জাহাজের চাকুরীটাই জানি কেমন, যাযাবরের মত ঘুরে চল সারাজীবন। আজ এই দেশে কাল ঐ দেশে, নীল পানির বুক চিরে ছুটে চল একদেশ থেকে অন্য দেশে। গতিতেই জীবন জাহাজীদের, ছুটে চলছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিরামহীন ভাবে।
মাঝে মাঝে মুহিনের এই জীবন নিয়ে হাফিয়ে উঠে। উফ! এভাবে সম্ভব না। এটা কোন কথা হল? খালি ছুটে বেড়াও আজ এই দেশে কাল ঐ দেশে!
এই কথা সে বলেছিল তার জাহাজের মাঝ বয়সি সিঙ্গাপুরিয়ান ক্যাপ্টেনকে। ক্যাপ্টেন হেসে বলেছিল- “হেই থার্ডমেট, সি লাইফ তো মাত্র শুরু করেছ, আরও কিছুদিন কর, তখন দেখবে দেশে গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারবে না, হাফিয়ে উঠবে তুমি”।
মুহিন মুখে স্বীকার না করলেও সে জানে দেশে গিয়ে বেশি দিন ভাল লাগে না। দেশে যাবার পরে ডাঙ্গার কিছু মানুষের হীনমন্যতা, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সর্বোপরি পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা দেখলে মুহিনের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়ে যায়। তখন সাথে সাথে বিভিন্ন শিপিং এজেন্সিতে ফোন করে জয়েনিং নিশ্চিত এবং কিছুদিন পরে জাহাজে জয়েনের উদ্দেশে বিমানে উঠার পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথম যে কথাটা মুখ দিয়ে বের হয় তা হল- যাক বাবা, বড় বাঁচা বেঁচেছি!
মুহিনের জীবন চলছে এভাবে কিছুদিন জাহাজে কিছুদিন দেশে। মাঝে মাঝে অনেক ভাল লাগে তার- এই জীবন খারাপ কি? ছুটে চলার মাঝেও একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। যে পায় সে জানে।
মজার ব্যাপার হল সদ্য প্রোমোশন পাওয়া থার্ড অফিসার মুহিনের চেহারাটায় এখনো কিশোর কিশোর ভাব স্পষ্ট, শ্যাম বর্ণের এই যুবকটির কাল চোখে তাকালে দেখা যায় সাগরের বিশালতা, কোন এক সময়ে কোন এক কিশোরী অভিমান করে বলেছিল- “মুহিন, তুমি কখনো আমার সামনে এলে সানগ্লাস পরবে না, আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই, বুঝতে চাই আল্লাহ কেন ঐ চোখে এত মায়া ঢেলে দিয়েছেন’!
সময়ের স্রোতে সে মানুষটি আজ অনেক দূরে, মুহিন মাঝে মাঝে ভাবে তার সব প্রিয় মানুষ কেন হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে? আন্তঃ মহাসাগরীয় স্রোতের মত সময়ের স্রোত কেন প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে যায় যোজন যোজন দূরে!
