কোরবানির শিক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছি কতটুকু!
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ভালবাসা ও ত্যাগের এক অপূর্ব নিদর্শনের স্মৃতিকে স্মরণ করার জন্য আল্লাহপাক বিত্তবান মুসলমানদের উপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন। আল্লাহর নির্দেশে আদিষ্ট হয়ে ২য় হিজরীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদুল আযহার সালাত আদায় ও কুরবানি করেন। সেই হতে প্রতিবছর মুসলিম উম্মাহ যথারীতি কুরবানি করে আসছে।
আল্লাহর আদেশপ্রাপ্ত হয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যখন নিজের বার্ধক্য বয়সের একমাত্র অবলম্বন, নয়নের মণি, কলিজার টুকরা টগবগে যুবক ইসমাঈলকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার লক্ষ্যে ধারালো অস্ত্র হাতে নিজের চোখ বেঁধে ফেললেন তখনই আল্লাহ ইব্রাহিম (আঃ)-এর কোরবানি কবুল করে নিলেন এবং বেহেস্ত থেকে দুম্বা এনে পশু কোরবানির প্রথা চালু করলেন। আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে এর আগেও অনেকবার পরীক্ষা করেছেন। সকল পরীক্ষায় তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। একরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহপাক তাঁকে ইঙ্গিত করেছেন প্রাণাধিক প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করতে। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় আর কি হতে পারে। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানি করবেন। তখন তিনি হযরত ইসমাঈল (আঃ)কে বললেন, “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কি?” হযরত ইসমাঈল (আঃ) বললেন, “হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা সফফাত আয়াত-১০২)। ছেলের সাহসিকতাপূর্ণ জবাব পেয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছেলের গলায় ছুরি চালান। তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত হতে একটা দুম্বা নিয়ে রওয়ানা হন। তাঁর মনে এতই সংশয় ছিল যে পৃথিবীতে পদার্পণের পূর্বেই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যবেহ কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলবেন। তাই জিবরাইল (আঃ) আকাশ হতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন “আল্লাহু আকবার”। আওয়াজ শুনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার”। পিতার মুখে তাওহীদের বাণী শুনতে পেয়ে হযরত ইসমাঈল (আঃ) বলে উঠলেন আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিলহামদ”। আল্লাহর প্রিয় দুই নবী এবং হযরত জিবরাইল (আঃ)-এর কালামগুলো আল্লাহর দরবারে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত এই কথাগুলো জিলহজ্ব মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকবে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কালামে ঘোষণা করেনঃ “তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু।” (সূরা সাফফাত আয়াত-১০৪-১০৭)। আর তখন থেকেই শুরু হলো কোরবানীর মহান বিস্ময়কর ইতিহাস। যা অনন্তকাল ধরে সুন্নতে ইব্রাহীম হিসেবে বিশ্বের সকল মুসলমানের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
বাংলাদেশের মুসলমানরা অত্যন্ত ঝাকঝমকভাবে ঈদ-উল-আজহা পালন করে ও পশু কোরবানি দেয়। এখানে যদিও আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে কুরবানির পশুর গোশত কিংবা রক্তের কোন মূল্য নাই (পৌঁছে না) বরং এক্ষেত্রে কুরবানি দাতার খোদাভীতিই মূখ্য’ । কিন্তু দেখা যায় আমাদের সমাজে কুরবানিকে কেন্দ্র করে গোশত প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় । তাছাড়া কোরবানি বিত্তবান মুসলমানদের উপর শর্তসাপেক্ষে ওয়াজিব হলেও যে প্রথায় আমরা করে থাকি তাতে লোক দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ বলেন: ‘বল, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোন শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’(সুরা আন’আম, আয়াত ১৬২, ১৬৩)। মুসলমানদের মনে রাখতে হবে এটা কোন প্রতিযোগিতা নয়, এটা আল্লাহর প্রতি বান্দার এক অপরূপ আত্মবিসর্জনের স্মৃতিচারণ। এটা মুসলমানের ঈমানের পরীক্ষা।
