলে, কালো জুতাটা হাতে নিয়ে তার তলার দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। চাবিটা আছে ঠিক যায়গা মতো, কিন্তু রায়হান যেভাবে রাখে ঠিক সেভাবে নেই। উল্টো করে রাখ হয়েছে। রাতে তার অনুপস্থিতিতে কি সর্বনাশ ঘটে গেছে রায়হান বুঝতে পারে। রায়হানের চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে কালো জুতার তলায় লেপ্টে যায়। জুতাটা রেখে আবার ডাইনিং এ এসে ফ্যানের নিচে বসে। তারপর আপন মনে ভাবতে থাকে কিছুক্ষন।
তারপর বেড রুমে গিয়ে আবার কাপড় পরে নেয়। শীলাকে ডেকে তোলে সে, বলে, “একটা জরুরী ট্রিপ আছে। সেটাতে যেতে হবে”।
শীলার চোখ লাল, সে চোখ সতর্ক। রায়হান মৃদু হেসে বলে, “রাতে ঘুমাওনি বুঝি! এখন ঘুমাও। আমার ফিরতে সন্ধ্যা হবে”। তারপর শীলার গালে হাত বুলিয়ে দেয়। কোমর ধরে টেনে ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে বলে, “অনেক ভালোবাসি তোমাকে”।
অন্যদিন হলে শীলার শরীর নরম হয়ে যেতো এতটুকুন আদরে, কিন্তু আজ তার মাংসপেশি শক্ত হয়ে রয়েছে। রায়হান তারপর কিছুক্ষন শীলার নির্ঘুম লাল চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘুরে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। শীলা দেখতে পেলো না, সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় রায়হান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে!
৫-
শীলা হয়তো ভীষন আবেগী এবং অভিমানী মেয়ে তবে সে বুদ্ধিমতী! সে তার করনীয় ঠিক করে ফেললো, রাতেই ঐ দাঁত এবং পেপার কাটিং এর ছবি ফোনে তুলে রেখেছিলো প্রমাণ হিসেবে। তার ভার্সিটি লাইফের বন্ধু সাব্বির, শুনেছে সে এখন পুলিশে আছে, তাঁর সাথে সবার আগে শেয়ার করবে ব্যাপারটা। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রায় কারও সাথে যোগাযোগ নেই, শীলার কোন ফেসবুক একাউন্ট নেই বলে হুট করে সাব্বিরের ফোন নং এখনো জোগাড় করতে পারেনি। কখনো ভাবেনি যে আবার কোন দিন বন্ধু বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাঁর। যে কয়েকজনের নাম্বার শেষ পর্যন্ত ছিলো তাঁদের ধরে সাব্বিরের নাম্বার জোগাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখনো হাতে পায়নি সে।
রায়হান আসার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। এক পলকে তাঁর জীবন আবার শুন্য হয়ে গেলো ভেবেই চোখে জল জমে যাচ্ছে! গতকালও তাঁর স্বামী ছিলো, স্বামীর আদর ছিলো, ভালোবাসা ছিলো! কিন্তু এক রাতেই সেই আদর সে ভালোবাসা সাপের বিষের মতো বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে! খালি মনে হচ্ছে রায়হান যদি বুঝতে পারে শীলা সব জেনে গেছে কোনভাবেই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে না সে!
দুপুরের একটু আগে হটাৎ একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসলো শীলার নাম্বারে। ফোনটা রিসিভ করতেই একটা মার্জিত গম্ভীর কন্ঠ বলে উঠলো, “হ্যালো, আপনি কি মিসেস রায়হান বলছেন?”