মুহিনের জাহাজ এখন মাঝ সাগরে। কয়েকদিন পরেই তার জাহাজ পোর্টে গিয়ে পৌঁছাবে। এখন মুহিনের মন খুব ভাল, কারন সামনের পোর্টে তার সাইন অফ হবে। একটু আগে ক্যাপ্টেন কনফার্ম করেছেন।
বাহ! কি মজা! ভাবল মুহিন। কদিন পরেই দেশে যাবে সে, পরিচিত মুখ আর বাবা মায়ের আদরে হারিয়ে ফেলবে নিজেকে যদিও জানে কিছুদিন পরে ওটাও ভাল লাগবেনা।
সত্যি কথা বলতে কি যার শরীরে মাঝ সাগরের নোনা বাতাস লেগেছে সে ডাঙায় বেশিদিন থাকতে পারে না, হাঁসফাঁশ করে উঠে মন।– এ ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় মুহিন।
রাত ১২ টায় ডিউটি অফ করে ব্রিজ থেকে নিজের কেবিনে আসে মুহিন। ইউনিফর্ম ছেড়ে ফ্রিজ থেকে একটা কোকের ক্যান খুলে একটা সিগারেট জ্বালায় সে। তারপর সোফায় বসে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে আগামি দুই দিনের কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করে নেয়। সে যেহেতু জাহাজের সেফটি অফিসার তাই জাহাজের সেফটি ইকুপমেনট গুলো আবার চেক করে দেখতে হবে সব ঠিক আছে কিনা। তারপর তার রিলিভারকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ডিউটি হ্যান্ড ওভার করে সোজা নেমে যাবে সে।
সিগারেট শেষ করে নিজের লকার খুললো মুহিন, ট্রলি ব্যাগটা বের করল। ধুলা জমেনি, সব ঠিক আছে। ট্রলি খুলে ওটার একটা পকেটে দেখল মোটাসোটা একটা ডাইরি, অনেক পুরাতন।
"ওহ! এটা তো আমার ডাইরি!"- অবাক হয়ে গেল মুহিন, এটাকে সে বাসায় রেখে এসেছিল মনে আছে। কোন ফাকে আবার ট্রলিতে রেখেছে এটা মনে করতে পারল না সে। মুহিনের ডাইরি লেখার অভ্যাস তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। এই ডাইরিটা অনেক অনেক আগের সেই ছোট বেলায় লেখা যখন এই থার্ড অফিসার মুহিন ক্লাস ফাইভে পড়ত! ডাইরি কিন্তু প্রতিদিন লিখত না, শুধু স্পেশাল কথাগুলো লিখত,আজ কার সাথে ঝগড়া হয়েছে, স্কুলে কি কি হয়েছে এই সব হাবিজাবি। এই ডাইরিটা লুকিয়ে লুকিয়ে লিখত সে। এই ডাইরিটা মুহিনের মা সযত্নে তুলে রেখেছিলেন নিজের ছেলের বউকে দেখাবেন বলে!
ডাইরিটা টেবিলে রাখল মুহিন। অনেক দিন এই ডাইরিটা পড়া হয় না তার। আবার একটা সিগারেট জ্বালিয়ে সোফায় বসল, জাহাজে যদিও এসি চলছে পুরোদমে তবুও জাহাজের পোর্টহোল খুলে দিল সাথে সাথে একঝাক ভেজা নোনা বাতাস ঢুকে পড়ল মুহিনের ক্যাবিনে। এলোমেলোভাবে উল্টিয়ে দিল ডাইরির কয়েকটা পৃষ্ঠা। যে পৃষ্ঠা খুলে পড়ল তার তারিখ ০৩-০১-১৯৯৮! নিজের বাচ্চা হাতের এলোমেলোভাবে লেখা সেই ডাইরিটা পড়তে শুরু করল মুহিন।
۞ ০৩-০১-১৯৯৮
উফ কি যে ঠাণ্ডা পড়ছে! এই সপ্তাহে বাবা আসলে বাবাকে বলব একটা নতুন সুয়েটার কিনে দিতে। আপুটা অনেক শয়তান হয়ে গেছে, আব্বুর কাছে শুধু আমার নামে বিচার দেয়। তাই আজ অনেক মেরে দিয়েছি।