আসুন এবার দেখি এই ত্যাগ ও মহিমায় ভাস্বর পবিত্র জ্বেলহজ্জ মাসে আমরা প্রতিবছর যে কোরবানি করি তাতে আমাদের আর্থ-সামাজিক কোন পরিবর্তন আসছে কি? এটা ঠিক যে দূর্মূল্যের বাজারে অসহায়, দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষগুলো যাদের টাকা দিয়ে কিনে গোশত খাওয়ার সুযোগ হয়না তারা বছরে অন্তত একদিন হলেও গোশত খেতে পারছে। কিন্তু এই শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন আধো মজবুত হচ্ছে কি? আমরা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল(আঃ) এর ঈমানী পরিক্ষার রিহার্সাল দিয়ে মূলতঃ সেই পরীক্ষাকেই স্মরণ করি বটে তবে এটা আমরা ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই আমরা সেই নবীর উত্তর সূরী যিনি আল্লাহর আদেশ পালনে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে জবাই করে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। আল্লাহর আনুগত্যের চর্চা করতেই প্রতিবছর আমাদের কাছে কোরবান আসে।
এবার দেখি বিশ্বের কয়েকটি দেশের কোরবানির চিত্র। কিছু দিন আগে ব্লগসাইডে একজন বাংলাদেশী মহিলা লেখিকা ‘কোরবানি দেশে দেশে’ শিরোনামে একটি পোষ্ট দিয়েছিলেন। তিনি স্বামীর সাথে বিভিন্ন দেশে থাকতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, সিংগাপুর, লেবাননের কোরবানের বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে অন্যান্য দেশের কোরবানের বর্ণনা হতাশাজনক হলেও ইন্দোনেশিয়ার কোরবানির বর্ণনা আমার ভাল লেগেছে। ঐ বর্ণনার কিছু অংশ আমি হুবহু তুলে ধরছি, ‘প্রথম বছরের ঈদ কোরবানি কোন রকম করে কাটিয়ে দিলাম। পরের বছর মেয়েদের বাবাকে বললাম আমরা এবার কোরবানি দিব। তিনি বললেন এখানে নিজে নিজে কেউ কোরবানি দেয় না। কেন দেয় না এসবের কিছুই বললেন না। যাই হোক কোরবানির দিন আনুমানিক ১১/১২টার দিকে এক লোক এসে আমাকে ছোট একটা প্যাকেট দিয়ে বললো কোরবানির মাংস, এলাকার মসজিদ থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে। ঘটনা বুঝলাম না। মসজিদ কেন আমাকে মাংস পাঠাবে? যাই হোক জানার আগ্রহ নিয়ে এক প্রতিবেশীর স্মরণাপন্ন হলাম। ইন্দোনেশিয়ায় সাধারণত যারা হজ্ব করেছে কেবল মাত্র তারাই কোরবানি দেয় এবং শুধু মাত্র তাদের উপরই নাকি কোরবানি ফরয। গরু বা ছাগল কিনে হাজীরা এলাকার মসজিদে দিয়ে দেয়। এই রকম করে দেখা যায় একটা মসজিদে ১/২টা গরু এবং ৮/১০টা ছাগল জমা হয়। প্রত্যেকটা এরিয়াতে একটা করে মসজিদ থাকে। মসজিদের যে ইমাম তার কাছে হিসাব থাকে ঐ এলাকায় কত গুলো ঘর বা ফ্যামিলি আছে। কোরবানীর দিন যে কোরবানি দেয় তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় স্পেশাল ভাবে সে বেশী মাংস চায় কিনা। বেশীরভাগ হাজীরাই না বলে কারণ মাংস বেশী চাওয়াটাকে এরা খারাপ চোখে দেখে। কারণ কোরবানির অর্থই তো বিসর্জন। পুরো মাংসকে যতগুলো ঘর ঠিক ততগুলো ভাগে ভাগ করা হয় সমানভাবে। এবং সবার বাসায় ছোট ছোট প্যাকেটে করে দিয়ে আসা হয়। যাদের অবস্থা ভালো তারা ফিরিয়ে দিয়ে বলে আমি মাংস কিনতে পারি, আমারটা গরীব কাউকে দিয়ে দাও। খুব খুবই ভাল একটা উদ্যোগ। একদিনের জন্য সবাই মাংস খেতে পারে। কোরবানির আসল অর্থ এটাই হওয়া উচিত।’ এই ছিল ইন্দোনেশিয়ার কোরবানের বর্ণনা। আমাদের দেশে বিত্তবানেরা গরীবদের প্রতি অনেক সহনশীল থাকে, অনেকেই অকাতরে দু’হাতে বিলি করে। আবার এটাও ঠিক যে কোরবান আসলে ডিপফ্রিজের বিক্রিও বেড়ে যায়, গোশত কাঁটার বা ভাগ করার আগেই অনেক সময় কেউ কেউ ভাল ভাল গোশত আলাদা করে রাখেন। এই মন মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া খুবিই জরুরী। এটা করতে গিয়ে গরীব আত্মীয়-স্বজন, মিসকিন যেন বঞ্চিত না হয় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। এরশাদ হয়েছে, . . . . .আল্লাহ্ তো কেবল মুক্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন (সুরাঃ মায়েদা-২৭)। আসুন আমরা মুক্তাকি হওয়ার চর্চা করি।
আজকের পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
লিংক:
http://epurbodesh.com/index.php?date=12-09-2016&page=3