শীলা বললো, “হ্যাঁ আমি মিসেস রায়হান বলছি”।
ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, “আপনাকে একটা ব্যাড নিউজ দেওয়ার জন্য ফোন করেছি। আমি ডাঃ শহীদ বলছি ঢাকা মেডিক্যাল থেকে। আপনার হাজব্যান্ড একটু আগে গাড়ি একসিডেন্ট করেছেন। দয়া করে একটু ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে এসে লাশ সনাক্ত করে যাবেন প্লিজ। পুলিশ এসে গেছে এখানে। আপনি হাসপাতালের সামনে এসে আমার নাম্বারে একটা ফোন দিন”।
বলেই ফোনটা কেটে দিলেন ওপাশে থাকা ডাঃ শহীদ। শীলা ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লো! সে যেন অনুভূতি শূন্য একজন মানুষ, দাঁতে দাঁত চেপে ধরায় গালের একটা কোনা কেটে রক্ত বেরিয়ে পড়লো ঠোঁটের কোনা বেয়ে, কিন্তু চোখের কোনায় জল জমলো না তার! সে তো সর্বোচ্চ দিয়ে রায়হানকে ভালোবাসতো, তার জন্য জীবনটা সে উৎসর্গ করে দিয়েছিলো প্রায়, তার জীবনে দ্বিতীয় কোন মানুষ ছিলো না, বন্ধু বান্ধবী ছিলো না, বাবা মা ছিলো না- কেউ ছিলো না কিচ্ছু ছিলো না! ছিলো শুধু রায়হান এবং তার ভালোবাসা! আজ এক দিনে তার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান দুটো জিনিস হারিয়ে সে কি অনুভব করবে সেটাই যেন বুঝে উঠতে পারছে না!
একটু পর পাগলের মতো ফোনটা নিয়ে রায়হানকে ফোন দিলো, বলতে ইচ্ছে করলো, রায়হান তুমি ফিরে এসো তুমি যাই হও আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি খুনি হও চোর হও ডাকাত হও যাই হও আমি তোমাকে ভালোবাসি! আমি কিচ্ছু চাই না তুমি ফিরে আসো আমার বুকে! কিন্তু বলা হলো না কথাগুলো, রায়হানের মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে।
৬-
জ্যাম ঠেলে দুপুরের একটু পর শীলা ঢাকা মেডিক্যালে পৌছালো। গত সারা রাত সে ঘুমায়নি, একটার পর পর একটা ঘটনা যেন তার প্রাণ শক্তি চুষে নিয়ে গেছে। যোদ্ধা মেয়েটা যেন এখন প্রায় পরাজিত এক সৈনিক।
ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ডাঃ শহীদের নাম্বারে ফোন দিলো। দু মিনিট পরেই সুদর্শন একজন ভদ্রলোক গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে শীলার সামনে এসে দাঁড়ালেন, “স্যরি মিসেস রায়হান, আপনাকে এতো কষ্টের নিউজটা আমাকে দিতে হলো আপনাকে। আপনি আমার সাথে আসুন, মর্গে রায়হানের লাশ রাখা আছে। ওখানে পুলিশ আছে, আপনি সনাক্ত করে দিলে তারাই বাকি ফর্মালিটি শেষ করে দেবে”। বলে ডাঃ শহীদ আস্তে করে হাঁটা ধরলেন। শীলাও তার পেছনে এলোমেলো পায়ে হাঁটা ধরলো।
ঢাকা মেডিক্যাল মর্গের কয়েকটা অংশ, দুর্ঘটনার লাশগুলো যেখানে রাখে সে অংশটা মূল বিল্ডিং এর পেছনে গাছপালা ঘেরা একটু নির্জনে। মর্গের দরজা খুলে ডাঃ শহীদ বললেন, “আপনি আসুন আমার সাথে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পুলিশের লোকজন বোধহয় চা খেতে গিয়েছে”। বলে ভেতরে ঢুকে পড়লো ডাঃ শহীদ। শীলা তার পেছনে পেছনে ঢুকে গেলো ভেতরে। স্টেইনলেস স্টিলের খাটের উপর এবং নিচের ফ্লোরে প্রায় ৬/৭ টা লাশ রাখা। লাশগুলো পুরাতন বহুল ব্যবহৃত চাদর এবং দাগে ভরপুর সাদা চাদরে ঢাকা। ডাঃ শহীদ রুমের শেষে প্রান্তে একটা লাশের মুখের কাপড় একটু সরিয়ে শীলাকে ডাকলো, “দেখুন তো ইনিই কি মিস্টার রায়হান?”