[সম্প্রসারন- মুহিনের পরিবার গ্রামের মধ্যবিত্ত একটা পরিবার। বাবা চাকুরির জন্য শহরে থাকেন। মুহিন অনেক দুষ্টু ছিল সে সময়, তাই তার বাবা তার বড় বোনকে দায়িত্ব দিয়েছিল যে মুহিন যদি কোন দুষ্টামি করে তাহলে তা লিখে রাখতে। সুমিও তার দুষ্টু ছোট ভাইকে বেকায়দায় পেয়ে একদিনে ৫৭ টা দুষ্টামির কথা লিস্টে লিখেছিল। মুহিন দেখল যে এমনেও গেছি অমনেও গেছি তাই সে লিস্টির কথা ভুলে বড়বোনের চুল টেনে দিল, পিঠে দুমাদুম করে চার পাঁচটা কিল মেরে যখন নিজের রাগ কমল তখন দৌরে পালিয়ে গেল। বেচারা বড় বোন কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গেল ছোট ভাইয়ের নামে নালিশ করতে ! ]
۞ ০৬-০১-১৯৯৮
আজ হিন্দু বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়েছিলাম, হিন্দু বাড়ির মনি বৌদি তার একটা কুকুরের বাচ্চা দিলেন আমাকে। বাচ্চাটার রঙ লাল, দেখতে এত মিষ্টি কি বলবো! গুটুগুটু লাগে কুকুরটাকে! শরিফ আর আমি একটা বাসা বানিয়েছিলাম কুকুরের বাচ্চাটার জন্য। আম্মু খুব রাগ করেছে। যাই হোক আমি একে পালব, একে আমি অনেক বড় করব। মনি বৌদি আমাকে খালি দেওরা দেওরা করে, আমার কেন জানি খুব লজ্জা করে। দেওরার মানে কি? আম্মুকে জিজ্ঞাস করতে হবে।
[সম্প্রসারন- মুহিনদের বাড়ি গ্রামে। তাদের বাড়ির একটু পরেই একটা হিন্দু বাড়ি আছে। ঐ বাড়ির সবাই মুহিনকে আদর করে। ঐ বাড়ির পাসেই একটা ক্ষেতে ক্রিকেট খেলে মুহিনরা। গ্রামের দুষ্টু ছেলেদের সর্দার হল মুহিন। যেহেতু মুহিনের ব্যাট মুহিনের বল তাই মুহিন সবসময় ওপেনিং ব্যাটিং আর বলিং করে! তার অন্য শাগরেদরা এটাকেই সহজ ভাবেই নেয়। নেতা বলে কথা! মুহিনের ডান হাতের নাম শরিফ, রোগা পটকা এই ছেলেটি মুহিনের সব কাজের সঙ্গি। মুহিন যা করতে বলে সে সব করে খুব আগ্রহ করে। মনি বৌদি হিন্দু বাড়ির একজন বিবাহিতা নারি, উনি একটা মেয়ে কুকুর পালেন, প্রতি বছর বছর ঐ কুকুরটা বাচ্চা দিলে উনি অগুলো মানুষকে দেন পালার জন্য, এতে যে উনি কি মজা পান কে জানে! মানুষরা যখন কুকুরের বাচ্চা নিয়ে যান তখন তার চোখ ছলছল করে! উনি মুহিনকে দেওরা বলে ক্ষেপান! দেওরা বললে মুহিনের মুখ লজ্জায় টমেটোর মত লাল হয়ে যায় ! ]
۞ ০৮-০১-১৯৯৮
আমার ছোট ফুফু অনেক ভাল! আম্মুকে ছোট ফুফু রাজি করিয়েছেন কুকুরটা পালার ব্যাপারে। আম্মু বলেছেন কুকুরের বাচ্চাটা যদি ঘরে ঢুকে আম্মু এটাকে একটা আছাড় মারবেন। আমি, আপু, ছোট ফুফু আর শরিফ এটার নাম ঠিক করেছি “টমি”। নামটা আমার অনেক ভাল লাগে। টমিকে বেঁধে রাখতে হচ্ছে, সারাদিন কাইকুই করে বাচ্চাটা। ওর মায়ের কাছে যেতে চাইচে। আমার খুব কষ্ট লাগে। ছোট ফুফুকে বলতেই সে কুকুরটার ঘাড়ের লোম উঠানে পুঁতে দিল আর কিছু লোম ভাতের সাথে মিশিয়ে সেই ভাতের থালার লোভ দেখিয়ে টমিকে পুরো বাড়ি ৩ বার চক্কর দেওয়ালো তারপর ওকে ঐ ভাত খাইয়ে দিল! ফুফু বলল- এটা করলে কুকুর আর আমাদের বাড়ির মায়া ছাড়তে পারবে না, সে সারাজীবন থেকে যাবে। আমার ছোট ফুফু অনেক ভাল।
۞ ১৩-০১-১৯৯৮
ফুফুর কথা লেগে গেছে! টমি এখন আর কাইকুই করে না। সে আমাদের বাড়িতেই থাকে। দড়ি খুলে দিয়েছি। টমি আম্মুর পিছে ঘুরে সারাদিন, আম্মু ওকে দুই চোখে দেখতে পারে না! আমরা সবাই মিলে ওর জন্য একটা ঘর বানিয়েছি বাঁশ দিয়ে!
