১) এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রাথমিক প্ল্যান ফেল করেছে, ফেল করেছে তার দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ প্ল্যান……। দুই সপ্তাহ দূরে থাক ৮ মাসেও কিয়েভ দখল করতে পারেনি রাশান ফোর্স।কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা আপাতত মুলতবী করেছে রাশিয়া। আজও জেলেনিস্কি সরকারের পতন হয়নি। জেলেনিস্কি দেশ ছেড়ে ভাগেনি। অনেকে যাকে জোকার বলে সে আদতে যুদ্ধ চলাকালীন সফল একজন সফল প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিজেকে প্রমান করেছে। রাশিয়ার মতন পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা নো জোকিং ম্যাটার।
.
২) এই যুদ্ধের কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সব চেয়ে বড় রেফিউজি ক্রাইসিস সৃষ্টি হয়েছে, যাতে করে ইউক্রেনের ভিতর ৬৬ লাখ মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে আর দেশ ছেড়ে গেছে ৬৭ লাখ মানুষ, যাদের বেশীর ভাগ নারী আর শিশু।এর কারন যুদ্ধের শুরুতেই ইউক্রেনের সরকার দেশের ১৮-৬০ বছরের পুরুষের উপর দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। ইউক্রেনিয়ান্স আর ফাইটিং ফর দেয়ার সারভাইবাল। কিন্তু রাশিয়া? দে আর ফাইটিং ফর দেয়ার ইগো আর গ্রিড। ন্যাটো আদতে কোন ফ্যাকটর না, পুতিনের দেখান এক জুজুবুড়ী।
.
৩) যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়েছে। কিয়েভের হিসাবে নিহত ইউক্রেনিয় সেনাদের সংখ্যা ৯,০০০ আর নিহত রাশিয়ান সেনা সংখ্যা ৬০,০০০। আর রাশিয়ানদের হিসাবে নিহত রাশিয়ান সেনা সংখ্যা ৫,০০০ আর নিহত ইউক্রেনিয় সেনা সংখ্যা ১৪,০০০। এর উপর আছে প্রচুর ইউক্রেনিয় নিহত সিভিলিয়ানদের সংখ্যা। অবশ্যই উভয় পক্ষই নিজেদের প্রকৃত নিহতদের সংখ্যা কমিয়ে আর নিহত শত্রু পক্ষের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে। জাস্ট টু কিপ থিংস ইন পারস্পেকডিভ, আমেরিকা-আফগান যুদ্ধে কেবল ২,৪০০ আমেরিকান সেনা নিহত হয়েছিল। এতে প্রমান হয় যে রাশিয়ান যুদ্ধের পলিসি মেকারেরা তাদের সেনাদের জানের কন পরোয়া করছে না। যা আমেরিকানরা হিসাবে রেখেছিল। ওবামা আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সেনা না পাঠিয়ে এই কারনেই কিলার ড্রোন পাঠিয়েছিল। এখানে কেবল নিজ দেশের সেনাদের জান হেফাজতের কথা বলছি। অপরপক্ষের না। রাশিয়া সিরিয়া আর ইউক্রেন যুদ্ধে লোকাল জানমালের কোন পরোয়া করে নাই, আমেরিকাও করে নাই অন্য দেশের মানুষ হত্যা করার বেলায়।
.
৪) এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রাশিয়া ইউক্রেনের ১৭,০০০ বর্গমাইল জায়গা দখল করেছিল (ক্রাইমিয়া+ লুহান্সক+ডোনেটস্ক)। ফেব্রুয়ারি থেকে অগাস্টের মাঝেই দখল করে নেয় আরও ৩০,০০০ বর্গমাইল। ইউক্রেন দখলকৃত জায়গার ৮,০০০-১০,০০০ বর্গমাইল ফের সবাধিন করে ফেলেছে। জেলেনিস্কি এডামেন্ট রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনের মাটি ফের সবাধিন করবে, কিন্তু আমার মতে ক্রাইমিয়া, লুহান্সক, ডোনেটস্ক রাশিয়ার অঙ্গরাজ্য হিসাবেই থাকবে, এবং বাড়তি কিছু অঞ্চল থাকবে তাদের ছত্রছায়ায়। এসব পুতিনের রেড লাইন। ধারনা করছি ক্রাইমিয়ার ব্রিজ এট্যাক করে ইউক্রেন পুতিনের সেই রেড লাইন ক্রস করেছে, যার রিটেলিয়েশানে রাশিয়া সমগ্র ইউক্রেন জুড়ে মিসাইল এট্যাক করেছে। যদিও ইউক্রেনের সিক্রেট সার্ভিস বলছে তাদের কাছে অক্টোবরের ২-৩ তারিখেই ইনফরমেশান ছিল যে রাশিয়া ইউক্রেনের সিভিলিয়ান ইনফ্রাস্ত্রাকচারে ম্যাসিভ এট্যাক চালাবে।
.