শীলা ভীরু পায়ে এগিয়ে গেলো, ডাঃ শহীদকে পাশ কাটিয়ে লাশটার কাছে গিয়ে লাশের মুখের দিকে তাকালো সে ভাল করে! “আরে ! এতো রায়হান নয়! তাহলে কে এই লাশ!”- বিস্ময়ে ডাক্তার শহীদের দিকে ফিরে তাকাতে যাবে আর এই সময় কে যেন পেছন থেকে একটা ধাতব শীতল লোহার তার গলায় প্যাচিয়ে দিলো, তারপর শক্ত করে হ্যাচকা টান মেরে শীলার গলার চামড়া কেটে বসিয়ে দিলো তারটা। বিস্ফোরিত চোখে খানিক ঘুরে তাকিয়ে আততায়ীকে দেখতে চাইলো শীলা, দেখলো ডাঃ শহীদ নামের লোকটা দাঁতে দাঁত চেপে প্রতি সেকেন্ডে লোহার তারটায় একটু একটু করে চাপ বাড়াচ্ছে!
৭-
সন্ধ্যায় ঝুম বৃষ্টি নামলো। রায়হান জ্যামে বসে আছে তার গাড়ি নিয়ে, পাশের সিটে তার বন্ধু সজীব। সজীব ঢাকা মেডিক্যালের মর্গের ডোম। সুদর্শন সজীবকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে এমন একটা পেশা বেছে নিয়েছে, গলায় একটা স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে দিলেই ডাক্তার বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায় তাকে। রায়হান যখন বুঝতে পারলো শীলা সব জেনে গেছে বুঝে গেছে তখন সে সজীবকে জানায়, সজীবই বাকি প্ল্যান করে দেয় রায়হানকে।
সজীব বললো, “শীলার লাশটার ব্যাবস্থা করে ফেলেছি। ওটা নিয়ে টেনশন করতে হবে না তোর”।
রায়হান বললো, “শীলার ফোনটা?”
“ওটাও এসিডে চুবিয়ে দিয়েছি লাশের সাথে, আর আমি যে ফোনটা দিয়ে শীলাকে ফোন দিয়েছি সেটাও সেখানে আছে। পুলিশ তোর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না কোন দিন”।
এক মিনিট চুপ করে রইলো রায়হান। তারপর বললো, “আমি ভালো হয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ইশ যদি ঐ দাঁতগুলো ফেলে দিতাম তাহলে হয়তো শীলাকে সারাজীবন ধরে নিজের করে রেখে দিতে পারতাম!” – বলে হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো সে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সজীব, “কাঁদিস না দোস্ত। মন খারাপ করিস না। যে পথে আমরা চলেছি অতীতে, সে অতীত কোনদিন আমাদের পিছু ছাড়বে না। এভাবেই চলতে হবে। এটাকেই মেনে নে। তোকে যা বলে দিয়েছিলাম মনে আছে তোর? আবার বল, তোর এখন কি করতে হবে?”
রায়হান বললো, “আমি বাসায় যাবো। গিয়ে শীলাকে খোঁজ করবো প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করবো। মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে থানায় যাবো জিডি করতে”।
সজীব বললো, “যে ফোন দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করিস সেটা ফেলে দে, ঝামেলা ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে যোগাযোগ করার দরকার নাই। যতদিন লাগুক। ঝামেলা ঠান্ডা হলে নতুন ফোন কিনিস। আর কোন ইমার্জেন্সি কথা থাকলে সোজা হসপিটালে চলে আসবি। মনে থাকবে?”
রায়হান বললো, “হু”।
সজিব পকেট থেকে টিস্যু মোড়ানো কিছু একটা বের করলো। টিস্যুতে লাল রক্ত লেগে আছে ছোপ ছোপ। সেটা খুলতে দুটো সাদা দাঁত বের হয়ে এলো। গাড়ির টিস্যু বক্সটা থেকে নতুন একটা টিস্যু নিয়ে সেখানে একটা দাঁত রেখে ভাঁজ করে রায়হানকে দিলো, “এই নে তোরটা। মন শক্ত রাখ। শীলা তোর কাছেই আছে। সে যায়নি কোথাও! নে ধর”
রায়হান টিস্যুটা নিয়ে নিলো। জ্যাম এখনো ছাড়েনি। রায়হানের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো রায়হানের পরম বিশ্বস্ত বন্ধু, তার করা সব খুনের পার্টনার বাল্য বন্ধু সজিব। রায়হান মুঠোতে শীলার দাঁতটা ধরে আছে, তার চোখে শীলাকে হারানোর বেদনার জল।
৮-
এস আই সাব্বির সকাল বেলা তার টিমকে নিয়ে টহলে বেরিয়েছে। এমন সময় একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো, ফোনটা ধরে বললো- “হ্যালো এস আই সাব্বির বলছি, আপনি কে বলছেন?”