۞ ১৯-০১-১৯৯৮
টমির জন্য আমার একটা পুরান বেল্ট ওর গলায় বেঁধে দিয়েছি। রহিম কাকার দোকান থেকে একটা ঘুঙ্গুর এনে বেল্টে লাগিয়ে দিয়েছি। ও ঘার নাড়ালে ঝুনঝুন করে ওটা বাজে! অনেক ভাল লাগে আমার! ও যখন রাস্তা দিয়ে আমার সাথে হাটে মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে!
۞ ২৬ -০১-১৯৯৮
টমি আম্মুকে ছাড়া কিছু বুঝে না। ও আম্মুর সাথে আম্মুর স্কুলে যায়, আম্মুর স্কুলের সামনে বসে থাকে দুই পা ছড়িয়ে। আবার আম্মুর স্কুল শেষ হলে আম্মুর সাথে সাথে বাড়ি আসে। এখন দেখি আম্মুও টমিকে আদর করতে শুরু করেছে! আমার কুকুর আমার সাথে থাকে না কেন???
۞ ০৮-০২-১৯৯৮
আম্মুর পিছ ছেড়ে এবার টমি লেগেছে আপুর পিছে। আপু টমিকে দুই চোখে দেখতে পারে না, বলেছে পাউরুটিতে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দিবে। আমি তো ভয়েই আছে। আমার টমির কিছু হলে আমি মরে যাব। কিন্তু এখন আম্মুর পিছ ছেড়ে টমি আপুর সাথে আপুর হাইস্কুলে যায়। আপু কয়েকবার লাঠি নিয়ে দৌড়ান দিয়েছিল কিন্তু একটু দূরে গিয়েই আবার আপুর পিছে পিছে চলে আসে। আপু তো রেগে আগুন। আপুর স্কুলে আপুর নাম পড়েছে “কুত্তাওয়ালি সুমি”! আপুদের স্কুলে দুইজন সুমি, একজন “সুরমা সুমি” কারন ওনার বাবার একটা বাস আছে নাম সুরমা, আমার আপুর আগের নাম ছিল শুধু সুমি এখন হয়েছে “কুত্তাওয়ালি সুমি”! আপু বাসায় এসে কান্নাকাটি করে অস্থির। আমি মনে মনে খুশিই হয়েছি!
۞ ১৯-০২-১৯৯৮
আজ আপু টমিকে অনেক আদর করতে শুরু করেছে! গতকাল টমি আপুর সাথে স্কুলে যাওয়ার পরে এক কাণ্ড করে বসল। আসার সময় আপুর পায়ের উপর এসে শুয়ে পড়ল। আপু কষে একটা লাথি মেরেছিল কিন্তু ওর সরার নাম নেই যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। শেষে আপু পুরো রাস্তা টমিকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে আসল! এসে আচ্চা করে গোসল করার সময় বলল - ঐ হারামদাকে আমার সামনে আসতে মানা কর, ওকে সামনে পেলে আমি খুন করব!
আমি তো ভয়েই ছিলাম পরে বিকালে দেখি আপু টমিকে পিঠে হাতে বুলিয়ে আদর করছে! যাক, বিপদ কেটে গেছে!
۞ ১৫-০৩-১৯৯৮
টমি খুব মোটা হয়ে যাচ্ছে! শয়তানটা সারাদিন খালি খায় আর খায়। ছোট ফুফু বলেছে যে কুকুদের বেশি খাওয়ালে ওরা অলস হয়ে যায়, তখন নাকি ওরা চোর দৌড়াতে পারে না! তাই ওদের খাওয়তে হয় পরিমান মত। আজকে থেকে ওর খাওয়া কমিয়ে দিলাম।
۞ ২৬-০৪-১৯৯৮
ছোট ফুফু যে কি না, বলে টমির লেজ কেটে ছোট করে দিতে! লেজ কাটা কুকুর নাকি অনেক ক্ষিপ্র হয়! আমি রাজি হইনি। ফুফু বলল- “মুহিন,তোর কুকুর দেখবি মিস্টার বিনের মত হবে, পুরা বেকুব, দে ওর নেঞ্জা কেটে দে’!