৫) যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা দেখেছি রাশিয়ার আক্রমনের ধারা আমেরিকার মতন নয়। আমেরিকা আর রাশিয়ার যুদ্ধের নীতি, পলিসি, যুদ্ধ পরিচালনা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। আমেরিকা যেখানে শুরুতেই, বিফর এনি গ্রাউন্ড ফোর্স এট্যাক, ম্যাসিভ মিসাইল এট্যাক আর আকাশ দখল করে এমন ভাবে বোমা ফেলতে থাকে যার কারনে শত্রু পক্ষ ভয়ের চোটে প্যারালাইজড হয়ে পড়ে, যার কারনে তারা সরাসরি ডিফেন্সে না গিয়ে নিজ দেশে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়, সেখানে রাশিয়া মুলত গ্রাউন্ডে তাদের সেনা পাঠিয়ে আক্রমনের শুরুটা করে। এতে করে ইউক্রেন পালটা আক্রমনের সুজোগ পেয়ে যায়। ইউক্রেনের আকাশ রাশিয়ার দখলে না থাকায় ইউক্রেন সমানে অস্ত্র আমদানি করে এখন পর্যন্ত ভালো মতন রাশিয়াকে ঠেকাতে সক্ষম হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনকে ইউরোপ থেকে কাট অফ করতে পারেনি। রাশিয়া মুলত উত্তরপূর্ব আর দক্ষিণপূর্ব দিকে মনোনিবেশ করেছে। আর ইউক্রেনের পশ্চিম সিমান্ত ইউক্রেনিয়দের হাতেই থেকেছে।
.
৬) এই যুদ্ধে রাশান মিলিটারির অত্যন্ত দুর্বল লজিস্টিকস দেখতে পাচ্ছি। মিলিটারির সাকসেস নির্ভর করে তাদের লজিস্টিকসের উপর। এজ এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট মিলিটারি রান্স অন লজিটিক্স। যেই সামরিক বাহিনির লজিস্টিকস যত পাওয়ারফুল তাদের মিলিটারিও তত পাওয়ারফুল। লজিস্টিকসের একটি ছোট উদাহরন - যুদ্ধে ট্যাংক কোন কারনে অকেজো হয়ে গেলে আর তা উপস্থিত ভাবে রিপেয়ার করতে না পারলে সৈন্যদের ট্যাংক ছেড়ে পালাতেই হবে, যা হয়েছে রাশিয়ান সৈন্যদের বেলায়, আর এই রিপেয়ারের প্ল্যান, ট্রেইনিং, আর সরঞ্জাম সরবরাহ নির্ভর করে তাদের লজিস্টিক্যাল সাপোর্টের উপর। রাশিয়া তাদের সেনাদের এই লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট দিতে মোটামোটি ব্যর্থ হয়েছে।
.
৭) যুদ্ধ শুরু হয়ার পর অপরপক্ষের রিএকশান, পাল্টাআক্রমনের, নিজেদের ব্যাটেল সাকসেস, লসের উপর নির্ভর করে উভয়পক্ষই তাদের ব্যাটেল প্ল্যান সমানে পরিবর্তন করতে থাকে। কখনই কোন পক্ষ তাদের সেইম পলিসি নিয়ে বসে থাকে না, আর এই এডপ্টাবিলিটির উপরেই নিজ নিজ জয় পরাজয় নির্ভর করে। রাশিয়া -ইউক্রেন উভয় পক্ষই এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যার কারনে আমরা দেখেছি যুদ্ধের শুরুতে কিয়েভের অত্যন্ত কাছে রাশিয়ান সেনা এনেও যখন বুঝতে পারে এভাবে গ্রাউন্ডে এট্যাক করে কিয়েভ দখল করা যাবে না, তখন তারা তাদের সেনাদের রিট্রেটের আদেশ দেয়। রাশিয়া এরপর যুদ্ধ সরিয়ে নেয় মুলত ইউক্রেনের দক্ষিন পূর্বাঞ্চলে, যেখানে তারা একের পর এক সাকসেসের মুখ দেখে। অপর দিকে ইউক্রেন যখন দক্ষিন পূর্বাঞ্চল হারাতে থাকে তখন ডীফেন্স থেকে অফেন্সে চলে যায়, কেবল ডিফেন্স ধরে না রেখে। আর ধীরে ধীরে বেশ কিছু অঞ্চন স্বাধীন করে ফেলে।
.
৮) যুদ্ধে প্রচুর হতাহতের কারনে রাশিয়া ম্যাস মোবিলাইজেশান শুরু করেছে। রাশিয়ার ম্যাস মবিলাইজেশানে মুলত আরোপ করা হয় এথনিক সংখ্যালঘুদের উপরে , যেমন দাগেস্তান, চেচনিয়া, ইয়াকুতিয়া, সাহা ইত্যাদি অঞ্চলে। যাদের কেবল অল্প ট্রেইনিং আর রসদ দিয়েই যুদ্ধে পাঠিয়ে দিচ্ছে পুতিন। এতে করে রাশিয়া কি লাভবান হতে যাচ্ছে বলা মুশকিল, আদার দেন তাদের হতাহতের সংখ্যা বাড়ানো। ম্যাস মোবিলাইজেশানের টার্গেট হচ্ছে আরো ১০ লাখ সেনা। অলরেডি রাশিয়াতে এই মোবিলাইজেশানের বিরুদ্ধে অল্প বিস্তর প্রটেস্ট দেখা যাচ্ছে, প্রচুর রাশান দেশ পর্যন্ত ত্যাগ করছে।
.