“দোস্ত, আমি সাথী বলছি”।
সাব্বির চিনতে পারলো সাথীকে, তার ভার্সিটির বান্ধবী। হটাৎ কি মনে করে ফোন দিয়েছে কে জানে! “হ্যাঁ দোস্ত বল, খবর কি তোর?”
“আমি ভালো আছি। শোন একটা জিনিস জানানোর জন্য তোকে ফোন দিসি, আমাদের ব্যাচমেট শীলাকে তো চিনিতি, ঐ যে ফোর্থ ইয়ারে যে পড়াশোনা ছেড়ে দিসিলো সে।“
“হ্যাঁ চিনি তো, কি হইছে তার? তার সাথে তো আর কোন যোগাযোগ নেই। ফেসবুকও ইউজ করে না সে, কেমন আছে সে?”
“আরে শোন কি হইছে, মাস খানেক আগে একদিন কোত্থেকে আমার নাম্বারে শীলা ফোন দিয়ে তোকে খুজতেসিলো, বললো দোস্ত আমি একটা বিশাল ঝামেলায় পড়ে গেছি, আমাকে পুলিশে আছে যে বন্ধু সাব্বির তার নাম্বারটা জোগাড় করে দে। আমি তখন তোকে ফেসবুকে মেসেজ দিসিলাম তোর নাম্বারের জন্য, তুই তো অনেক দিন ফেসবুকে আসিস নাই তাই হয়তো রিপ্লাইও দেস নাই।“
“একট ট্রেনিং এ ছিলাম দোস্ত, তাই ফেসবুক থেকে দূরে ছিলাম। শীলার কি হইছে?”
“তো পরে তুই রিপ্লাই দেস নাই দেখে আমিও পরে ভুলে গেছি। এরপর হটাৎ দু দিন আগে শুনলাম যে দিন আমাকে শীলা ফোন দিসিলো তোর নাম্বারের জন্য সেদিনই শীল নিখোঁজ হয়ে গেছে। তার স্বামী থানায় মামলা করেছে, কিন্তু পুলিশ এখনো তাকে খুঁজে পায় নাই। শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষন, সেদিন যদি তোকে কোন মতে শীলার সাথে আমি কথা বলিয়ে দিতে পারতাম তাহলে হয়তো শীলা এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারতো না।“
সাব্বিরের মনটা খারাপ হয়ে গেলো, শীলা অনেক মেধাবী এবং ভালো একটা মেয়ে ছিলো। মেয়েটার লাইফে একটা ট্রাজেডি আছে সে জানে। সাব্বির বললো, “আচ্ছা আমি খোঁজ নিচ্ছি। আর কি বিপদ সেটা নিয়ে তোকে কিছু বলেনি?”
“না তেমন কিছু তো বলেনি, যতটুকু মনে পড়ে কথায় কথায় এটুকু বলেছিলো, “দেবতার মুখোশের আড়ালে শয়তান বাস করলে ভক্তের জীবন নাশ হবার আশংকা আছে বৈকি”! এরকম কিছু একটা বলেছিলো! তুই একটু দেখ তো দোস্ত, মেয়েটার জন্য ভীষন খারাপ লাগছে!”
ফোনটা রেখে সাব্বির একটা সিগারেট ধরালো। শীলার জন্য খারাপ লাগছে, ভার্সিটির সময়ে মেয়েটার বিপদের সময় তারা কোন বন্ধুই তার কোন উপকার করতে পারেনি। সবার ফাইনাল এক্সাম নিয়ে টেনশন ছিলো, সবাই স্বার্থপর ছিলো যেন! নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো! সাব্বির সিগারেটটা অর্ধেক খেয়েই ফেলে দিলো, পকেট থেকে ফোনটা বের করলো আবার, ঐ থানায় ফোন দিয়ে মামলাটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে, সেখানে তার ব্যাচ মেট আছে একজন, শীলার জন্য জীবনে কোন কিছু করতে পারে নি তারা বন্ধুরা কেউ, এই সময়ে যদি শীলার জীবনের দেবতা রূপি শয়তানটাকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারে তাহলে হয়তো শীলাকে খুঁজে বের করা যাবে।
ফোনটায় ব্যাচমেট বন্ধুর নাম্বারে ফোন দিলো, ওপাশে রিং হচ্ছে।