আমি তবুও রাজি হই নাই। আমি জানি টমি কি! ওর ভেতর আগুন আছে। ছোট কুকুর বলে বুঝতে পারছে না ফুফু। মাঝে মাঝে ফুফুটাকে এত বোকা মনে হয় কি আর বলব!
۞ ০৮-০৫-১৯৯৮
টমিকে আজ আমার পুরাতন একটা হাফপেন্ট আর সার্ট পরাইচিলাম! ওকে এত বেকুবের মত লাগছিল আর কি বলবো! বাড়ির সবাই হাসতে হাসতে শেষ। আমার দাদাজানও অনেক হেসেছেন! টমি অবশ্য বেশিখন জামা গায়ে রাখেনাই। একটু পরে কামড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে!
۞ ১৯-০৬-১৯৯৮
টমি অনেক বড় হয়ে গেছে!
আজ আমি ফুফু আপু আর আমার ছোট ভাই টমিকে ধরে ওর কান ফুঁড়িয়ে দিয়েছি! তারপর ফুফুর একটা কানের দুল ওখানে পরিয়ে দিয়েছি! এত সুন্দর লাগছে টমিকে! ইচ্ছে করছে সারাদিন কোলে নিয়ে বসে থাকি।
۞ ১০- ০৭-১৯৯৮
আজ টমি আমার সাথে আমার স্কুলে গিয়েছিল, সেখানে আমাদের ক্লাসের একটা মেয়েও কুকুর নিয়ে স্কুলে আসে। বড় কুকুর মেয়েটার। ঐ মেয়ের কুকুরের সাথে আমার টমি মারামারি লেগে গিয়েছিল! আমি কিছু না শুধু ঐ মেয়ের কুকুরকে দেখিয়ে বলেছিলাম- ছু, টমি ছু!
আর টমি গিয়ে ওর গায়ের উপর লাফিয়ে পড়েছে! কিন্তু ওটা টমির সাথে পারে নাই! টমির গায়ে অনেক শক্তি!
ঐ মেয়ে খুব খেপে গেছে আমার উপর!
۞ ২৯-০৭-১৯৯৮
এখন টমি ঘুড়ি উড়াতে পারে! ও দাঁতে সুতা চেপে ধরে আর দূর থেকে কেউ ঘুড়ি ছেড়ে দিলে সে সুতা নিয়ে উল্টো দিকে দৌড় দেয়! অবশ্য বেশিক্ষণ তার ঘুড়ি আকাশে থাকে না। আমি আমারটা উড়াই আর শরিফ আর টমি একটা উড়ায়। শরিফ ঘুড়ি ছাড়ে আর টমি সুতা মুখে দৌড় দেয়!
۞ ২৩- ০৯-১৯৯৮
টমির জন্য বাসায় ক্রিকেট খেলতে পারছি না। আমরা খেলার সময় ও পাশে দাঁড়িয়ে থাকে যখন ওর কাছে বল যায় ও বল মুখে নিয়ে দৌরে পালিয়ে যায়। অনেক দৌরে বল নিতে হয় ওর কাছ থেকে। ওকে বকা দিলে একটু দূরে গিয়ে বসে থাকে কিন্তু একটু পরে আবার এসে বল নিয়ে দৌড় দেয়। কি মুসিবত! ওর জন্য কি একটু খেলতেও পারব না?