৯) তুরস্ক থেকে শুরু করে আমেরিকা, বিভিন্ন দেশ থেকে ইউক্রেন প্রচুর অস্ত্র কিনেছে আর এইড পেয়েছে। আমেরিকা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি মিলিটারি সরঞ্জাম যার দাম প্রায় ১৫.৮ বিলিয়ন ডলার। ড্রোন, আর্টিলারি, এট্যাক হেলিকপ্টার, বডি আর্মার, এন্টাই ট্যাঙ্ক অয়েপেন ইত্যাদি অনেক কিছুই পেয়েছে ইউক্রেন যা দিয়ে তারা এফেকটিভ যুদ্ধ পরিচালনা করছে। কিন্তু যার অভাব, তা হচ্ছে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। বারবার চেয়েও জেলেনিস্কি ইজরায়েলের আয়রন ডোম কিনতে ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকাও এখন পর্যন্ত কোন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ইউক্রেনে পাঠায় নি। তবে রাশিয়া মিসাইল এট্যাকের পর ইউক্রেন পশ্চিমের উপর এই সিস্টেমের জন্য প্রেশার সৃষ্টি করেছে। হুইচ ইজ া মাস্ট হ্যাভ ফর ইউক্রেন।
.
১০) পশ্চিমের স্যানকশানের ফলে প্রথমে রাশান কারেন্সি রুবেলের ধ্বস নামলেও, রাশিয়া তাদের সাথে ব্যবসায় অন্যান্য দেশকে রুবেল ব্যবহারে বাধ্য করাতে রুবেলের অবস্থান এখন গত ৭ বছরের মধ্যে হাইয়েস্ট। রুবেলের দাম প্রায় ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
.
১১) পশ্চিমা বেল্ট ছাড়া বিশ্বের বাদবাকি দেশ এই যুদ্ধে পশ্চিমের সাথে নাই। ভারত, চীন, ইরান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশ রুবেলেই রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করছে। ভারত আর চীন রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমান তেল আর গ্যাস কিনছে। রাশিয়ার উপর পশ্চিমের স্যাঙ্কশান পুরাপুরি কার্যকর হয় নাই এসব কারনে।
.
১২) রাশিয়ার বিপুল পরিমান ফায়ার পাওয়ার আছে যা রাশিয়া এখনও পুরাপুরি ব্যবহার করে নাই। এমনকি তাদের আধুনিক সামরিক সরঞ্জামও মাঠে তেমন একটা নামায় নাই। আগেই বলেছি ইউক্রেনের আকাশও নিজ দখলে নেয় নাই, যা তার সিরিয়াতে করেছিল। কেবল পাঠিয়েছে বিপুল সংখ্যক সৈন্য, উইথ ইনেডেকুয়েট ট্রেইনিং এন্ড অয়েপেন্স, যেন অপেক্ষা করছে ইউক্রেনের ভান্ডার শেষ হয়ে সব দেশ সাহায্য করতে করতে টায়ার্ড হয়ে যায়।এরপর হয়ত রাশিয়া বলবে ইটস টাইম। কিন্তু রাশিয়ার ইনার অডিয়েন্স রাশান ফেইলিয়রে হতাশ হয়ে পড়ছে, তারা চায় অচিরেই কিয়েভে পতন। পুতিনকে সেই ব্যবারটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে, এই মিসাইল এট্যাক এর অন্যতম অডিয়েন্স ছিল রাশার নিজ পপুলেশন।
.
১৩) পুতিন কিন্তু সব সময় বলেছে অল হ্যান্ডস আর অন ডেক, নিউক্লিয়ার অপশান ইজ দেয়ার। তার উপর দেয়া আছে পুতিনেরে আরোপ করা রেড লাইন। সেই রেড লাইন মেনে নিলে পুতিন শান্ত থাকতেও পারে, আর যদি ইউক্রেন সেই রেড লাইন সিরিয়াসলি ক্রস করে তাহলে নিউক্লিয়ার হামলা অসম্ভব নয়।
.
কিন্তু যা অবধারিত সত্য তা হচ্ছে আজ যদি রাশিয়া থেমে যায় তাহলে যুদ্ধ থেমে যাবে, কিন্তু যদি ইউক্রেন থেমে যায় তাহলে ইউক্রেন বলে কোন স্বাধীন দেশ থাকবে না।
কোর্টেসি: সাবিনা আহমেদ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১:২৬