۞ ১১-১০-১৯৯৮
গতকাল গভীর রাতে আমাদের বাড়িতে একটা চোর এসেছিল। কিন্তু টমি জেগে থাকায় ও ঘেউ ঘেউ করে সবাইকে জাগিয়ে দেয়। পরে চোর পালানোর সময় চোরের পায়ে কামড় দিয়ে ওর পেন্টের কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে আসে। আম্মু দাদাজান সবাই খুব খুশি হয়েছে।
۞ ২৩-১০-১৯৯৮
টমির একটা বান্দবি হইচে। সে এখন একটা মেয়ে কুকুর নিয়ে ঘুরে। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। ফুফু বলে ঐ কাল কুকুরটা নাকি টমির বউ! কুকুর কি বিয়ে করে? যাই হোক, টমির বউ আমার পছন্দ হয় নাই। ওটা দেখতে একটুও সুন্দর না। টমি ঐ কুকুরের সাথে ঘুরে ঘুরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
۞ ১১-১১-১৯৯৮
টমি অনেক হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। ও আমাদের বাড়ির মানুষ ছাড়া আর কাউকে দেখতে পারে না। বাড়িতে অন্য কেউ আসতে পারছে না। সারদিন খালি ঘেউ ঘেউ করে টমি। ওর অনেক রাগ, আমাদের পাশের বাড়ির শরিফকেও দেখতে পারছেনা সে।
۞ ০৫ – ১২-১৯৯৮
হিন্দুবাড়ির মনা নামের ছেলেটা ভয়ানক শয়তান। আজ ও আমার সাথে মারামারি করতে আসছিল। পরে টমি ওকে এমন দৌড়ান মেরেছে যে বেচারা ভয়ে পালিয়ে গেল। ওর পায়েও একটা কামড় দিয়েছে। বাসায় আজ বিচার এসেছে। আম্মু আর দাদা অনেক রাগ করেছে টমির উপর।
۞ ১৩-১২-১৯৯৮
টমি কেন যেন পুরা পাগলা হয়ে যাচ্ছে। ওকে দিনের বেলায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। কোন অপরিচিত মানুষ সহ্য করতে পারে না। দাদা বলেছে মেরে ফেলতে, আমি বলেছি আমার জীবন দিয়ে গেলেও ওকে মারতে দিব না।
۞ ০৫-০১-১৯৯৯
আজ জেলা শহরের ভাল স্কুলে ভর্তি পরিক্ষায় দিয়েছি, বিকালে রেজাল্ট দিয়েছে। আমি টিকেছি। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে ক্লাস। ওখানে নাকি আমাকে হোস্টেলে থাকতে হবে। আমি চলে গেলে টমিকেও আমার সাথে নিয়ে যাব। টমিও আমার সাথে হোস্টেলে থাকবে। টমি না গেলে আমিও যাব না। আম্মু বলেছে ঠিক আছে।
۞ ৩১-০১-১৯৯৯
আজ আমি হোস্টেলে উঠলাম। আমার অনেক কষ্ট লাগছে। এই হোস্টেলে কুকুর রাখা যাবে না। তাই আম্মু টমিকে আনতে দেয় নাই।
আজ হোস্টেলে আসার সময় টমিকে আমার সাথে ট্রেন স্টেশান পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। যতক্ষণ স্টেশানে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম ততক্ষণ ও আমার পাশে বসে ছিল। আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম। আজ ও খুব ঠাণ্ডা ছিল।
আজ ও আমার সাথে ঝাল চানাচুর খেয়েছিল। তবে কাঁচা মরিচ আলাদা করে রেখেছিল।
আমি আর আম্মু যখন ট্রেনে উঠে যাই ও তখন বোকার মত চেয়ে ছিল আমার দিকে। আর যখন ট্রেন ছেড়ে দিল ও তখন পুরা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনের সাথে সাথে দৌড় দিয়েছিল। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। টমি আমার বগির সাথে সাথে দৌড় দিচ্ছিল। সামনে একটা খাল পড়েছিল, সে আগে পিছে না ভেবেই ঐ খালে লাফ দিয়ে সাঁতার দিয়ে অপর পাড়ে উঠে যায়। কিন্তু ততক্ষনে আমার ট্রেন অনেক দূর চলে গেছে। তবুও টমি দৌড়িয়েছে যতক্ষণ দেখা গেছে ট্রেনটা। আমি অনেক কেঁদেছি। আম্মু বলেছে কাল হোস্টেলে ফোন করে জানাবে ও ঠিক মত বাড়ি পৌঁছিয়েছে কিনা। আমার খুব ভয় করছে টমির জন্য। ও কি ঠিক ভাবে বাড়ির পথ চিনে গিয়েছে?
۞ ০১-০২-১৯৯৯
আম্মু ফোন করেছে। টমি ভালভাবেই বাড়ি গিয়েছে। যাক অনেক চিন্তা লাগছিল আমার। আবার কবে টমিকে দেখতে পাব কে জানে?
۞ ১৮-০৩-১৯৯৯
অনেক দিন বাড়ি যাই না, টমি নাকি আগের চেয়ে ভাল আছে। এখন আর পাগলামি করে না। খুব ভাল লেগেছে শুনে। অনেক অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে।
۞ ২৩-০৪-১৯৯৯
কাল আমার প্রথম সাময়িক পরিক্ষা শেষ। তারপর বিকালে মামা এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। কত দিন বাড়ি যাই না। আমি কাল আমার টমিকে দেখতে পাব। আমি অনেক অনেক খুশি। টমি আমি আসছি।
۞ ২৪-০৪-১৯৯৯
আজ আসার সময় মামার কাছ থেকে শুনলাম আমার টমি আর পৃথিবীতে নেই।
[সম্প্রসারন- পরদিন মুহিন যখন মামার সাথে ট্রেনে করে বাসায় ফিরছিল তখন বাড়ির কাছাকাছি সময়ে মামা ওকে বলে “মুহিন একটা কথা, তুই মন খারাপ করিস না কিন্তু”।
মুহিন বলেছিল- কি কথা মামা?
মামা বললেন- তোর টমি তুই হোস্টেলে যাবার পরে আরও পাগল হয়ে যায়। একদিন একজনের একটা ছাগলকে কামড়িয়ে মেরে ফেলে। সে তোর আম্মুর কাছে বিচার দেয়। তোর আম্মু হিন্দু বাড়ির মনাকে দিয়ে টমিকে মেরে ফেলে” । তারপর ..........! ]
ডাইরিটা পড়তে পড়তে আজ এত বছর পরেও মুহিনের চোখের কোনে অস্রু বিন্দু জমে গেল। ডাইরিটা বন্ধ করে খোলা পোর্ট হোলের পাশে এসে দাঁড়াল সে। বাইরে অন্ধকার সাগর। দূরে কোথায় কোন এক দ্বিপে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। মুহিন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বুকে অনেক অনেক বছর আগের জমা একটা ক্ষত আজ আবার জেগে উঠেছে তার। মায়ের উপর অভিমান কি এখনো আছে মুহিনের বুকে??- এই প্রশ্নের জবাব আজও পায়নি সে। বুকের ভেতর চাপা একটা কষ্ট জমা। কোনদিন হয়ত এটা মুছে যাবে না।
রাতের বিশাল খোলা আকাশের তারার দিকে টাকায় এম ভি ওশান ওয়েভের থার্ড মেট মুহিন। সে তারাদের মাঝে টমি নামের একটা মিষ্টি কুকুরের মুখ খুজে বেড়ায় সে।
রাতে মুহিন একটা স্বপ্ন দেখল- একটা খোলা প্রান্তর, সে আর টমি হাঁটছে। টমির গলায় লাগানো ঘুঙ্গুরটা ঝুনঝুন করে বাজছে। সামনে দেখতে পেল সেই খুনি মনাকে।
মুহিন এক মুহূর্ত থেমে মনার দিকে একটা আঙ্গুল তাক করে টমিকে বলল- ছু টমি ছু!
=================================
☯ কিছুদিন আগে একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম- আজ ঘুমে একজনকে স্বপ্নে দেখলাম। সে হল “টমি”- আমার পোষা কুকুর। সে আমার জীবনে এসেছিল যখন আমি ক্লাশ ফাইভ এ পড়ি। তারপর একদিন সে হারিয়ে যায়। ভেবেছিলাম তাকে হারানোর ক্ষত অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। কিন্তু বিধি বাম আজ বুঝতে পারছি তা এখনো শুকায়নি। আমরা মানুষরাই মনে হয় ভালোবাসা, কষ্ট অনেক দিন লালন করতে পারি সঙ্গোপনে।
ভাল থাকবেন সবাই।